ত্রিপুরায় বর্ষাকালটা বেশ বিপজ্জনক। অন্তত টুরিস্টদের পক্ষে। বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে দিব্যি পৌঁছে গেলেন আগরতলা, কিন্তু তার পর থেকে ধুম বৃষ্টি! হোটেলে বসেই কেটে গেল কয়েকটা দিন। তবে ত্রিপুরার বর্ষা বড্ড সুন্দরও বটে। আখৌরা, ছবিমুড়া, উদয়পুর— একের পর এক ‘স্পট’ দেখা যখন ভেস্তে যাচ্ছে, তখন নীরমহল দর্শন একেবারে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিল শুধু এই বর্ষাকালই। বৃষ্টির মরসুমে না এলে হ্রদের মাঝে এই প্রাসাদের মাহাত্ম্য বোঝাই যেত না!
নীরমহল! জলের মধ্যে বাড়ি বানালে এর চেয়ে সুন্দর নাম কীই বা হতে পারে? ১৯৩০ সালে তৎকালীন ত্রিপুরার রাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুরের আমলে তৈরি হয়েছিল এই প্রাসাদ। ইংরেজ কোম্পানি ‘মার্টিন অ্যান্ড বার্নস’কে প্রাসাদ তৈরির বরাত দিয়েছিলেন রাজা। নির্মাণকাজ চলেছিল প্রায় আট বছর। এত দিন সময় নিয়ে যে অপূর্ব স্থাপত্য তৈরি হয়েছিল, তা সত্যিই এক অতুল কীর্তি। কারণ গোটা পূর্ব ভারতে এমন ধরনের প্রাসাদ আর নেই। পশ্চিমে রাজস্থানের জয়পুর শহরের মান সাগর হ্রদে অবশ্য ‘জলমহল’ রয়েছে। তবে তা নীরমহলের চেয়ে ছোট। সৌন্দর্য আর ব্যাপ্তি, দু’দিক থেকে তাই এক নম্বরে নীরমহল।
ত্রিপুরার পশ্চিমাঞ্চলে গোমতী জেলার সদর শহর উদয়পুর। কিন্তু বৃষ্টির জন্য সেখানকার বিখ্যাত ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির (বা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির) দেখা হল না। গাড়ি নিয়ে রওনা হওয়া গেল মেলাঘর শহরের উদ্দেশে। সিপাহিজলার জেলার এই এলাকাটিকে গঞ্জ বলা চলে। দু’পাশে সবুজ চাষের জমি আর মাঝে মাঝে জঙ্গল পেরনোর পর এল মেলাঘরের বাজার এলাকা। বেশ জমজমাট। রাস্তায় যানজটও বেধে গিয়েছে। মানুষজন ব্যস্ত। সে সব পেরিয়ে গিয়ে একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল গাড়িটা। মিনিট দুয়েক চাকা গড়ানোর পরই অন্য জগৎ। বিরাট বড় এক হ্রদ, নাম রুদ্রসাগর। ঘাট থেকে দেখা গেল দূরে, হ্রদের ঠিক মাঝখানে ধবধবে সাদা রাজপ্রাসাদ। একটু আলংকারিক ভাবে বললে যে রঙের বর্ণনা দুগ্ধফেননিভ।
ঘাটের নাম রাজঘাট। বেশ বড়, বাঁধানো— দোতলায় বসার ব্যবস্থা, একতলায় বাজার, পাশে টিকিট কাউন্টার। তখন ঘড়ির কাঁটায় বিকেল চারটে। কাজেই চটপট টিকিট কেটে মোটরবোটে চেপে বসা গেল। জল কেটে বোট এগোতে লাগল আর প্রাসাদটা ক্রমশ কাছে আসতে শুরু করল। মিনিট দশেক পর প্রাসাদের ঘাটে যখন নামছি তখন মাঝি বেশ কড়া করে বলে দিলেন, “চল্লিশ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসবেন কিন্তু।” প্রাসাদের দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখা গেল সবুজ ঘাসের লন। রয়েছে বেশ কয়েক রকম ফুলগাছও। শীতকালে প্রচুর পাখিও আসে বলে শোনা গেল। এর দু’পাশে নানা মহল। মানে, জলের মাঝখানে হলেও রাজপ্রাসাদে যা যা দরকার, তার সবই আছে নীরমহলে।
রাজপরিবারের অন্দরমহলটা পশ্চিম দিকে। সেখানে পরপর বসার ঘর, শোওয়ার ঘর, নাচের ঘর, দাবা খেলার ঘর, স্নানের ঘর ইত্যাদি। সব মিলিয়ে ২৪টা ঘর। মাঝের বড় গোলাকৃতি ঘরটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এক দিকে ছোট বারান্দা, ঝুলে রয়েছে হ্রদের উপরে। অন্য দিকে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে জলে। মানে, ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাজা সোজা উঠে যেতেন নৌকোয়! প্রাসাদের পূর্ব দিকে খোলা মঞ্চ। সেখানে প্রায়ই নাটক, নাচ, গানের আসর বসত। পিছন দিকে বড় বাগান। স্থাপত্য পরিকল্পনার মতোই শৈলীও মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। শোনা যায়, মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর শিল্পের কদর জানতেন। নীরমহলের স্থাপত্যরীতিতে তাই মিশেছিল হিন্দু ও মুসলমান ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা। সেই ভাবনা রাজারই মস্তিষ্কপ্রসূত। এ বার ফেরার পালা। মাঝির ডাক পড়ার আগেই টিপটিপ করে বৃষ্টি নামল যে! আমরা তখন প্রাসাদের অপর প্রান্তে। মহলগুলোর গা ঘেঁষে প্রাকারের উপর দিয়ে পথ। জলের উপর ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে— দেখতে দেখতে এগোলাম। অবশেষে মাথাঢাকা বোটে উঠে নিজেদের রক্ষা করা গেল। ফেরার পথে হ্রদের মাঝখানে একটা বিশালাকৃতি মেশিন চোখে পড়ল। মাঝি জানালেন, ওটা ড্রেজিং মেশিন। দীর্ঘদিন ধরে দূষিত হয়েছে রুদ্রসাগর। তাকে পরিষ্কার করাটা একান্তই জরুরি হয়ে পড়েছে। পরে কয়েকটা ছবি দেখলাম। এবং ব্যাপারটা বোঝা গেল। ছবিতে শুকনো ডাঙার মাঝেই প্রাসাদ। যে ঘাটে নৌকো বাঁধা হল, ছবিতে সেখানে গরু চরছে! আর বুঝলাম বর্ষাকালের মাহাত্ম্য! এত বৃষ্টির ফলে হয়তো অনেক জায়গা দেখা হয়নি, কিন্তু রুদ্রসাগরের ভরন্ত চেহারাও তো সেই কারণে। অন্য সময় এলে হয়তো নৌকো থেকে নেমে হেঁটেই যেতে হত!
সন্ধে নামছে মেলাঘরে। আমাদের গাড়িও আগরতলার রাস্তা ধরল। এলাকার কোনও পাড়া থেকে হঠাৎ মনসামঙ্গলের সুর কানে এল। তাকে সঙ্গী করে সারারাত জলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকবে নীরমহল। পরদিনের পর্যটকের অপেক্ষায়।
টুকিটাকি
কী ভাবে যাবেন
•কলকাতা থেকে ফ্লাইটে আগরতলা পৌঁছনো যায় এক ঘণ্টায়
•আগরতলা থেকে মেলাঘরের দূরত্ব ৫৩ কিলোমিটার
•রুদ্রসাগরের পাড়ে রাজঘাট থেকে নৌকো করে নীরমহল পৌঁছতে লাগে ১০ মিনিট
কোথায় থাকবেন
•রুদ্রসাগরের পাড়েই রয়েছে টুরিস্ট লজ