স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি। সবাই যা ভাবছে তার চেয়ে আলাদা। সকলের চোখের সামনে যা রয়েছে, সেটাকেই এমন ভাবে উপস্থাপন করা, যা দেখে চমকিত দর্শক বলে উঠবেন, ‘এমন ভাবে তো ভাবিনি!’
‘আ ট্রু ভিশনারি’— এই একটাই কথা রোহিত বাল সম্পর্কে বারবার উঠে আসছে তাঁর বন্ধু, সহকর্মী, গুণমুগ্ধের মুখে। গত ১ নভেম্বর ৬৩ বছর বয়সে হদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গিয়েছেন ফ্যাশন ডিজ়াইনার রোহিত বাল। রেখে গিয়েছেন তাঁর ঐশ্বর্যমণ্ডিত লেগাসি।
গত ১৩ অক্টোবর দিল্লিতে ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের ফিনালে ডিজ়াইনার হিসেবে যখন তিনি মঞ্চে উঠলেন, তখনও তাঁর মুখে-চোখে অসুস্থতার ছাপ। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল গুড্ডার অ্যাটিটিউড। হ্যাঁ, ফ্যাশন ও বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিতে রোহিত ‘গুড্ডা’ নামেই পরিচিত। অন্যান্য বার যেমন ভাবে র্যাম্পে নাচতে নাচতে আসতেন, এ বারও তেমন ভাবে ছন্দ মেলানোর চেষ্টা করলেন। হয়তো ঠিক আগের মতো পারলেন না। কিন্তু তাঁর কালেকশন ‘কায়নাত- আ ব্লুম ইন দি ইউনিভার্স’ পেরেছে। রোহিতের অন্যতম সেরা সৃষ্টি হিসেবে থেকে যাবে তাঁর শেষ কাজ।
ফিনালে শোস্টপার অনন্যা পাণ্ডেকে তিনি পরিয়েছিলেন কালো ভেলভেটের লেহঙ্গা, যার উপরে বড় বড় মোটিফের লাল গোলাপ। উপরের শর্ট কেপেও গোলাপের মোটিফ। প্রাকৃতিক মোটিফ রোহিতের সিগনেচার, যা এখন তামাম ফ্যাশন দুনিয়া অনুসরণ করে চলেছে। তাঁর এ বারের কালেকশন একাধারে ম্যাক্সিম্যালিস্ট এবং মিনিম্যালিস্ট। ভেলভেট, সিল্কের তৈরি বড় ঘেরের লেহঙ্গা, লং ড্রেস, আনারকলি বা পুরুষদের ছোট, বড় ঝুলের জ্যাকেট জুড়ে রং আর কারুকাজের বাহার। পোশাকে যেন একটা আস্ত বাগান উঠে এসেছে। টিয়া, ময়ূরের মতো রোহিতের পছন্দের মোটিফের সঙ্গে হরিণ ও হাতি গুরুত্ব পেয়েছে নতুন কালেকশনে। লাল, মেরুন, কালো, আইভরি রঙের ক্যানভাস জুড়ে শিল্পের উৎসব। পোশাকের বাহুল্য ছিল না মডেলদের মেকআপে। সেখানে ছিমছাম সাজ। টানটান করে বাঁধা চুলে হয়তো কয়েকটা গোলাপ। কাউকে আবার পরিয়েছিলেন তাঁর পছন্দের কাশ্মীরি টুপি।
রোহিতের ডিজ়াইনে বরাবর গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর ভালবাসার কাশ্মীর। ১৯৬১তে শ্রীনগরে কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারে তাঁর জন্ম। সত্তরের দশকের গোড়ায় তাঁর পরিবার দিল্লি চলে আসে। সেখানেই রোহিতের স্কুল-কলেজ। কিন্তু বুকের মধ্যে কাশ্মীরকে বয়ে নিয়ে চলেছেন আজীবন। জন্নতের রূপ-রস ফুটে উঠেছে তাঁর ডিজ়াইনে। কত শোয়ে কাশ্মীরি মেয়েদের মতো করে গয়না পরিয়েছেন মডেলদের। ছেলেদের জ্যাকেটে উঠে এসেছে সোনালি জরির কারুকাজে তৈরি চিনার পাতা। উর্দু শায়েরি, লোককথার প্রভাব ছিল তাঁর ডিজ়াইনে। কাশ্মীরি গালিচার নকশা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েও ডিজ়াইন করেছেন। রোহিতের কাজে কাশ্মীরের প্রভাব থাকলেও সারা দেশের শিল্প বৈচিত্র উঠে এসেছিল তাঁর সৃষ্টিতে। বলতেন, ‘শাড়ি হল সেরা কুতুর।’ করসেট বা জ্যাকেটের সঙ্গে শাড়িকে মিলিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির পাশ্চাত্যকরণ করেছিলেন, যা আজ ট্রেন্ডিং।
ভারতীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির গোড়াপত্তনের অন্যতম কারিগর বলা হয় রোহিতকে। ’৮৬ সালে ভাই রাজীব বালের সঙ্গে নিজের ফ্যাশন লেবেল শুরু করেছিলেন। ওই বছরই চালু হয়েছিল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজি (নিফট)। সেখানকার প্রথম ব্যাচের এই ছাত্র আশির দশকেই বুঝে গিয়েছিলেন শিল্প ও ব্যবসার মধ্যে যোগসূত্রের প্রয়োজনীয়তা। বিদেশি ব্র্যান্ডের পাশাপাশি খাদি-সহ একাধিক দেশজ ব্র্যান্ডের সঙ্গে কোলাবরেট করেছেন তিনি। বলিউডের অভিনেতা, ক্রিকেটার, রাজনীতিবিদ... রোহিতের পোশাকে সেজেছেন। সোনম কপূর একাধিক বার তাঁর শোস্টপার হয়েছেন। রোহিতকে ট্রিবিউট দিতে দীপাবলিতে সোনম বেছে নিয়েছিলেন ডিজ়াইনারের বিভিন্ন কালেকশন।
দিলখোলা স্বভাবের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন গুড্ডা। পার্টি করতে ভীষণ ভালবাসতেন। দিল্লি, নয়ডায় তাঁর দেওয়া পার্টির নানা রঙিন গল্প এই ক’দিনে উঠে এসেছে বিভিন্ন জনের স্মৃতিচারণায়। তাঁর মৃত্যুতে যে ফ্যাশন দুনিয়ার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল, সে কথা ফুটে উঠেছে মণীশ মলহোত্র, অনামিকা খন্নার লেখায়।
রোহিতের সবচেয়ে পুরনো সহকর্মী, প্রতিদ্বন্দ্বী তরুণ তহিলিয়ানির কথাতেইপাওয়া যায় ডিজ়াইনারের মনমর্জির হদিস। তরুণ বলছেন, ‘‘ও যখন পার্টি করত, সবাইকে ছাপিয়ে যেত। যখন কাজ করত তখনও...’’