ছবি: কৌশিক সরকার
বহু আগেই কবিতায় আবহ ব্যবহার করেছিলেন কাজী সব্যসাচী। আবার এ যুগে তা ভিন্ন ভাবে ব্যবহার করে আবৃত্তি শিল্পে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়রা।
শুধু মিউজিক নয়, কবিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাচের ছন্দ, ভিডিও প্রোজেকশন।
তবে তাতে আপত্তির কিছু দেখছেন না কবি শ্রীজাত। তাঁর কথায়, ‘‘পরীক্ষামূলক কাজকর্মকে সব সময় সাধুবাদ জানাই। মূল পাঠের স্বাভাবিক ছন্দকে নষ্ট না করে, বরং তাকে ফুটিয়ে তুলতে তা যদি আরও সাহায্য করে, তাহলে ক্ষতি কী?’’
ঠিক তেমনই একটি পরীক্ষামূলক প্রয়াস ‘রক্তকরবী’। নির্দেশনায় ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর কবিতার স্কুল ‘কাব্যায়ন’-এর ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এটি ৪ মার্চ রবীন্দ্রসদনে অভিনীত হবে।
হঠাৎ রক্তকরবী কেন?
ব্রততীর কথায়, ‘‘আসলে কলেজ জীবনে যখন প্রথম রক্তকরবী পড়লাম, নন্দিনীর দাপুটে, চ্যালেঞ্জিং চরিত্রটা তখন থেকেই আমাকে টানত। একটা মেয়ের কী অসম্ভব প্রাণশক্তি! খোদ রাজাকেই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জন করার শক্তি জুগিয়েছিল সে।’’
তাঁর মতে, মেয়েদের মধ্যেও রয়েছে একটা বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ। সেই বিপ্লবের উত্তাপটাই এ বার মঞ্চে। তবে শ্রুতি-অভিনয় হলেও, নিছক শ্রুতি-অভিনয়ের গণ্ডিতে বাঁধা থাকছে না ‘রক্তকরবী’। একটি নাটকের বহু উপকরণই থাকবে এখানে।
যেমন, নাটকের মতো সেট, আলোর ব্যবহার, ভিডিও প্রোজেকশন, এমনকী প্রত্যেক চরিত্রের আলাদা আলাদা পোশাক পরিকল্পনা— সবই থাকছে ‘রক্তকরবী’-তে।
সংলাপগুলোকে আরও ভিস্যুয়াল করে তুলতে নাচও ব্যবহার করা হচ্ছে। জানালেন মধুবনী চট্টোপাধ্যায়। নৃত্য নির্মিতির দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
‘‘শারীরিক অভিনয়টা শুধু থাকছে না। পুরো দৃশ্যটাই আমাদের আঁকতে হবে গলার স্বর দিয়ে। আর সেটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ’’, বললেন শ্রীকান্ত আচার্য।
‘রক্তকরবী’-তে বিশু পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করছেন তিনি। নন্দিনীর ভূমিকায় ব্রততী। ফাগুলালের চরিত্রে ও অধ্যাপকের চরিত্রে মনোজ মুরলী নায়ার ও সুমন্ত্র সেনগুপ্ত।
রাজার চরিত্রে আছেন দেবেশ রায়চৌধুরী। আর অন্যান্য ভূমিকায় কাব্যায়নের ছাত্রছাত্রীরা। অনেকে মনে করেন, রিয়্যালিটি শো, সিরিয়ালের যুগে আজকাল বহু শ্রোতাই হল-বিমুখ। কিন্তু এ যুক্তি মানতে আদৌ রাজি নন সঙ্গীতকার শ্রীকান্ত।
তাঁর মতে, ‘‘গত কয়েক বছর ধরেই কলকাতায় নাটকের দর্শক সংখ্যা কমেনি, উপরন্তু বেড়েছে। রবিবার দুপুরেও অনেক ভাল প্রযোজনায় দেখা যায়, অ্যাকাডেমি হাউস ফুল। অর্থাৎ বাড়ির ভাতঘুম ছেড়েও হলে হা়জির দর্শক।’’
একই সুর শোনা গিয়েছে বাচিক-শিল্পী ঊর্মিমালা বসুর কথাতেও।
তিনি বলেছেন, ‘‘এই তো কিছু দিন আগে যাদবপুরের মেটালার্জি বিভাগে অনুষ্ঠান করে এলাম। হল ভর্তি।’’ অর্থাৎ তাঁর দাবি, জেন-ওয়াইও শ্রুতি-নাটক শুনতে ভিড় করে প্রেক্ষাগৃহে। রক্তকরবী-র মহড়ায় বড় হল ঘরটার মাঝে গোল হয়ে বসেছিলেন সবাই। কেউ ফাগুলাল। কেউ রাজা। কেউ বা অধ্যাপক। ওঁরা প্রত্যেকেই নন্দিনীর জন্য অপেক্ষমাণ।
ওঁর ছোঁয়াতেই ওঁদের নির্জীব প্রাণে ফুটবে এক একটি রক্তকরবী। তাই নাটকের শেষে সমস্বরে গলা মেলালেন সবাই, ‘‘জয় নন্দিনীর জয়!’’ আর বেজে উঠল, ‘‘মুক্ত আমি, রুদ্ধ দ্বারে বন্দী করে কে আমারে!’’ আসলে হয়তো সময়ের শিকলে শিল্পকে কখনওই বন্দি করা যায় না। সে যে আপন খেয়ালে এগিয়ে চলে।