গিরীশ কারনাড রচিত বিখ্যাত নাটক ‘হয়বদন’ অবলম্বনে কথাকৃতি প্রযোজনা করল তাদের সাম্প্রতিক নাটক ‘ঘোড়ামুখো পালা’। রবীন্দ্র সদন অডিটোরিয়ামে অবশ্য দর্শকসংখ্যা নিতান্তই নগণ্য ছিল। যে কোনও থিয়েটার দলের কাছে যা আশাব্যঞ্জক নয় মোটেই।
মূল ‘কথাসরিৎসাগর’ থেকে তাঁর নাটকের কাহিনি সংগ্রহ করেছিলেন গিরীশ কারনাড। এতে ত্রিভুজ প্রেমের গল্প বলতে গিয়ে এসেছে মানুষের মনের জটিলতার প্রসঙ্গ, এসেছে তার অতৃপ্তি, শরীর ও মনের অচরিতার্থ বাসনা এবং সর্বোপরি নিজের অস্তিত্ব সংকটের বিষয়টি।
ইংরেজি ‘Hayvadana’ শব্দের অর্থ হল মানুষের শরীরে ঘোড়ার মাথা। দেবতাদের মধ্যে যেমন গণেশ। তাঁর শরীরে হাতির মাথা। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই ‘ঘোড়ামুখো পালা’র শুরুতে কথাকৃতির সমগ্র দল মঞ্চে আসেন নাটকের কথকের সঙ্গে এবং গণেশবন্দনা করে তবেই মূল নাটকে প্রবেশ করেন।
এখানে একটি তথ্য জানানো যাক। মূল নাটকটি থেকে ভাষান্তর করেছেন কবি শঙ্খ ঘোষ। সম্পাদনা ও উপদেশ দিয়েছেন শ্যামল ঘোষ। সামগ্রিক ভাবনা ও নির্দেশনা সঞ্জীব রায়ের।
মূল নাটকের মতোই পুরাণের গল্প ও লোকগাথার আঙ্গিক নাটকের শরীর জুড়ে। মূল চরিত্রগুলির নামও বদল হয়নি। দেবদত্ত, কপিল, পদ্মিনী ও হয়বদন নামগুলিই ব্যবহার করা হয়েছে এ নাটকে।
আগেই বলা হয়েছে, গণেশের কাছে আশীর্বাদ চায় সকলে নাটকের শুরুতে। তার পরে ওই ঘোড়ামুখো লোকটি কথকের কাছে জানতে চায়, ঘোড়ামুখের অভিশাপ থেকে কী করে সে পরিত্রাণ পাবে। কথক তাকে চিত্রকূট পর্বতে দেবী
সন্দর্শনে যেতে বলে। এখান থেকেই শুরু হয় আসল নাটক। একদা ধর্মপুর নামে এক স্থানে দেবদত্ত ও কপিল নামে দুই বন্ধু ছিল। দেবদত্ত গৌরবর্ণ, সুন্দর চেহারার অধিকারী, জ্ঞানী ও কবি। কপিল শ্যামবর্ণ, বলশালী চেহারা ও নামকরা কুস্তিগির। তাদের দু’জনের গলায় গলায় ভাব দেখে সকলে ‘রাম-লক্ষ্মণ’ বলে ডাকে। দেবদত্ত একদিন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়েকে দেখে তার প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয় যে, মহাকালীর কাছে প্রতিজ্ঞা করে— এই মেয়েটিকে যদি সে না পায়, তা হলে নিজের দু’টি হাত কেটে দেবে মায়ের পায়ে এবং রুদ্রদেবের কাছে দেবে তার মস্তক। যাই হোক, পদ্মিনী নামে মেয়েটিকে বিবাহ করতে সক্ষম হয় দেবদত্ত।
মঞ্চে পদ্মিনীর প্রতিটি পদক্ষেপেই বেশ ছলাকলার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বিবাহের পরে কপিলকে ভাল লেগে যায় পদ্মিনীর। স্বামীর প্রতি তার অনুরাগ সত্ত্বেও কপিলের সুঠাম বলিষ্ঠ চেহারা পদ্মিনীকে কামনায় উন্মুখ করে তোলে অচিরেই। স্বাভাবিক ভাবেই দেবদত্ত ঈর্ষান্বিত হয় কপিলের প্রতি। ত্রিকোণ প্রেমের জোয়ার দু’বন্ধুকে আত্মহননের পথে ঠেলে দেয়। একের পর এক মস্তক ছেদন করে তারা মহাকালীর মন্দিরে। এ সব ঘটনা ঘটছিল ধর্মপুর থেকে উজ্জয়িনী যাওয়ার পথে। পদ্মিনী তখন গর্ভবতী, তাই তার গতি ছিল শ্লথ। মন্দিরের কাছে পৌঁছে সে দেখে, তার ভালবাসার দু’জন মানুষ মাথাকাটা অবস্থায় পড়ে আছে। পদ্মিনীও আগুপিছু না ভেবে, দেবদত্ত ও কপিলের পথেই এগোতে চায় নিজের জীবন বলি দিয়ে।
ঠিক সেই মুহূর্তে সশরীরে দেখা দেন মহাকালী। নাটকের মোচড় এখানেই। দেবীকৃপায় পদ্মিনী নিজের হাতেই মস্তক স্থাপন করে তার স্বামীর ও তার প্রিয়ের। আর অঘটন এখানেই ঘটে— দেবদত্তের ঘাড়ে বসে কপিলের মাথা, কপিলের ঘাড়ে বসে দেবদত্তের মাথা।
খেলা এ বার জমে ওঠে। মূলত রূপকধর্মী এই নাটক এগোয় এক জটিলতার মধ্য দিয়ে। কেননা পদ্মিনী ভেবেছিল সে দুই
পুরুষকেই পাবে— যে ভাবে সে চায়। কিন্তু তাকে নিরাশ হতে হয়। পদ্মিনীর চরিত্রে আম্রপালি মানানসই। একই কথা বলতে হয় দেবদত্তের চরিত্রে দীপঙ্কর হালদার বা কপিলের চরিত্রে কিঞ্জল নন্দ প্রসঙ্গে। রূপকথা বা রূপক পালা যথানিয়মে শেষ হয় খুশির
আবহেই, যখন কথক পদ্মিনীর পুত্রকে নিয়ে মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে যায় ধর্মপুরের উদ্দেশে।
কিন্তু আদৌ সেই খুশির রেশ ছড়াতে পারে কি দর্শকমনে?
সমগ্র নাটকটি বড্ড ছড়ানো। কিছু অংশ খুবই দুর্বল। পালাটি আরও সুগ্রথিত হওয়া উচিত ছিল বলে মনে হয়।
‘কোথায় ফিরিস পরম শেষের অন্বেষণে’ হল নিজেকে অন্বেষণের এই নাটকের অন্তরের কথা। অনেক পাত্রপাত্রী, হইচইয়ের দাপটে তা কিন্তু হারিয়ে গিয়েছে। অথচ প্রত্যেক শিল্পী তাঁর নিজের মতো করে ভাল ছিলেন। তবুও সংঘবদ্ধ হওয়া যায়নি।