কলেজে পড়া কয়েকজন তরুণ মাঝেমাঝেই সাহিত্যের পাঠচক্রের আয়োজন করে। সেখানে কখনও আমন্ত্রণ করা হয় নামীদামি লেখকদের।
একবার ঠিক করা হল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ করা হবে। মানিক তখন বাংলা সাহিত্য জগতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
কিন্তু কে সাহস করে যাবে তাকে আমন্ত্রণ করতে? তিনি কি এই অল্পবয়েসি ছেলেছোকরাদের পাঠচক্রে আদৌ আসবেন?
অনেক আলোচনার পর লেখককে আমন্ত্রণ জানানোর দায়িত্ব পড়ল এক তরুণের।
দুরুদুরু বুকে এক সকালে রওনা দিল সে। তখন মানিক থাকেন বরানগরে। ছেলেটির মাথায় নানা চিন্তা। অত বড় সাহিত্যিকের বাড়ি কেমন হবে? কী ভাবে কথা শুরু করবে?
বাস থেকে নেমে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে মানিকের বাড়ির সামনে যখন পৌছল সে, বেশ কিছুটা অবাক। নেহাতই সাধারণ ছোটখাটো একটি বাড়ি। সামনে বিশাল মাঠ। বুকে অনেকটা সাহস জড়ো করে দরজায় কড়া নাড়ল। দরজা খুললেন একজন মহিলা।
‘‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কি আছেন?’’
‘‘বাজারে গেছেন।’’
লেখক আবার বাজারও করে! বিস্মিত সেই তরুণ।
‘‘কিছু বলবেন?’’
‘‘না, আমি এই মাঠটায় একটু ঘুরে বেড়াই। উনি ফিরলে কথা বলছি তা’হলে।’’
দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় আধঘণ্টা মাঠে চক্কর দেওয়ার পর সে দেখল, একজন লম্বা কালোপানা মানুষ লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে, দুই হাতে দুই থলে নিয়ে ওই বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
ইনিই মানিকবাবু নাকি? গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল সে-ও।
মানিক তাকে আড়চোখে দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আপনি কি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন?’’
‘‘হ্যাঁ।’’
‘‘আসুন ভেতরে। আমি বাজারটা রেখে দিয়ে আসছি,’’ বলে মানিক চলে গেলেন ভেতরের ঘরে।
সামনের যে ঘরের চৌকিতে ছেলেটি বসল, চারদিকে তাকিয়ে দেখল ঘরে ওই চৌকি ছাড়া আছে একটা নড়বড়ে টেবিল। ব্যস, আর কিছুই নেই!। এমনকী টেবিলের ওপরেও কোনও বইখাতা রাখা নেই।
মানিক ভেতরের ঘর থেকে ফিরে এসে বললেন, ‘‘বলুন কী চান? গল্প? পত্রিকা করেন বুঝি’’?
কী ভাবে কথা শুরু করবে বুঝে পাচ্ছে না সেই যুবক।
মানিক তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘কী ভাবছেন? ভাবছেন যে একজন লেখকের ঘর এমন ফাঁকা কেন? আপনারা পাঠকেরা কিছু দেন না সেইজন্য ফাঁকা। ভাবছেন যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে হাতে বাজার করেন কেন?’’
ছেলেটি হতবাক। ঠিক এই কথাগুলোই তো ভাবছিল। মানিক জানলেন কী করে!
মানিকই উত্তর দিলেন, ‘‘না করে আর উপায় কী বলুন। লিখবার সময় পেতে হলে এসবের জন্য যে কোনও ঝি-চাকর রাখব, সে-রকম টাকা কে দেবে আমাকে? দেন কি আপনারা? পড়েন কি কেউ আমার লেখা? আপনি যে এসেছেন এখানে? আমার কোনও লেখা কি পড়েছেন?’’
অমন কথা শুনে মনে মনে বেজায় অপমানিত হল যুবক। কী বলছেন উনি? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়িনি! মুখে বলল, ‘‘পড়েছি অনেক।’’
‘‘তাতে কী সুবিধে হল? কোনও বই কিনেছেন?’’ চাঁচাছোলা গলায় ফের প্রশ্ন করলেন মানিক।
‘‘না, কিনে পড়িনি, সবই এর ওর কাছ থেকে চেয়ে কিংবা লাইব্রেরি থেকে। কলেজ ছাত্রদের অত বই কেনার টাকা কোথায়’’?
‘‘তবে! পাঠকেরা কেউ বই কিনবেন না, প্রকাশক বলবেন বই বিক্রি হয় না, টাকাটা আসবে কোথা থেকে? লেখকের ঘরটাও তাই এমনই থাকবে। দুঃখ পেলে চলবে কেন?’’
মানিকের কথায় মাথা নিচু করল সেই তরুণ ছেলেটি।
ঠিক তখনই মানিক দরাজ গলায় বলে উঠলেন, ‘‘বলুন এবার কী জন্য এসেছেন? গল্প চাই একটা’’?
এ বার নিজের নাম পরিচয় দিয়ে পাঠচক্রের কথা জানাল সে। মনে মনে প্রস্তুতই হয়ে গিয়েছিল যে এই আমন্ত্রণে মানিক সাড়া দেবেন না।
কিন্তু তাকে একেবারে চমকে দিয়ে মানিক বললেন, ‘‘ঠিক আছে যাব। কোথায় কবে কখন সব লিখে দিয়ে যান চিরকুটে।’’
এ বার আনন্দে উচ্ছ্বসিত তরুণ বলল, ‘‘আমরা এসে নিয়ে যাব আপনাকে।’’
কিন্তু অবাক হওয়ার আরও কিছু বাকি ছিল তার। মানিক বললেন, ‘‘কিচ্ছু দরকার নেই। আপনারা পয়সা পাবেন কোথায়? যেতে পারব একাই। পথনির্দেশটা শুধু রেখে যান।’’
তারপর আরও দু-চারকথা সেরে লেখকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল সেই কলেজ পড়ুয়া যুবক।
ফেরার সময় বাসভাড়াটুকু পকেটে থাকলেও আর বাসে চাপতে ইচ্ছে হল না তার। শরীর আনন্দে যেন পালকের মতো হালকা হয়ে গেছে। ওই বরানগর থেকে হাঁটতে হাঁটতেই কলেজস্ট্রিট, সেখান থেকে বউবাজারে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে তারপর কলেজ।
বন্ধুদের হইহই করে জানাল সেই বিজয়বার্তা। সেদিনের সেই উনিশ বছরের তরুণের নাম শঙ্খ ঘোষ।
ঋণ: শঙ্খ ঘোষের ‘জীবনের জলছবি’