Melinda Pavek

আবার আসিব ফিরে

রোল, ফুচকা, দুর্গাপুজো, বইপাড়া, ইতিহাসের স্বাদগন্ধে কলকাতার প্রেমে পড়ার গল্প শোনালেন বিদায়ী আমেরিকান কনসাল-জেনারেল মেলিন্ডা পাভেক।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪ ০৮:৪০
Share:

আমেরিকান কনসাল-জেনারেল মেলিন্ডা পাভেক। —ফাইল চিত্র।

শুরু করেও বাংলাটা শেখা হল না-বলে আফসোস রয়েছে তাঁর। তবু মনে রাখার মতো টুকরো-টাকরা বাংলা ঢুকে পড়েছে মেলিন্ডার সংগ্রহের শব্দ ভাঁড়ারে! আমেরিকান কনসাল-জেনারেল মেলিন্ডা পাভেক বললেন, “বাংলা শুনলেই আমার মনে পড়বে শুভ বিজয়া!” কী আশ্চর্য! উৎসবের শেষ বা বিদায়বেলার সঙ্গে বাঙালি মনেও তো এই শব্দটাই গেঁথে রয়েছে।

Advertisement

কলকাতার সঙ্গে আমেরিকার কুটুম্বিতার এটা ২৩০ বছর। দেশের বাইরে তাদের দ্বিতীয় কূটনৈতিক ঘাঁটি হিসেবে কলকাতাকেই বেছে নিয়েছিল আমেরিকা। এখানে তিনটি বছরের মেয়াদ শেষেও কলকাতার চির রহস্যময়ী ছকভাঙা আবেদনে মজে আছেন মেলিন্ডা।

কলকাতা, লাহোর ভাই-ভাই আমেরিকান ফরেন সার্ভিসের হয়ে লাহোর, ইসলামাবাদেও ছিলেন মেলিন্ডা। নেপালেও থেকেছেন দীর্ঘদিন। লাহোর আর কলকাতার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিল খুঁজে পেয়ে আপ্লুত তিনি। বলছিলেন, “অমৃতসর, দিল্লি, আগরা, রাজস্থান, গোয়া... কত জায়গায় ঘুরেছি। তবে কলকাতা আর লাহোর যেন টুইন সিটি!” মেলিন্ডার চোখে, ইসলামাবাদ, দিল্লি এক ধাঁচের। রাজধানী শহর, প্ল্যানড সিটি। “আর কলকাতা, লাহোর দুটোই আর্ট, কালচার, নাচ, মিউজ়িক, অসামান্য খাবার আর গল্পের খনি!” মেলিন্ডার মত, “দুটো শহরেই দেশভাগের যন্ত্রণা এখনও টনটনে। এটা আছে বলেই কমিউনাল হারমনি বা সংহতির একটা টানও তীব্র! কলকাতায় যেখানেই যাই, লোকে আমার কাছে পাকিস্তানের গল্প শুনতে চায়, এটা যে কী মিষ্টি লাগে…!”

Advertisement

হেঁটে দেখতে শিখুন সুযোগ পেলেই শহরে হাঁটার নেশায় মেতেছেন মেলিন্ডা। বলছিলেন, “উত্তর কলকাতা, দক্ষিণ বা নিউ টাউন যেখানেই গিয়েছি, হেঁটে ঘুরেছি। আগে কফিপ্রেমী ছিলাম। এখানে এসে চা নিয়ে খুঁতখুঁতে হয়েছি। সিটিসি আর ফুল লিফের ফারাক বুঝেছি! আবার রাস্তার চা-দোকানের ফোটানো চাও আমার পছন্দের।” তাঁর সঙ্গী ব্র্যান্ডনের সঙ্গে কলেজ স্ট্রিটে পুরনো বইয়ের দোকানে ঘোরার গল্প করলেন মেলিন্ডা। তার পরে তেষ্টা মেটাতে কফিহাউস! তবে পার্ক স্ট্রিটে অক্সফোর্ডের দোকানটাতেই বেশি সময় কাটিয়েছেন। মেলিন্ডার বোনও গত বছর এসে শহরে অনেক ঘুরেছিলেন। আর তাঁর মা-বাবাও রাজভবন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ঘুরে মুগ্ধ।

ঐতিহ্য ও আধুনিকতা কলকাতার ইতিহাস যেমন টানে, তেমনই ইতিহাস আর সমকালের মধ্যে সংলাপ কী করে জারি থাকবে, তা-ও ভাবেন মেলিন্ডা, “ইতিহাসের সব হয়তো রাখা যাবে না। তবে যা রয়েছে আধুনিক শহরের চাহিদা মেনেই রাখতে হবে।” কথায় কথায় গঙ্গার ভগ্নপ্রায় ঘাটগুলির কথা তুললেন মেলিন্ডা, “আই লাভ দোজ় ডায়িং গাটস (ঘাট)! পুরনো ঘাটগুলোর উপযোগিতা পাল্টেছে। ফুলবাজারটা যেমন পরে হয়েছে। কলকাতা একটা জলজ্যান্ত শহর, সবার চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য থাকলেই ভাল হয়।”

কলকাতা ও নিউ অর্লিন্স ক্যাটরিনা ঝড়ে ধ্বস্ত নিউ অর্লিন্সের সঙ্গে কলকাতার মিল পান মেলিন্ডা। বলছিলেন, “কলকাতারও মাথার উপরে ঘূর্ণিঝড়ের বিপদের ছায়া। সুন্দরবনে নোনা জল ঢুকছে। সল্টলেক একদা লেকই ছিল। এ শহরের ইতিহাসও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস!” পরিবেশবন্ধু পরিকাঠামো, সৌরশক্তির প্রসার কলকাতার জন্যও জরুরি মনে করেন মেলিন্ডা।

দুর্গাপুজোয় মেলিন্ডা।

পুজোর বাদ্যি প্রথম বছর অতিমারির জন্য পুজোর নেশাটা ঠিক টের পাননি। এর পরেই দুর্গাপুজোর ইউনেস্কো স্বীকৃতি। কলকাতার ভিতরের শিল্পী মনটাকে মেলিন্ডা দুর্গাপুজো দিয়েই বুঝেছেন। তাঁর কথায়, “কলকাতার মানুষ রোজকার বেঁচে থাকার মধ্যে কোনও একটা প্যাশনের টান খোঁজে। কেউ কবিতা লেখেন, ছবি তোলেন, আঁকেন বা ব্লগ লেখেন! ক্রমশ টের পেয়েছি, শহরের শিল্পী মনের নির্যাস দুর্গাপুজোতেই ধরা পড়ে। ইটস ডেফিনিটলি দ্য বিগেস্ট থিং ইন দ্য সিটি।” দুর্গাপুজোর সূত্রেই শহরের কোণে কোণে ঘুরেছেন মেলিন্ডা। বলছেন, “২০২২-এ প্রায় ১০০টা প্যান্ডেলে ঘুরেছিলাম। গত বছরও অনেকগুলোই! এক ফোঁটা বোর হইনি! বিভিন্ন শিল্পীর থিম দারুণ লেগেছে।”

নোলার টান মেলিন্ডার সোজা কথা, ভিন শহরে ঘুরে খেয়ে বেড়ানোটা কূটনীতিকের ধর্ম। “জলেবি আর অমৃতি, ফুচকা বা পানিপুরির ফারাক বোঝা ইন্টারেস্টিং ছিল। পার্ক স্ট্রিটের কুসুমের রোল খুব খেয়েছি! তবে সেরা রোলের দোকানগুলো তো অখ্যাত, তাই না?” ঝানু ক্যালকাটানের ভঙ্গিতে বললেন মেলিন্ডা। নির্ভেজাল বাঙালির মতো ‘অমৃতি’ উচ্চারণ করলেন। খেয়ে যা ভাল লাগবে পেট তাতে খুশি নাও হতে পারে এটাও বুঝেছেন মেলিন্ডা! রোল, ফুচকা, সন্দেশ, অমৃতি শব্দগুলিও তাঁর কাছে কলকাতার সমার্থক এখন ।

শেষ নয় শুরু কনসুলেটের কোনও এক আন্তঃধর্ম ইফতার আসরে এক মহিলা অভ্যাগতের কাছে শোনা গল্পেও চমৎকৃত মেলিন্ডা। সেই মহিলা অভ্যাগত বলেছিলেন, স্কুলের সহপাঠীদের সূত্রেই সব ক’টা প্রধান ধর্ম, কালচারের খুঁটিনাটি তাঁর মুখস্থ। মেলিন্ডা বলেন, “মিনেসোটায় আমাদের ক্যাথলিক স্কুলে বহুত্বের এই ধারণা শেখার সুযোগ পাইনি। ধর্মকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র বলে চিনলেই সম্পর্কের টেনশনগুলো হালকা হবে, কলকাতা এই বিশ্বাসটা মজবুত করেছে।”

অগস্টে কলকাতা ছাড়ার কথা মেলিন্ডার। বললেন, “আমি তো ভাবছি, কলকাতায় ঘাঁটি গেড়েই ভারতে যা দেখা হয়নি, তা ঘুরে দেখব! তবে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির সময়টাই এখানে থাকতে চাই! বিশ্রামও নেব, কিছু ক্রাফট শিখব।” আর পুজোয় অবশ্যই এ শহরে ফিরতে চান মেলিন্ডা। শেষ নয়, কলকাতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের এ যেন নতুন শুরু…

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement