জন্ম পতিতালয়ে। তবুও এই ঘন অন্ধকারের আবর্তেই জীবন অতিবাহিত হয়নি নটী বিনোদিনীর। প্রতিভার স্ফুরনে রঙ্গমঞ্চের কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। সৃষ্টির ভুবনেও ডুব দিয়েছিলেন কাগজ-কলমকে আশ্রয় করে। যা আজ ইতিহাস। থিয়েটার সমুদ্রের জগতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, অভিনয়ের সময়টুকু অন্তত আসল পরিচয়টা ভুলে থাকতে।
এই নটী বিনোদিনীর জীবন, কাজ নিয়ে আজও মূল্যায়ণ চলে। সেই প্রাসঙ্গিকতার জায়গা থেকেই হয়তো ‘নটী বিনোদিনী’ মঞ্চায়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন নির্দেশক সায়নদেব ভট্টাচার্য। সম্প্রতি তাঁর নির্দেশনায় ও ‘স্মরণিক’-এর প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হল ‘নটী বিনোদিনী’ নাটকটি।
কথকের ধারাভাষ্যের মাঝে চরিত্ররা উঠে এলেন মঞ্চে। গঙ্গাবাঈ-এর কাছে বিনোদিনীর হাতে-খড়ি, বেঙ্গল থিয়েটারে প্রমীলার ভূমিকায় অভিনয় থেকে বিনোদিনীর গিরিশচন্দ্র ঘোষের সান্নিধ্যে আসা, রাজাবাবুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রসায়ন, থিয়েটারের স্বার্থে নিলামে গুর্মুখ রায়ের কাছে বিনোদিনীর বিক্রি হওয়া, ন্যাশানাল থিয়েটারের নিলামে ওঠা, অভিমানে ২৫ বছর বয়সে অভিনয় জীবন থেকে অবসর- এসব ঘটনা উঠে এল মঞ্চে।
বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার দৃশ্যায়নেও পরিচালকের যত্নের ছাপ স্পষ্ট। গিরিশ ঘোষের দাম্ভিকতা, রামকৃষ্ণ দেবের মাহাত্ম্য অনুধাবনের পর তাঁর চরণে সমর্পণের দৃশ্যে সায়নদেব অসামান্য। রামকৃষ্ণ পরমহংসের চরিত্রে দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। বিনোদিনীর ভূমিকায় প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্যের অভিনয়ও মন ছুঁয়ে যায়। স্পষ্ট উচ্চারণে, চড়া গলার ব্যবহারে বিনোদিনীর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তবে অনুভূতির প্রকাশে মুখজ অভিব্যক্তির প্রকাশ আরেকটু স্পষ্ট হলে ভাল হত।
রামকৃষ্ণ দেবের বাণী গিরিশের কাছে বুজরুকি বলেই মনে হত। কিন্তু এক সময় তাঁর কাছেই ছুটে যেতে হয়েছিল গিরিশকে। এক দৃশ্যে দেখা যায় গিরিশের লেখার খাতায়, মদের গ্লাসে রামকৃষ্ণদেবেরই প্রতিচ্ছবি। এই দৃশ্যের বাস্তবায়নে সায়নদেব অনবদ্য।
স্বয়ং রামকৃষ্ণ দেব দেখতে এসেছিলেন গিরিশের ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকটি। নিমাই-এর ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন। তাঁর আশীর্বাদ ধন্য বিনিকে বলেছিলেন, ‘মা তোর চৈতন্য হোক’। এই ঘটনার মঞ্চায়ন মুগ্ধ করে। কাশীর গঙ্গাকে সাক্ষী করে রাজাবাবু (অনিরুদ্ধ রায়) পণ করেছিলেন বিনিকে পেয়ে তিনি খুশি। কাউকে বিয়ে করবেন না। কিন্তু রাজাবাবু কথা রাখেননি। ছলনা প্রতারণার কষ্ট সহ্য করে দৃঢ় চিত্তে রাজাবাবুকে চলে যেতে বলেছিলেন জীবন থেকে। বলেছিলেন, তোমার ভালবাসার মধ্যে পুরনো খদ্দের লুকিয়ে ছিল। ‘আমি টাকাকে রোজগার করি, টাকা আমাকে নয়’। এই দৃশ্যে প্রিয়াঙ্কার অভিনয় দর্শক মনকে বিদ্ধ করে। সকলের অভিনয়ই প্রশংসার দাবি রাখে। আলো, পোশাক, সঙ্গীত, মঞ্চসজ্জাও যোগ্য সঙ্গত করেছে।