ছবি ও ঘর গ্যালারিতে আয়োজিত প্রদর্শনীতে বাংলার পটশিল্প। —নিজস্ব চিত্র।
এ দেশের প্রাচীন কালের পটশিল্প প্রধানত মঙ্গলকাব্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এই সব পটশিল্পের বহু ধারাই অনেক পুরনো। যেমন শঙ্খশিল্প পাঁচ হাজার বছর আগে ছিল বলে ধারণা করা যায়। আর টেপা-পুতুলের কাজও অন্তত চার হাজার বছর আগে ছিল বলে জানা যায়। বিষ্ণুপুরাণে দশমহাবিদ্যার উল্লেখ আছে এবং পরবর্তী কালে সেখান থেকেই দেবীর রূপ এবং বিষ্ণুর রূপ পটশিল্পে এসেছে। চণ্ডীমঙ্গল কাব্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মেদিনীপুরে চণ্ডীপটের কল্পনা করেন শিল্পীরা।
কলকাতার জাঁকজমকপূর্ণ বারোয়ারি দুর্গা পুজোর অনেক আগে থেকেই দুর্গাকে বিভিন্ন রূপে বাঙালি উপাসনা করে আসছে। শুধু মাটির প্রতিমা হিসেবে নয়, শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাংলার এক অসামান্য লোকশিল্পের পরম্পরা। দুর্গাপুজো উপলক্ষে বাংলার মুখোশ, পটচিত্র, টেপা-পুতুল, আলপনা, শের-পাই এবং আরও নানা লোককথা নিয়ে সম্প্রতি ছবি ও ঘর আর্ট গ্যালারি এক অনন্য প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। পুরো কাজটি উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল লোকশিল্প বিশেষজ্ঞ বিধান বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে।
এই প্রদর্শনীতে দেখা গেল কৃষ্ণনগরের অশীতিপর রেবা পালের চালচিত্র, মহীরুল চিত্রকরের চৌকো চণ্ডীপট, বিষ্ণুপুরের ফৌজদার পরিবারের হাতে আঁকা বিরল দুর্গাপট, দক্ষিণ দিনাজপুরের কাঠের পুতুল, নতুনগ্রামের নতুন সাজের কাঠের দুর্গা, ঠেকুয়া চকের বেণী-পুতুলের দুর্গা, বহরমপুরের শোলার দুর্গা, বিষ্ণুপুরের শাঁখের উপরে অসামান্য কারুকার্য করা দুর্গা এবং বীরভূমের হারিয়ে যাওয়া শিল্প শের-পাই।
এ ছাড়াও এই প্রদর্শনীতে ছিল ডোকরার দুর্গা, পুরুলিয়ার দুর্গা মুখোশ, দত্তপুকুরের দুর্গা সরা এবং আরও অনেক কিছু। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল, প্রদর্শনীর প্রথম দিনে ছবি ও ঘর গ্যালারি সম্মান জানিয়েছে সেই সব মানুষকে, যাঁরা আজও শুধু ভালবেসে, প্রাণ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন হারিয়ে যাওয়া বাংলার এই লোকশিল্পকে।
কৃষ্ণনগরের শিল্পী রেবা পাল একচালি দুর্গা প্রতিমার উপরে অর্ধবৃত্তাকারে চালচিত্র এঁকেছেন। এতে অনেক পৌরাণিক কাহিনি অঙ্কিত করা থাকে এবং চিত্রের দু’পাশে দেবী দুর্গার যুদ্ধের ছবি থাকে। চালচিত্রের একদম মাঝখানে থাকে শিব ও পার্বতীর ছবি, এক পাশে কৃষ্ণলীলা এবং অন্য পাশে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। চালচিত্রের মূল উপকরণ কাগজ এবং তার উপরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হয়েছে।
এর পরে দেখা যায় বিষ্ণুপুরের শীতল ফৌজদারের দুর্গাপট। কাপড়ের উপরে তেঁতুলবীজের আঠার প্রলেপ দিয়ে আবার কাপড় সেঁটে তৈরি। এই ভাবে কয়েক প্রস্ত কাপড় সেঁটে এই পট তৈরি করা হয় ও দেশজ রঙে এই পট আঁকা হয়। বিষ্ণুপুর রাজবাড়িতে এই ধরনের পটের পুজো হয়ে থাকে।
প্রদর্শনীতে দেখা গেল লক্ষ্মণ পালের দুর্গাসরা। পোড়ামাটির এই সরার আকৃতি গোলাকার। তার উপর দেশজ রঙে সপরিবার দেবী দুর্গার অসুরনিধনের ছবি আঁকা থাকে। এই সরা বিভিন্ন আকার এবং ধরনের হয়। নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি অঞ্চলে এই সরা তৈরি হয়।
প্রদর্শনীতে আমরা দেখতে পাই বাঁকুড়া জেলার বলবীরসিংহ গ্রামের কর্মকার পরিবারের আঁকা দুর্গাপট, জামবুড়ি। পটগুলি শিল্পী কৃপাময়ী কর্মকারের আঁকা। কাপড়ের উপরে দেশজ রং ব্যবহার করা হয়েছে। এই জায়গাতেই আর একটি পট করা হয়, তার নাম মহামারি পট। এর বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি নবমীর দিন সকলের অলক্ষ্যে পূজিত হয়। শুধুমাত্র পটুয়া এই পট দেখেন। সকলের দেখার সুযোগ হয় না। নরমুণ্ডের মালা গলায় এই কৃষ্ণবর্ণ দেবীমূর্তি নীল ঘোড়ার পিঠে উপবিষ্ট। হাতে খাঁড়া। অন্য হাতে একটি পতাকা। অদ্ভুত এক আকর্ষণ রয়েছে এই কালো মূর্তির মধ্যে।
এখানে একটি মুখোশের কথা বলা দরকার, যেটি ছৌ নাচের সময়ে ব্যবহার করা হয়। মূলত দেবাসুরের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি এই মুখোশগুলি বীর রসাত্মক হয়। দেবী-যুদ্ধের কাহিনিতে সপরিবার দুর্গার মুখোশ তৈরি করা হয়। মুখোশগুলি কাগজ দিয়ে তৈরি এবং উপর দিকে পুঁতি, জরি, রাংতা ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে অত্যন্ত দর্শনধারী করা হয়। প্রদর্শনীতে দুর্গার মুখোশটি নজর কাড়ে।
বাঁকুড়া জেলার হাটগ্রামে শঙ্খশিল্পীদের বাস। বাবলু নন্দী তাঁদেরই উত্তরসূরি। প্রদর্শনীতে রাখা শঙ্খের উপরে দুর্গা-প্রতিমা একটি উজ্জ্বল শঙ্খশিল্পের নিদর্শন। মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে সংগৃহীত হয়েছে শোলার দেবীমূর্তি।
পূর্ব বর্ধমান জেলার নতুনগ্রামের কাঠের কারিগরের তৈরি দুর্গা ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে শোভা পেয়েছে। একটি কাঠে দেবী দুর্গার সপরিবার মূর্তি খোদাই করা হয়েছে।
প্রদর্শনীর তরফ থেকে সংগৃহীত ন্যাচারাল পিগমেন্ট ব্যবহার করে কাপড়ের উপরে করা হয়েছে স্ক্রোল। আরও আছে শারদোৎসবের আলপনায় চণ্ডী। দুর্গাপুজোর সময়ে পুজোর মণ্ডপে চালের গুঁড়ো দিয়ে আঁকা আলপনায় চণ্ডীপুজোর বিভিন্ন মুহূর্ত ধরা থাকে। দেবীপক্ষের সূচনালগ্ন থেকে যে আলপনা দেওয়া হয়, তার মধ্যে সৌভাগ্য চতুর্থী আর বেল্লীবরণ প্রধান আলপনার ছবিতে এগুলি ধরা থাকে।
একেবারে শেষে বলা যাক বেণী-পুতুলের কথা। তমলুকের কাছে এক গ্রামের সাঁওতালরা তৈরি করেন এই বেণী-পুতুল। মাথাটি মাটির সুন্দর রঙে রঞ্জিত, হাত-পা কাঠের। আর সেই হাত-পা রঙিন পোশাকে ঢাকা। বেণী ঝোলানো পুতুল বলে এদের এই নামকরণ। এর ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দু’হাতে দুটো পুতুল নিয়ে গ্ৰামেগঞ্জে নাচ-গান হয়, গল্প বলা হয়, যাত্রা হয়।
দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে এত ধরনের গ্ৰামীণ লোকশিল্প ও তার নেপথ্যের শিল্পীদের এই প্রদর্শনীতে কলকাতার মানুষের সামনে নিয়ে আসায় এ বারের দুর্গোৎসব যেন পূর্ণতা লাভ করল।