Art Exhibition review

আমারই চেতনার রঙে...

ফ্রান্স থেকে ফিরে আসার পরে যোগেন চৌধুরী প্রায় এক বছর ছবি আঁকেননি। তাঁর নিজের কথাতেই জানা গেল, সে সময়ে কতকগুলো নির্দিষ্ট চিন্তাধারা তাঁর মধ্যে জমা হয়েছে।

Advertisement

শমিতা বসু

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৫ ১০:১৯
Share:
স্বপ্নময়: দেবভাষায় আয়োজিত যোগেন চৌধুরীর প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম

স্বপ্নময়: দেবভাষায় আয়োজিত যোগেন চৌধুরীর প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম

দেবভাষা ছবি ও ব‌ইয়ের আবাসে যোগেন চৌধুরীর লেখা অপ্রকাশিত রচনাবলির প্রথম খণ্ড প্রকাশ পেল সম্প্রতি। সেই সঙ্গে তাঁর বেশ কিছু নতুন কাজ‌ও দেখার সুযোগ পেলেন শহরের শিল্পরসিকরা। প্রদর্শনী চলবে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত।

Advertisement

ফ্রান্স থেকে ফিরে আসার পরে যোগেন চৌধুরী প্রায় এক বছর ছবি আঁকেননি। তাঁর নিজের কথাতেই জানা গেল, সে সময়ে কতকগুলো নির্দিষ্ট চিন্তাধারা তাঁর মধ্যে জমা হয়েছে। এক বছর ধরে ছবি সম্পর্কে শুধু ‘নোট’ করে যেতেন শিল্পী। মাথার ভিতরে কাজ করেছে ছবির বিভিন্ন বিষয়... কী নিয়ে ছবি আঁকবেন, কেমন করে আঁকবেন, কার জন্য আঁকবেন, আমাদের ট্র্যাডিশনটা আসলে কী... এই সব। সেই সময়েই একটি লেখা তৈরি করেছিলেন শিল্পী।

যোগেন চৌধুরী রচনাসমগ্রের প্রথম খণ্ডে শিল্পী বলছেন, যে কোনও শিল্প সৃষ্টির জন্য সৃজনশীল মানুষকে আগের ইতিহাস, তার নিজস্ব পরিবেশ বা সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক একটা ধারণা গড়ে নিতে হয়। তা থেকে তাঁর ব্যক্তিত্ব, প্রতিভা, আবেগ ও চেতনার মিশ্রণে নতুন কিছু সৃষ্টি করা যায়। কী ভাবে কোনও শিল্প সার্থক হয়ে উঠতে পারে, তা-ও বিশদে ধরা হয়েছে এখানে।

Advertisement

আলোচ্য প্রদর্শনীতে যে ৪৫টি অভিনব ছবি দেখা গেল, তা গত এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে নানা মাধ্যমে করেছেন শিল্পী। প্রথমেই যে ধরনের ছবি প্রদর্শিত হয়েছে, তার মাধ্যম একেবারে আলাদা। কিছু ফুল, লতা, পাতার ছবি ছাড়া বাকি প্রায় সব‌ই বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন ভঙ্গিমার মুখাবয়ব। শিল্পী তাঁর নিজের কথায় বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন এর আগে যে, মানুষের মুখাকৃতি তাঁকে ভীষণ ভাবে আকর্ষণ করে। এখানে একটি কথা উল্লেখযোগ্য যে, প্রকৃতির রূপ যোগেন চৌধুরীর ছবিতে প্রায় প্রথম দিক থেকেই নিরুদ্দেশ। কলেজে থাকাকালীন প্রকৃতি ও গাছপালার কিছু ছবি তিনি আঁকতেন। কিন্তু পরে মানুষ যে ভাবে তাঁর ছবিতে প্রাধান্য পেয়েছে সর্বাঙ্গীণ ভাবে নাটকীয় ভঙ্গি নিয়ে, তেমন আগে কখনওই ঘটেনি। মানুষের নানা রূপ, ভঙ্গিমা, মুখাকৃতি এবং তার অন্তর্নিহিত চরিত্র শিল্পীকে আকর্ষণ করেছে নিরন্তর। আর ঠিক সেই কারণেই এত রকমের অভিব্যক্তি শিল্পপ্রেমীরা এই প্রদর্শনীতে দেখতে পান।

প্রথমেই দেখা গেল ১৬টি ছবি, নিউজ়প্রিন্টে করা। প্রথম জীবনে যোগেন নিউজ়প্রিন্টের উপরে ছবি আঁকতেন। এ বারও ফিরে গিয়েছিলেন সেখানেই। বোর্ডের উপরে নিউজ়প্রিন্ট পেস্ট করে বেশ কিছু ছবি পেশ করেছেন। এক‌-একটি মুখাবয়বের ভাষা এক-এক রকম। এ ছাড়াও ড্রাই প্যাস্টেলে একটু-আধটু গাঢ়ত্ব দিয়ে ছবিগুলিতে এক বিশেষ গভীরতা এনেছেন। সেই অর্থে এই কাজগুলি অসাধারণ। বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ছবি, ‘আ ইয়ং বয়’, ‘স্কিনহেড বয়’, ‘আ ভিলেজ গার্ল’, ‘ফেস অব আ স্যাড উয়োম্যান’, ‘ম্যান উইথ পনিটেল হেয়ার’ ইত্যাদি।

এ ছাড়া রয়েছে মিশ্র মাধ্যমে কাগজে করা বেশ কিছু ছোট ছবি। এখানেও নানা চমকপ্রদ কাজের মধ্যে মেডুসার ছবিটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। মিশ্র মাধ্যমের এই কাজগুলির মধ্যে লক্ষণীয়, ‘উয়োম্যান ইন ব্লাউজ়’, ‘কুইন’, ‘পিকক’, ‘ম্যান’, ‘ফেস’ ইত্যাদি। দু’-তিনটি বিমূর্ত ছবি রীতিমতো আকর্ষক, যা নিছক নকশা নয়। সে সব ছবিতে বেশ কিছু গভীর কথা বলতে চেয়েছেন শিল্পী। তাতে রয়েছে দেশবিদেশের নানা গল্পও। এই কাজগুলি তাদের মধ্যকার অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজতে বাধ্য করে শিল্পপ্রেমীদের।

মিশ্র মাধ্যমে কাগজের উপরে ছোট ছোট কাজে যেন ধরা পড়েন রসিক যোগেন চৌধুরী। অদ্ভুত এক রঙ্গপ্রিয়তায় নতুন ধারায় বহু ধরনের শিল্পকর্ম উদ্ভাবন করেছেন তিনি। ডিজ়াইন, বিন্যাস, রচনাশৈলী, বর্ণবৈচিত্রে অভিনব সব ড্রয়িংয়ে তাঁর হাত চলেছে অনিবার। শিল্পীর এই সিরিজ়ের প্রায় সব ক’টি কাজই গভীর জীবনবোধ এবং মননের ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ। সিরিজ়ের প্রত্যেকটি মুখাবয়ব‌ই অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপকও বটে।

এ বারের প্রদর্শনীতে তাঁর ক্যানভাসের উপরে মিশ্র মাধ্যমে করা ৩০ ইঞ্চি বাই ১২০ ইঞ্চির একটি কাজের সঙ্গে দর্শকের পরিচয় হয়, যেটির নাম ‘ড্রিম’। এই বিশেষ ক্যানভাসটির জন্য গত দেড় বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলেন যোগেন চৌধুরীর ভক্তেরা। ক্যানভাসে এমন ভাবে হাত চালিয়েছেন শিল্পী, ঠিক যেমন ভাবনাটি তাঁর মনের গভীর থেকে উঠে এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে শিশুসুলভ মনে হলেও এতে এমন অনেক ফর্ম রয়েছে, এমন কিছু উপাদান আছে, যা অত্যন্ত পরিণত ভাবনার ফসল। গাছের সুন্দর অলঙ্করণ দু’দিকে দৃশ্যমান। মাঝে বিভিন্ন আকারে বৈচিত্রময় বাড়িঘর। এত রকম আকৃতির গাছপালা, পাখি, মসজিদ ও একটি বাড়ির অদ্ভুত গঠনের মাঝে আকাশে মেঘের উপস্থিতি। তার মাঝে যেন ইদের চাঁদ। এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের সাক্ষী থেকে যাচ্ছে একটিমাত্র চোখ। যথার্থই এক স্বপ্নময় ছবি এই ‘ড্রিম’।

যোগেন এই প্রদর্শনীর নাম রেখেছেন ‘ইন মাই ওন ল্যাঙ্গুয়েজ’। প্রদর্শনী দেখে এসে বলা যায়, এ যেন যথার্থই শিল্পীর ভাষা, চেতনার সর্বময় প্রকাশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement