Uday Shankar Dance Festival

উদয়শঙ্কর নৃত্যোৎসব

৮ ডিসেম্বর প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে মঞ্চানুষ্ঠানের সূচনা এবং মঞ্চে উপবিষ্ট নৃত্যগুরু ও গবেষকদের সংবর্ধিত করা হয়। সম্মাননা জ্ঞাপন করেন ডান্স অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি মুনমুন হোড় সিংহ।

Advertisement

শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৫:৪৭
Share:

অনুষ্ঠানের ইদ্বোধনে শিল্পীরা।

পশ্চিমবঙ্গ তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর আয়োজিত ওয়েস্ট বেঙ্গল ডান্স অ্যাকাডেমির প্রযোজনায় পাঁচ দিনের ‘উদয়শঙ্কর নৃত্যোৎসব’ উদ্‌যাপিত হল কলকাতার মধুসূদন মঞ্চে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ৮ থেকে ১২ ডিসেম্বর মধুসূদন মঞ্চ চত্বরে প্রবাদপ্রতিম নৃত্যশিল্পী ও সৃজনশীল নৃত্যের পুরোধাপুরুষ উদয়শঙ্করের জীবন ও কর্মকৃতি নিয়ে একটি প্রদর্শনী ও মঞ্চে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নৃত্য প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়।

Advertisement

৮ ডিসেম্বর প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে মঞ্চানুষ্ঠানের সূচনা এবং মঞ্চে উপবিষ্ট নৃত্যগুরু ও গবেষকদের সংবর্ধিত করা হয়। সম্মাননা জ্ঞাপন করেন ডান্স অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি মুনমুন হোড় সিংহ। নৃত্যানুষ্ঠানের শুরুতে হয় বহ্নিশিখা ভট্টাচার্যের পরিচালনায় বিশেষ ভাবে সক্ষম ছেলেমেয়েদের রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নৃত্যের অনুষ্ঠান— অন্বেষা। অভিনব এই সূচনা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই। এর পর নৃত্যগুরু অলকা কানুনগোর শিষ্যা স্বরলিপির ওড়িশি নৃত্য। অলকার শিষ্যা স্বরলিপি রায় অলকার গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের নৃত্যধারাকেই বহন করে নিয়ে চলেছেন। তাঁর নৃত্যে সেই পরম্পরার স্পর্শ পাওয়া গেল। তৃতীয় অনুষ্ঠান মমতাশঙ্করের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় মমতাশঙ্কর ডান্স কোম্পানির নিবেদন— প্রকৃতি। উদয়শঙ্করের সুযোগ্যা কন্যা মমতাশঙ্কর, উদয়শঙ্করের নৃত্যধারার সঙ্গে তাঁর নিজস্বতাকে সুন্দর ভাবে যুক্ত করে উপস্থাপিত করেছেন তাঁর নৃত্যনির্মাণকে। পোশাকের পরিকল্পনাও তাঁরই। এ ভাবেই নৃত্যপরম্পরা বেঁচে থাক, এই কামনা করি। এর পর মৌসুমী পাল ও ঋত্বিক ভট্টাচার্যের দ্বৈত ভরতনাট্যম অনুষ্ঠান। সূর্যপ্রণাম ও আলারিপুর প্রচলিত ধারাকে অন্য ভাবে উপস্থাপিত করে, সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। পরবর্তী শিল্পী ঋত্বিক ভেঙ্কট— কুচিপুড়ি আঙ্গিকে অর্ধনারীশ্বরের অতি সুন্দর উপস্থাপনা। সে দিনের শেষ অনুষ্ঠান সাধনা হাজরা ও মিঠুন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নৃত্যভূমির সৃজনশীল নৃত্যের নিবেদন। প্রথমে নারীশক্তির বিচ্ছুরণ, পরে শিশুনির্যাতন, বাল্যবিবাহ, নারীপাচার, বস্ত্রহরণ নিয়ে নৃত্যানুষ্ঠান। সমাজের এই সমস্ত দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে নৃত্যনির্মাণ করে সচেতন করার জন্য ধন্যবাদ জানাই সঞ্চালক সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ও তমাল ঘোষকে।

৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় বাংলার শাস্ত্রীয় নৃত্য— গৌড়ীয় নৃত্য দিয়ে। ড. মহুয়া মুখোপাধ্যায়ের একক প্রচেষ্টায় গৌড়ীয় নৃত্য আজ ভারতীয় নৃত্যের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। নবনীতা নস্করের গৌড়ীয় নৃত্য সেই নৃত্যের পরম্পরাকেই প্রতিষ্ঠিত করে। দ্বিতীয় নিবেদন— আদিতা সিংহের কত্থক নৃত্য। কলকাতায় কত্থক নৃত্যের পরম্পরাকেই ফিরিয়ে দিলেন আদিতা। তার পর সিনাম বসু সিংহ ও কোনজেনবাস মণিকা দেবীর যুগল মণিপুরী নৃত্য। মণিপুরীর পর প্রলয় দাসের একক ভরতনাট্যম নৃত্য। শেষে তিনটি সৃজনশীল নৃত্যের অনুষ্ঠান— জয়দেব পালিত পরিচালিত হৃতাল ডান্স অ্যাকাডেমির অনুষ্ঠান ও মধুরিমা গোস্বামীর কত্থক নৃত্যের অনুষ্ঠান। সবশেষে গুরু সুতপা তালুকদার পরিচালিত গুরুকুলের নিবেদন— ওড়িশি আঙ্গিকে সরস্বতী বন্দনা ও আনন্দবসন্ত। সঞ্চালক দেবাশিস বসু ও শম্পা বটব্যাল। ১০ ডিসেম্বর তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় মণিকঙ্কণা কুণ্ডুর সৃজনশীল নৃত্য দিয়ে। তার পর একে একে সুমন কাণ্ডারের ভরতনাট্যম, রুদ্রপ্রসাদ সোয়াইন ও অনন্যা পারিধার ওড়িশি, সায়নী চক্রবর্তী পরিচালিত ধ্রুব ইনস্টিটিউট অব ডান্স ফাউন্ডেশনের ভরতনাট্যম, অভীক চাকীর কত্থক এবং গোপাল সিংহ পরিচালিত রবির আলো-র মণিপুরী নৃত্য। শেষ অনুষ্ঠান শ্যামল মল্লিক পরিচালিত অবন্তী ওম ফাউন্ডেশনের সৃজনশীল নৃত্যানুষ্ঠান। সঞ্চালক অংশুমান চক্রবর্তী ও দেবাশিস।

Advertisement

১১ ডিসেম্বর চতুর্থ দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় দেবস্মিতা মান্নার মণিপুরী নৃত্য দিয়ে। তার পর সঞ্জীব জেনার ওড়িশি, দীপজ্যোতি ও দীপঙ্কর অরন্ধরার সত্রীয় নৃত্য, অলকা কানুনগো পরিচালিত শিঞ্জন নৃত্যালয়ের ওড়িশি, স্বাতী আম্মানাথনের ভরতনাট্যম। শেষ অনুষ্ঠান দ্রাবীন চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত এথনিক ডান্স অ্যাকাডেমির সৃজনশীল নৃত্যানুষ্ঠান—আমি। সঞ্চালক কৌশিক সেন ও সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়। পঞ্চম দিন, ১২ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠান শুরু হয় নন্দিতা দাসের কুচিপুড়ি নৃত্য দিয়ে। তার পর একে একে মালবিকা মেননের মোহিনী আট্টম, পল্লবী দে ও দেবস্মিতা মুখোপাধ্যায়ের কত্থক, সাবর্ণিক দে পরিচালিত ব্রহ্মকমল ইনস্টিটিউটের সৃজনশীল নৃত্য, অরূপা গায়ত্রী পণ্ডার ওড়িশি নৃত্য। শেষ অনুষ্ঠান সন্দীপ মল্লিকের পরিচালনায় সোনাপুর নাদমের নিবেদন—সমবেত কত্থক নৃত্য। সঞ্চালক সৌভিক মজুমদার ও মধুমিতা বসু।

পাঁচ দিনের এই নৃত্যোৎসবে প্রায় প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানই যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে মঞ্চস্থ করা হলেও, হলে দর্শকের উপস্থিতি এত কম কেন? অন্যান্য বছর অনুষ্ঠানটি রবীন্দ্রসদনে হয়। এ বার মধুসূদন মঞ্চে হওয়ার কারণ কি দর্শকের অনুপস্থিতি? না কি প্রচারের অভাব? কলকাতায় নৃত্যপ্রেমী দর্শকের অভাব নেই। প্রবেশ অবাধ হওয়া সত্ত্বেও, রবিবার ছাড়া অন্য দিন প্রায় ফাঁকা হলে অনুষ্ঠান দুর্ভাগ্যজনক। ভবিষ্যতে ভারতীয় নৃত্য সম্পর্কে দর্শকদের আরও আগ্রহী করে তোলার জন্য কী করা যেতে পারে, তা ভাবার সময় এসেছে। এই সঙ্গে একটি বিনম্র প্রস্তাব— ভারতে সৃজনশীল নৃত্য তথা ক্রিয়েটিভ ডান্সের পুরোধা পুরুষ উদয়শঙ্করের নামাঙ্কিত এই উৎসবটি কি শুধু মাত্র ক্রিয়েটিভ ডান্সেই সীমাবদ্ধ রাখা যায়? তা হলে হয়তো আরও অন্য ধরনের নৃত্যের শাস্ত্রীয় ধারাকে অনুসরণ করে অথবা না করে উপস্থাপনা ঘটতে পারে। নাচের সঙ্গে চিত্রকলা, কবিতা, নাটকের মিশ্রণ ঘটিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা হতে পারে— যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও সৃজনশীল হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ নানা উৎসবকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নৃত্যের প্রবর্তন করে, বাংলায় নৃত্যের ইতিহাসে সৃজনশীল নৃত্যের সূচনা করেন, যা আজ রবীন্দ্রনৃত্য নামে সর্বত্র স্বীকৃত। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই উদয়শঙ্কর কলকাতায় নিজস্ব রীতিতে আর এক ধরনের সৃজনশীল নৃত্য নির্মাণ করে ভারতে তথা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এই মহান শিল্পীকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে যে উৎসবের আয়োজন— সেখানে আরও নতুন নতুন ভাবনায় নৃত্যনির্মাণ হোক। উদয়শঙ্করের নৃত্যভাবনা নিয়েও চর্চার প্রয়োজন। শুধু মমতাশঙ্কর ডান্স কোম্পানি নয়, আরও শিল্পীরা এগিয়ে আসুক এই নৃত্যধারাকে বহমান রাখতে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement