Satyendra Nath Bose

বিজ্ঞানে এক একলব্য

বিজ্ঞানী হিসেবে তো তিনি জগদ্বিখ্যাত। কিন্তু মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু? বিজ্ঞানের এই মহান সাধককে নিয়ে লিখছেন পথিক গুহবিজ্ঞানী হিসেবে তো তিনি জগদ্বিখ্যাত। কিন্তু মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২০ ০০:০১
Share:

আবার তিনি সংবাদের শিরোনামে। ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন’ (আইএসএস) নামে যে কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে চলেছে বাইশ বছর ধরে, তাতে সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এক চমকপ্রদ পরীক্ষায় সফল হয়েছেন! কী করেছেন ওঁরা? পদার্থের পঞ্চম অবস্থা তৈরি করেছেন। পঞ্চম অবস্থা? হ্যাঁ, তা-ই। পদার্থের তিন অবস্থার কথা আমরা সকলে জানি। কঠিন, তরল ও গ্যাসীয়। বরফ, জল আর বাষ্প। যেমন লোহা। রুম টেম্পারেচারে কঠিন। ১৫৩৮ ডিগ্রির উপরে কিন্তু তা তরল। সে তরল ফুটিয়ে ২৮৬২ ডিগ্রির উপরে নিয়ে গেলে তা বাষ্প। এ হল লোহার তিন দশা। এর বাইরে এক দশা আছে, যার নাম প্লাজ়মা। যা মেলে অনেক, অ-নে-ক বেশি তাপমাত্রায়। প্লাজ়মা দশায় লোহার পরমাণু থেকে অনেক ঋণাত্মক তড়িৎবিশিষ্ট ইলেকট্রনের কণার মধ্যে কয়েকটি কণা খসে পড়ে। ফলে লোহার পরমাণু তখন ধনাত্মক তড়িৎবিশিষ্ট। তখন ধনাত্মক তড়িৎবিশিষ্ট লোহার পরমাণু এবং ঋণাত্মক তড়িৎবিশিষ্ট ইলেকট্রন কণা পাশাপাশি প্রবল বেগে ছোটাছুটি করতে থাকে। এ হল লোহার প্লাজ়মা দশা, চতুর্থ অবস্থা।

Advertisement

আর পঞ্চম? সে দশায় পদার্থের অবস্থা অভিনব। সবচেয়ে কম ঠান্ডা কোন তাপমাত্রা ? না কি কম উষ্ণতার কোনও শেষ নেই, কোনও কিছুকে চাইলে যত খুশি ঠান্ডা করা যায় ? নাহ, ঠান্ডার একটা সীমারেখা আছে। আর সেটা হল মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কোনও কিছুকে ওই মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম ঠান্ডা করা যায় না। হাজার চেষ্টা করলেও না। সে কারণে ওই মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে বলা হয় চরম শূন্য উষ্ণতা। এখন উষ্ণতা মানে পদার্থের অণু-পরমাণুর ছোটাছুটি। যত বেশি তাপমাত্রা, তত বেশি দৌড়াদৌড়ি। চরম শূন্য উষ্ণতায় নিয়ে যেতে পারলে পদার্থের অণু-পরমাণু স্ট্যাচু। নট নড়ন-চড়ন। একেবারে চরম শূন্য উষ্ণতায় কোনও পদার্থকে নিয়ে যাওয়া যায় না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চরম শূন্য উষ্ণতার খুব— খু-উ-ব কাছে। কত কাছে ? ১ সেলসিয়াসের ১,০০০,০০০,০০০ ভাগের কয়েক ভাগ কাছে। চরম শূন্য উষ্ণতার অত কাছে নিয়ে যেতে পারলে কোনও কোনও পদার্থের অণু-পরমাণুর ওই পঞ্চম দশা দেখা যায়।

পদার্থের পঞ্চম অবস্থা যে অভিনব, তা আগে বলেছি। কেমন বিচিত্র, তা ব্যাখ্যা করা যাক। সে ব্যাখ্যার আগে এটা বলা দরকার যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এই ধরনের নিয়মকানুন মেনে কাজকর্ম হয়। বড়সড় বস্তুর বেলায় কাজ করে গ্র্যাভিটি, যার নিয়ম বলে গিয়েছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। আর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুর বেলায় খাটে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। যার বিচিত্র নিয়মাবলি একজন নয়, অনেক বিজ্ঞানী মিলে আবিষ্কার করেছেন গত শতাব্দীতে। পদার্থের পঞ্চম দশায় কোয়ান্টামের ওই সব অদ্ভুতুড়ে ভেলকিবাজি দেখা যায়। সে জন্য ওই দশা ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীরা তৈরি করার জন্য মুখিয়ে থাকেন। কেমন ভেল্কি ? এই যেমন পঞ্চম দশায় পদার্থ পাত্রের গা-বেয়ে উঠে আপনাআপনি পাত্রের বাইরে চলকে পড়তে পারে। তড়িৎ পরিবহণে সব পদার্থই কমবেশি বাধা দেয়। পদার্থের ওই পঞ্চম দশায় প্রায় বিনা বাধায় তা বিদ্যুৎ পরিবহণ করে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, পঞ্চম দশায় পদার্থের অনেক পরমাণু একাকার হয়ে সুপার-অ্যাটম এ পরিণত হয়। সুপার-অ্যাটম মানে অনেক পরমাণু, কিন্তু তারা একই জায়গা দখল করে থাকে।

Advertisement

পঞ্চম দশায় পদার্থের এমন সব কোয়ান্টাম ভেলকি দেখা যায় বলেই, বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছিলেন তা ল্যাবরেটরিতে বানিয়ে ফেলার। অনেক সাধ্যসাধনার পরে আমেরিকার কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বিজ্ঞানী এরিক কর্নেল এবং কার্ল ওয়াইম্যান ওঁদের ল্যাবরেটরিতে এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-র হোলফগাং কেটারলি তাঁর ল্যাবরেটরিতে ১৯৯৫ সালে পদার্থের ওই পঞ্চম দশা বানিয়ে ফেলেন। এ এক এত বড় সাফল্য যে, ২০০১ সালেই ফিজ়িক্সে নোবেল প্রাইজ় দেওয়া হয় ওঁদের।

সব কিছু তো চুকেবুকে যাওয়ার কথা ২৫ বছর আগে। তার পরেও কেন পৃথিবী-প্রদক্ষিণকারী ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে মহাশূন্যে পদার্থের পঞ্চম দশা তৈরি করার চেষ্টা ? হ্যাঁ, এ-ই হল বিজ্ঞান। শেষ হইয়াও হইল না শেষ! পৃথিবীতে পরীক্ষাগারে পদার্থের পঞ্চম দশা তৈরি করায় বড় বাধা গ্র্যাভিটি। পৃথিবীর টান। যা অণু-পরমাণুর ক্রিয়া করে। ফলে ওই পঞ্চম দশা তৈরি করলেও তা হয় ক্ষণস্থায়ী। টেকে মাত্র এক সেকেন্ডের লক্ষ কোটি ভাগের এক ভাগ সময়। মহাশূন্যে গ্র্যাভিটি প্রায় নেই বললেই চলে। তাই ওখানে পঞ্চম দশা তৈরি করার সাধ বিজ্ঞানীদের। ওই সাধ থেকে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ১০ কোটি ডলার খরচ করে বানিয়েছিল কোল্ড অ্যাটম ল্যাব। ওই পরীক্ষাগারে পদার্থের যে পঞ্চম দশা তৈরি করা গিয়েছে, তা টিকেছে এক সেকেন্ড। কোল্ড অ্যাটম ল্যাবে যে দশা তৈরি হল, বিজ্ঞানে তার নাম ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট’ বা ‘বোস কনডেনসেট’।

কে এই বোস? অবশ্যই সত্যেন্দ্রনাথ বসু। বিশ্ববিজ্ঞানে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। পদার্থবিদ্যায় এক অবিস্মরণীয় নাম। আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণা ভারতে আনার এক ভগীরথ। জন্মতারিখ (১ জানুয়ারি ১৮৯৪) হিসেবে যাঁর ১২৫ বছর পূর্ণ হল গত বছর। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে নাসার বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা প্রমাণ করছে, এখনও তিনি প্রাসঙ্গিক।

বাবা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ, মা আমোদিনী। ঠাকুরদা অম্বিকাচরণ। ভিটে নদিয়া জেলার বড় জাগুলিয়া গ্রামে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নদিয়া ছিল প্রাচ্যবিদ্যার অন্যতম অধ্যয়ন কেন্দ্র। তার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষায় মন দেয় বসু পরিবার। ফল হাতেনাতে। অম্বিকাচরণ চাকরি পান ইংরেজ সরকারি দফতরে। বদলির চাকরি ছিল তাঁর। দেশের নানা জায়গায় বদলি হতে হত। মেরঠ শহরে অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদে চাকরিকালীন জীবনাবসান।

অম্বিকাচরণ মারা যাওয়ার পরে বসু পরিবার বড় জাগুলিয়া ছেড়ে কলকাতায় আসে। কলকাতাই যে গন্তব্য হবে, তা বুঝেছিলেন অম্বিকাচরণের বাবা। বাড়িও একটা কিনে রেখেছিলেন হেদুয়ার কাছে ঈশ্বর মিল লেনে। কিন্তু সে বাড়ির ভাড়াটেরা অন্যত্র চলে যেতে না চাওয়ায় বসু পরিবার উঠলেন জোড়াবাগানে ভাড়াবাড়িতে। অম্বিকাচরণের মতো সুরেন্দ্রনাথও ইংরেজি শিখে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের অ্যাকাউন্ট্যান্ট। অগাধ পড়াশোনা তাঁর। এক দিকে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য দর্শন, অন্য দিকে তেমনই মার্কস-এঙ্গেলসের রচনা। সে মানুষটাই আবার ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়র্কস-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের হাতে গড়া বেঙ্গল কেমিক্যালের সমসাময়িক এ কোম্পানি। সুরেন্দ্রনাথের বিয়ে হয় ডাকসাইটে উকিল মতিলাল রায়চৌধুরীর মেয়ে আমোদিনীর সঙ্গে। তাঁদের সাত সন্তান। ছ’টি মেয়ে, এক ছেলে। ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ সকলের বড়।

বাবা সুরেন্দ্রনাথ টের পেয়েছিলেন, তাঁর প্রথম সন্তান বিশেষ মেধাবী। সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল তো বটেই, গণিতেও। বালকের মধ্যে ওই বিষয়ে ব্যুৎপত্তি দেখে সুরেন্দ্রনাথ তা আরও বাড়াতে প্রয়াসী হলেন। অফিসে বেরোনোর আগে তিনি কঠিন কঠিন অঙ্ক দিয়ে যেতেন সত্যেন্দ্রনাথকে। হোম টাস্ক। বালকের কাজ ছিল দুপুরবেলায় সিমেন্টের মেঝেতে চক দিয়ে সে-সব অঙ্কের সমাধান বার করা। বালকের কাছে খেলা।

পাঁচ বছর বয়স হলে সত্যেন্দ্রনাথকে ভর্তি করে দিলেন নর্মাল স্কুলে। এ সেই শিক্ষায়তন, যেখানে কিছু দিন পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সুরেন্দ্রনাথ বাসস্থান বদলালে সেখান থেকে সত্যেন্দ্রনাথ ভর্তি হন নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে। সুরেন্দ্রনাথের মন ভরল না। ছেলে প্রচণ্ড মেধাবী, তার জন্য আরও ভাল স্কুল চাই। অবশেষে হিন্দু স্কুল। ছোটবেলা থেকেই দৃষ্টিশক্তির সমস্যা। সত্যেন্দ্রনাথ তাতে দমে যাওয়ার ছাত্র নয়। পাঠ্য বইয়ের বাইরেও পড়ার বিরাম নেই। মেধাবী ছাত্র, সব মাস্টারমশাইয়ের প্রিয়। ওঁকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন অঙ্কের স্যর উপেন্দ্রনাথ বক্সী। একবার তো অঙ্কের পরীক্ষায় তিনি ওঁকে ১০০ নম্বরের মধ্যে ১১০ দিয়ে বসলেন। ব্যাপার কী? হেডমাস্টার রসময় মিত্রের প্রশ্নের উত্তরে উপেন্দ্রনাথ জানালেন, ছাত্রটি ১০০ নম্বরের সব প্রশ্নের সমাধান তো করেছেই, উপরন্তু বিকল্প সব প্রশ্নেরও উত্তর বার করেছে। প্রিয় ছাত্র সম্পর্কে শিক্ষকের ভবিষ্যদ্বাণী, ও একদিন ফরাসি পিয়ের সিমো লাপ্লা কিংবা অগাস্টিন লুই কাউচির মতো প্রাতঃস্মরণীয় গণিতজ্ঞ হবে!

১৯০৮। সত্যেন্দ্রনাথের এন্ট্রান্স অর্থাৎ স্কুলের শেষ পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরুর ঠিক দু’দিন আগে বিপত্তি। সত্যেন্দ্রনাথের বসন্ত রোগ। পরীক্ষায় বসা হল না। বসলেন পরের বছর। হলেন পঞ্চম। সংস্কৃত, ইতিহাস, ভূগোলে নম্বর খুব ভাল। কিন্তু তিনি পড়বেন বিজ্ঞান। ভর্তি হলেন রাস্তার ও পারের কলেজ প্রেসিডেন্সিতে। সহপাঠী কারা ? এক-একটি উজ্জ্বল রত্ন! জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নিখিলরঞ্জন সেন, পুলিনবিহারী সরকার, মানিকলাল দে, শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ, অমরেশ চক্রবর্তী। দু’বছর পরে যোগ দেন আর এক রত্ন। মেঘনাদ সাহা। ১৯০৯-এ যাঁরা প্রেসিডেন্সি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হলেন, তাঁদের সম্পর্কে কলেজের কেমিস্ট্রি প্রফেসর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থে পরে লেখেন, ‘সেই স্মরণীয় বছরে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হইল একঝাঁক মেধাবী ছাত্র, যাঁহারা পরবর্তীকালে গবেষণায় উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব অর্জন করিয়াছিল।’

স্ত্রী ঊষাবতীর সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ

তখন কলকাতা শহর উত্তাল। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা ঘিরে। চার দিকে স্বদেশী হাওয়া। ছাত্ররা যুবকরা আন্দোলনে দলে দলে যোগ দিচ্ছে। কেউ কেউ পড়াশোনা ছেড়ে। এ দিকে বাবার কড়া নির্দেশ, আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়ে ব্রিলিয়ান্ট কেরিয়ার মাটি করা চলবে না। সত্যেন্দ্রনাথ আন্দোলনে মদত জোগালেন পরোক্ষে। কখনও বিপ্লবীদের গোপন চিঠির কুরিয়ারের কাজ করে, কখনও বা পুলিশ যাঁদের খুঁজছে, তাঁদের লুকিয়ে রেখে। পাশাপাশি চলতে লাগল গরিব সন্তানদের নাইট স্কুলে পড়ানো। কারণ, মনে আছে এক প্রত্যয়। দেশের প্রকৃত নাগরিক তৈরি করতে প্রয়োজন শিক্ষা। ১৯১৩-য় বিএসসি, ১৯১৫-য় এমএসসি। দু’টি পরীক্ষাতেই সত্যেন্দ্রনাথ ফার্স্ট, মেঘনাদ সেকেন্ড। তার পর ? বেকার। ও দিকে, মায়ের কথায় এমএসসি-র ছাত্রাবস্থায় কুড়ি বছর বয়সে ঊষাবতী ঘোষকে বিয়ে। তিনি নামী ডাক্তার যোগীন্দ্রনাথ ঘোষের একমাত্র মেয়ে। যোগীন্দ্রনাথ জামাই বাবাজিকে সাহায্য করতে চান। সত্যেন্দ্রনাথ অরাজি। অথচ তখন কেমন দিন? ধনী হবু-শ্বশুরেরা মেধাবী ছাত্রদের নিজের টাকায় ইংল্যান্ডে পাঠাচ্ছেন। যাতে সে ছাত্র আইসিএস পাশ করে দেশে ফিরে মেয়েকে বিয়ে করে। সত্যেন্দ্রনাথের সে সবে রুচি নেই। তিনি পিএইচডি করবেন। কার অধীনে? গণেশ প্রসাদ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে এনেছেন বারাণসী থেকে। এমএসসি-র পেপার সেটার। কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতে পছন্দ করেন। ছাত্ররা উত্তর দিতে না পারলে যা-তা বলে দেন। ছাত্রদের মাস্টারমশাইদেরও নিন্দে করেন। সত্যেন্দ্রনাথ গণেশ প্রসাদের সঙ্গে দেখা করলে, তিনি এই ছাত্রের মাস্টারমশাইদেরও নিন্দে করলেন। সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে বচসা হল। পিএইচডি করা হল না।

সত্যেন্দ্রনাথ আর মেঘনাদ গিয়ে দেখা করলেন স্যর আশুতোষের সঙ্গে। এমএসসি ক্লাসে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান—যা পাশ্চাত্য মাতাচ্ছে—তার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে না ছাত্ররা। সে সব পড়ানোর শিক্ষক নেই। সদ্য পাশ করা এমএসসি যুবকরা আধুনিক পদার্থবিদ্যা পড়াতে চান। স্যর আশুতোষ রাজি। মাইনে মাসে ১২৫ টাকা। মেঘনাদ পড়াবেন কোয়ান্টাম থিয়োরি। আর সত্যেন্দ্রনাথ রিলেটিভিটি। টেক্সট বই কোথায় ? কোথায় রিসার্চ জার্নাল? প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বাজারে ভারতে দুটিই অমিল। কিছুটা হলেও তা পাওয়া গেল শিবপুরে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রফেসর পি জে ব্রুলের কাছে। ভদ্রলোক জার্মানি থেকে ভারতে এসেছিলেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানী। ভারতের গাছগাছড়া নিয়ে গবেষণা করতে চাইছিলেন। যক্ষ্মারোগে কাবু হওয়ার পরে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ হলে, বিষয় বদলে ইঞ্জিনিয়ারিং ফিজ়িক্সে চলে আসেন। ওঁর কাছে ছিল ম্যাক্স প্লাংক, লুডভিগ বোল্টজমান, উইলহেলম ভিয়েনের লেখা বই। সে সব পড়ে বোঝার জন্য মেঘনাদ এবং সত্যেন্দ্রনাথ শিখলেন জার্মান। ১৯১৯। জেনারেল রিলেটিভিটি নিয়ে সারা পৃথিবীতে হইচই। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে ধন্যি ধন্যি। সত্যেন্দ্রনাথ আর মেঘনাদ মিলে স্পেশাল এবং জেনারেল রিলেটিভিটির মূল পেপারগুলির একত্রিত অনুবাদ প্রকাশ করলেন ইংরেজি ভাষায়। বিশ্বে প্রথম।

১৯২১। গড়া হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ফিজ়িক্সে রিডার পদে চাকরি পেলেন সত্যেন্দ্রনাথ। ওখানে ছাত্র পড়াতে পড়াতেই ১৯২৪ সালে তাঁর সেই জগদ্বিখ্যাত পেপার। ‘প্লাংক’স ল অ্যান্ড লাইট কোয়ান্টাম হাইপোথিসিস’। প্রবন্ধটির ইতিহাস বড় বিচিত্র। বিশেষ ধরনের বস্তু থেকে তাপ বা এনার্জি বিকিরণের এক ফর্মুলা আবিষ্কার করেন ম্যাক্স প্লাংক। ফর্মুলাটি অনেকের মনঃপূত হয়নি। অনেকে ওটি শোধরানোর চেষ্টা করেন। সত্যেন্দ্রনাথ প্লাংকের মতো সাবেক ধারণার সাহায্য না নিয়ে, নতুন পন্থায় এনার্জি বিকিরণের ফর্মুলা উদ্ভাবন করেন। পেপারটি সত্যেন্দ্রনাথ প্রথমে পাঠালেন ব্রিটিশ জার্নাল ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিন-এ। পাঠিয়ে ছাপার জন্য অপেক্ষা করলেন ছ’মাস। ছ’মাস পরে চিঠি এল জার্নাল থেকে। বিশেষজ্ঞরা বাতিল করেছেন পেপার। এর পর মরিয়া হয়ে যে কাজটি করলেন সত্যেন্দ্রনাথ, তা অভিনব। ১৯২৪ সালের ৪ জুন বাতিল পেপারটি সরাসরি পাঠালেন স্বয়ং আইনস্টাইনের বার্লিনের ঠিকানায়। সঙ্গে এই চিঠি— ‘আপনার পড়ে দেখার ও মতামত জানার প্রত্যাশায় সঙ্গের নিবন্ধটি পাঠাতে প্রয়াসী হলাম।... আমি যথেষ্ট জার্মান জানি না বলে পেপারটি জার্মানে অনুবাদ করতে পারলাম না। আপনি যদি এটা ছাপার যোগ্য বিবেচনা করেন, তবে ‘ৎজাইৎটশ্রিফট ফুর ফিজিক’-এ ছাপার ব্যবস্থা করে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।... যদিও আপনার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত, তবু আপনাকে এ অনুরোধ করতে আমি দ্বিধা বোধ করছি না। কারণ আমরা সকলে আপনার ছাত্র। আপনার লেখাপত্র পড়েই আমরা উপকৃত হয়েছি। জানি না, এখনও আপনার মনে আছে কি না যে, কলকাতা থেকে একজন আপনার অনুমতি চেয়েছিল রিলেটিভিটি বিষয়ে আপনার লেখা পেপারগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ করার। আপনি অনুরোধে রাজি হয়েছিলেন। বইটি প্রকাশিত হয়েছে। আমিই জেনারেল রিলেটিভিটি বিষয়ে লেখা আপনার পেপারটি অনুবাদ করেছিলাম।’

জহুরি জহর চেনে। তড়িঘড়ি চিঠির উত্তর দিলেন আইনস্টাইন। লিখলেন, আমি আপনার পেপারটি অনুবাদ করে ‘ৎজাইৎটশ্রিফট ফুর ফিজিক’-এ ছাপতে পাঠিয়েছি। ওটা এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি, আমি দারুণ খুশি। আর ‘ৎজাইৎটশ্রিফট ফুর ফিজিক’-এ ছাপা পেপারের সঙ্গে আইনস্টাইন নিজের যে মন্তব্য জুড়ে দেন, তা এ রকম— ‘বসুর উদ্ভাবন আমার মতে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এখানে যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে, তা দিয়ে আদর্শ গ্যাসের কোয়ান্টাম থিওরিতে পৌঁছনো যায়। আমি তা অন্যত্র দেখাব।’ সত্যিই সত্যেন্দ্রনাথের পেপার পাওয়ার হপ্তাখানেকের মধ্যে আইনস্টাইন এক পেপার পেশ করলেন প্রুশিয়ান আকাদেমি অব সায়েন্সেস-এ, যা সত্যেন্দ্রনাথের ওই বিখ্যাত প্রবন্ধের পরবর্তী ধাপ। ওই পেপারের সূত্রে পরের বছর ১৯২৫ সালে আরও দু’-দুটি পেপার লিখলেন আইনস্টাইন। যার মধ্যে দ্বিতীয়টিতে ওই বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট-এর আইডিয়া এসে গেল।

সত্যেন্দ্রনাথ প্লাংকের সূত্র উদ্ভাবন করতে গিয়ে নতুন পথ খুঁজেছিলেন। নতুন সংখ্যায়ন প্রয়োগ করেছিলেন। এ সংখ্যায়নের এক বড় দিক হল, আলোককণা একটা আর একটার থেকে আলাদা নয়। হুবহু এক। তা হলে ওদের গোনার হিসেব পাল্টাতে বাধ্য। এই নতুন সংখ্যায়ন আইনস্টাইন প্রয়োগ করলেন বস্তুকণার ক্ষেত্রে। যা বেরিয়ে এল, তা বসু-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন। বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিকস। অন্য এক রকম স্ট্যাটিস্টিকসের প্রবর্তন করেছিলেন এনরিকো ফের্মি এবং পল অ্যাড্রিয়েন মরিস ডিরাক। তার নাম ফের্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিকস। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত কণা আছে, তার সবই ওই দুই সংখ্যায়নের কোনও একটাকে মানতে বাধ্য। দুই সংখ্যায়নের বাইরে কোনও কণা থাকতে পারে না। যে সব কণা বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিকস মানে, তারা হল বোসন। অন্য সব কণা ফের্মি-ডিরাক স্ট্যাটিসটিকস মেনে চলে। তাদের বলে ফের্মিয়ন। বোসন কণারা এক জায়গায় ঠাসাঠাসি করে থাকতে পারে। ফের্মিয়নরা তা পারে না। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সস্ত্রীক ডিরাক এসেছিলেন কলকাতায়। এক বক্তৃতার পরে ফিরছিলেন হোটেলে। গাড়িতে পিছনের সিটে ডিরাক এবং তার স্ত্রী। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে সত্যেন্দ্রনাথ। তিনি এক ছাত্রকে ডাকলেন তাঁর পাশে বসতে। ডিরাক শশব্যস্ত। সামনের সিটে চাপাচাপি হবে দেখে। তা দেখে সত্যেন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ‘উই বিলিভ ইন বোস স্ট্যাটিস্টিকস!’

নাহ, নোবেল প্রাইজ় জোটেনি তাঁর। দুই স্ট্যাটিস্টিকসে মোট চার জন। বাকি তিন জন—আইনস্টাইন, ফের্মি এবং ডিরাক ওই পুরস্কার পেলেও, তিনি ওই পুরস্কার থেকে বাদ! যেমন জোটেনি সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু মেঘনাদের। এ ব্যাপারে ওঁরা দু’জন আর এক সমসাময়িক চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামনের চেয়ে একেবারে আলাদা। রামন জানতেন, বড় আবিষ্কার শুধু করলেই হয় না, কী ভাবে তার স্বীকৃতিও আদায় করে নিতে হয়। শিল্পপতি ঘনশ্যাম দাস বিড়লার কাছে স্পেক্টোগ্রাফ যন্ত্র কেনার টাকা চেয়েছিলেন এই যুক্তিতে যে, তা হলে তিনি ভারতকে নোবেল প্রাইজ় এনে দেবেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর আবিষ্কারের পেপার তিনি ‘নেচার’ জার্নালে ছাপাতে পাঠিয়েছিলেন টেলিগ্রাম করে। পাছে তাঁর পেপার ছাপার আগে অন্যদের পেপার না ছাপা হয়ে যায়! ইংরেজিতে যাকে বলে অ্যাগ্রেসিভনেস, তা সত্যেন্দ্রনাথের চরিত্রে ছিল না।

১৯২৪ সালের অক্টোবরে দু’বছরের স্টাডি লিভ-এ বিদেশে গিয়েছিলেন তিনি। সাধ ছিল আইনস্টাইনের অধীনে গবেষণার। হায়, যিনি জীবনে কখনও পিএইচডি ছাত্র নেননি, তাঁর অধীনে গবেষণা! প্যারিসে কয়েক জনের ল্যাবরেটরিতে কাজ করে এবং বার্লিনে কয়েক জনের সুখ্যাতি পেয়ে ফিরতে হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথকে। চিঠিপত্রে তিনি বারবার আইনস্টাইনকে ‘মাস্টার’ বলে সম্বোধন করতেন। ডিড দ্য মাস্টার লেট হিম ডাউন ? প্রশ্নটা বারবার উঠেছে। সত্যেন্দ্রনাথের একমাত্র জীবিত ছাত্র বিজ্ঞানী পার্থ ঘোষ এ ব্যাপারে বলেছেন, ‘আইনস্টাইন এমন পদক্ষেপ করেছিলেন, যা বিজ্ঞানের জগতে নজিরবিহীন। সত্যেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পেপারে আইনস্টাইন (যা তিনি জার্মানে অনুবাদ করে ছাপান) জুড়ে দেন এক ফুটনোট। সত্যেন্দ্রনাথকে না জানিয়েই। ওই ফুটনোটে আইনস্টাইন লেখেন, বসুর নতুন সম্ভাব্যতা সূত্র (যা বসু সংখ্যায়ন থেকে আলাদা) ভুল! ওই ফুটনোট সহযোগেই ছাপা হয় পেপার। ওই মন্তব্য প্রায় পেপারটিকে হত্যা করার শামিল!’

এই প্রসঙ্গে নিজের এক অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন পার্থ। বললেন, ‘একদিন স্যরের বাড়ি গিয়েছি। তিনি আমাকে বললেন, এক গোপন কথা শোনাবেন। কী ? আমি উৎসুক। স্যর বন্ধ করলেন দরজা-জানালা। তার পর আমাকে ফিসফিস করে বললেন, আজ তোকে যা বলছি, তা আর কাউকে বলিস না। কথা দিলাম যে, আমি কাউকে তা বলব না। কিন্তু কী ব্যাপার? স্যরের আবিষ্কৃত সংখ্যায়নে একটা সংখ্যা (৪) এসেছিল। সেটা হবে ৮। কেন হবে, তার ব্যাখ্যাও স্যর দিয়েছিলেন। হবে এ কারণে যে, আলোককণার স্পিন (ঘূর্ণনের মতো একটা ব্যাপার) আছে। এখন, আলোককণা ঘুরতে পারে দু’ভাবে। এক, আলোককণা যে দিকে ছুটছে, সে দিকেই ঘোরা। দুই, যে দিকে ছুটছে, তার উল্টো দিকে ঘোরা। তাই ৪-এর বদলে ৮ (৪x ২)। স্যরের বিখ্যাত পেপারটি দেখার পর আইনস্টাইন তা পাল্টে দেন। স্যর আমাকে বললেন, বুড়ো ওটা কেটে দিলে। পরে আলোককণার স্পিন পরীক্ষায় ধরা পড়ে। আমি স্যরকে বললাম, আলোককণার স্পিন ধরা পড়ার পর কেন আপনি আইনস্টাইনকে বললেন না যে, আপনিই ঠিক! তা হলে তো আলোককণার স্পিনের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য আপনার কৃতিত্ব স্বীকৃত হত। স্যর উত্তরে বললেন, কে বার করেছে তাতে কী যায়-আসে রে? বেরিয়েছে তো! এই হলেন সত্যেন্দ্রনাথ।’

পার্থ যোগ করেন, ‘অনেকে ভাবতে পারেন আজ এ সব কথা বলে আমি সে দিন স্যরকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা ভেঙেছি। তা হয়তো ভেঙেছি। তবে প্রতিজ্ঞাভঙ্গের কারণও আছে। পরে দেখেছি, স্যর তাঁর পেপারে যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং আমার প্রতিজ্ঞা অর্থহীন। স্যর যে দিন আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন, তার অনেক বছর পরে আমি কাল্টিভেশন অব সায়েন্সেস-এর লাইব্রেরিতে বসে জার্নাল ঘাঁটছিলাম। হঠাৎ আমার হাতে এল ১৯৩১ সালে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিকস’-এ সি ভি রামন এবং এস ভগবন্তমের লেখা এক পেপার। ওই জুটি ব্যাখ্যা করেছেন আলোককণার স্পিনের পরীক্ষামূলক প্রমাণ। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, এ পেপার কি স্যর দেখেননি ? এ পেপার প্রকাশিত হওয়ার পরেও তো স্যর আইনস্টাইনকে বলতে পারতেন যে—আইনস্টাইন নন, তিনিই ঠিক। আসলে কী জানেন, স্যর প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন আইনস্টাইনকে।’

হ্যাঁ, তা ঠিক। ওই শ্রদ্ধাকে বিজ্ঞানী অমলকুমার রায়চৌধুরী তুলনা করেছিলেন মহাভারতে বর্ণিত একলব্যের গুরু দ্রোণাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে। নোবেল প্রাইজ় সত্যেন্দ্রনাথ না পেতে পারেন। তবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে দু’জাতের মধ্যে এক জাতের কণার নামের ভিতরে ‘বোসন’ হিসেবে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।

সুরে নিমগ্ন বিজ্ঞানের সাধক

মানুষটা কেমন ছিলেন? তাঁর পরিবারের দু’জন মানুষের সঙ্গে কথা বললাম। সত্যেন্দ্রনাথের বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ প্রয়াত হয়েছেন ২০১৫ সালে। ছোট ছেলে রমেন বসু বললেন, ‘বিজ্ঞানতপস্বী বলতে যা বোঝায়, তা ছিলেন বাবা। পড়াশোনা নিয়ে কথা কমই হত। আমি তখন যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। আমাদের একটা সাবজেক্ট ছিল, হায়ার ম্যাথামেটিক্স। কঠিন লাগছিল। তা বলায় একদিন বলেছিলেন, বইটা নিয়ে আয় তো। পাঁচ ঘণ্টা ধরে পড়ালেন। কী গভীর জ্ঞান নিয়ে বোঝালেন! আমি মন্ত্রমুগ্ধ। ছাত্রছাত্রীদের ভিড় লেগে থাকত। ছাত্রছাত্রীরা যেন ওঁর ছেলেমেয়ে। দেখে বোঝার উপায় নেই। আমাদের ভাইবোনেদের পড়াশোনার খবর রাখতেন, কিন্তু বসিয়ে পড়াতেন না। বাড়িতে আড্ডা লেগে থাকত। শিল্প, সাহিত্য, দর্শনের আড্ডা। অতুল বসু, যামিনী রায়, বিষ্ণু দে, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায় যেন বাড়ির লোক!’

‘সেই আড্ডায় বাড়ির ছোটরাও কিন্তু যোগ দিতে পারত,’ বললেন নওলকিশোর মিত্র। সত্যেন্দ্রনাথের নাতি। বড় মেয়ে নীলিমা মিত্রর ছেলে। জামাইয়ের অকালমৃত্যুর পরে মেয়েকে সন্তান-সমেত নিজের কাছে রেখেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। নীলিমার ছেলে নওলকিশোর শোনালেন দাদুকে একেবারে কাছ থেকে দেখার কাহিনি। বললেন, ‘আমি তখন শিবপুরে বি ই কলেজে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। একবার ক্যালকুলাস পেপারে ফেল করেছি। বাড়িতে চিঠি এল। খবর পেয়ে দাদু মোটে দুঃখ পেলেন না। আমাকে বললেন, ক্যালকুলাস বইটা আন তো। আমি বই আনার পরে ক্যালকুলাসের আদ্য নাড়ি-নক্ষত্র বোঝাতে শুরু করলেন। আমি দেখলাম, ক্লাসে এ ভাবে পড়ানো হয়নি। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আমি সিইএসসি-তে চাকরি করতাম। ইমার্জেন্সি কলের উত্তরে যেতে দেরি হলে দাদু বলতেন, তাড়াতাড়ি যা। ট্রান্সফর্মারে জল ঢুকে যাবে যে! বিয়ের পর আমার স্ত্রী রিসার্চ করতেন বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে। এক্সপেরিমেন্ট সেরে বাড়ি ফিরতে প্রায়ই ওঁর রাত আটটা-ন’টা বেজে যেত। একদিন দাদু আমাকে ডেকে বললেন, ওকে একটা স্কুটি কিনে দে। তখন ১৯৭০-এর দশকের গোড়া। সে যুগে একজন গৃহবধূর কর্মস্থল থেকে স্কুটি চালিয়ে বাড়ি ফেরা! কতখানি আধুনিক মানসিকতা থাকলে এ রকম ভাবা যায়? এই ছিলেন দাদু।’

২০০৯ সালে কলকাতায় নানা বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট প্রথম তৈরির সাফল্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী হোলফগাং কেটারলি। বক্তৃতার ফাঁকে একবার গিয়েছিলেন ২২ নম্বর ঈশ্বর মিল লেনে সত্যেন্দ্রনাথের বাড়িতে। কুয়াশা-ঢাকা সেই সকালে ওঁকে স্বাগত জানিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ। তখনও তিনি জীবিত। ছিলেন বসু পরিবারের আরও অনেকে। রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী বেণুদেবী, তাঁর মেয়ে নন্দিনী প্রিয়দর্শিনী, তাঁর ছেলে সিদ্ধার্থ এবং সত্যেন্দ্রনাথের দুই নাতি নওলকিশোর ও অসীম রায়।

ওঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায় আমেরিকান বিজ্ঞানী কেটারলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন গবেষণার বাইরে সত্যেন্দ্রনাথের জীবন। বিশেষ কোনও শখ ছিল তাঁর? গান গাইতেন? ধ্রুপদী না লঘুসঙ্গীত? রথীন্দ্রনাথ পেশায় ইঞ্জিনিয়ার শুনে জানতে চাইলেন, ‘আপনার বাবা কখনও মৌলবিজ্ঞানে আসতে বলেননি আপনাকে?’ রথীন্দ্রনাথ জানালেন, ‘আমাদের ভাইবোনেদের পড়াশোনা ও কেরিয়ারের ব্যাপারে বাবার কোনও রকম নির্দেশনামা ছিল না।’

কেটারলি অভিভূত হয়ে পড়লেন, যখন বেণুদেবী তাঁকে উপহার দিলেন সত্যেন্দ্রনাথের ল্যামিনেট করা দুটি ছবি। যার একটি সেই ১৯২৪-এ তোলা। ছবিটি দেখে কেটারলির মন্তব্য, ‘আমার খুব কাজে লাগবে।’ তার পরেই প্রশ্ন, ‘আচ্ছা, আইনস্টাইনের সঙ্গে ওঁর কোনও ছবি আছে?’ পরিবারের তরফে জানানো হল, তা নেই। বস্তুত, ছবি তোলার ব্যাপারে সত্যেন্দ্রনাথের কখনও কোনও আগ্রহ লক্ষ করেননি তাঁরা। কেটারলির মন্তব্য, ‘ওঁদের দুজনের একটা জয়েন্ট ফোটো থাকলে খুব ভাল হত। বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট বিষয়ে আমাকে বক্তৃতা দিতে হয় নানা জায়গায়। আর আমি খুঁজে বেড়াই ও রকম একটা ছবি। কখনও তা পাইনি বলে আমাকে দেখাতে হয় স্লাইড প্রজেক্টরে পাশাপাশি ওঁদের আলাদা দুটো ফোটো!’

রথীন্দ্রনাথেরা এর পরে কেটারলিকে নিয়ে গেলেন সেই ঘরখানিতে, সেখানে জীবনের শেষ ১৫টি বছর কাটিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। ঘরের এক কোণে এখনও সাজিয়ে রাখা বিজ্ঞানীর প্রিয় এস্রাজটি। আর ঘরে অনেক ফোটোর মধ্যে বড় সাইজ়ের দু’টি ছবি। মুখোমুখি দুই দেওয়ালে আইনস্টাইন এবং রবীন্দ্রনাথ। সত্যেন্দ্রনাথের দুই ধ্রুবতারা। খাটের পাশে দাঁড়িয়ে সেগুলোর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন কেটারলি...

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement