নাটকের একটি দৃশ্য। —নিজস্ব চিত্র।
গত ১৪ জুলাই অ্যাকাডেমির প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চস্থ হল অঁসম্বল নাট্যগোষ্ঠীর নাটক— ‘ভীতি’। এই নাটকের ভাবনা, সামগ্ৰিক পরিকল্পনা ও নির্দেশনা সোহাগ সেনের। এটি একটি কর্মশালাভিত্তিক প্রযোজনা। প্রখ্যাত জার্মান নাট্যকার বার্টোল্ট ব্রেখটের (১৮৯৮-১৯৫৬) ‘ফিয়ার অ্যান্ড মিজ়ারি অফ দ্য থার্ড রাইখ’ (১৯৩৮) নাট্যগুচ্ছ থেকে ‘দ্য জুইশ ওয়াইফ’ ও ‘দ্য স্পাই’ বা ‘দি ইনফর্মার’— এই নাটিকা দু’টি ‘ভীতি’ নাটকটির অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করলেও এই ভীতি নাটকে উঠে এসেছে বাংলার সাম্প্রতিক সমাজের একটি খণ্ডচিত্র, যা আমাদের সামনে একটি আয়না তুলে ধরে। আমাদের ঠেলে দেয় নীরব বিশ্লেষণের দিকে।
‘ভীতি’ নাটকটিতে দু’টি কাহিনিসূত্র একে অপরের সঙ্গে সংলগ্ন। নাটকটির পর্দা ওঠে একজন বিত্তশালী বাঙালির ফ্ল্যাটে। সেখানে দুই বন্ধু— রণ ও দিব্য এবং তাদের দুই স্ত্রী শর্মিষ্ঠা ও আফরিন আড্ডা দিচ্ছে। রণ অর্থনীতির অধ্যাপক, দিব্য সরকারি আমলা। শর্মিষ্ঠাও চাকুরে, আফরিন সমাজকর্মী। রণ আর শর্মিষ্ঠার একমাত্র পুত্র অন্তু কলেজে পড়ে। নাটক কিছুটা এগোলে আমরা ক্রমশ এদের জীবনের সমস্যাগুলো সম্পর্কে অবগত হই। রণ ও শর্মিষ্ঠার জীবনের সমস্যা হল অন্তু। সে উচ্ছন্নে যাচ্ছে। সে রণ-শর্মিষ্ঠার নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিজস্ব জগতে ডুবে আছে। রণ-শর্মিষ্ঠা ভয় পায়। কী হবে অন্তুর ভবিষ্যৎ? যে ছেলেগুলো মাঝরাতে বাইক ফটফটিয়ে অন্তুকে বাড়ি ছেড়ে যায়, তারা কারা? অন্তু কোন চক্রে পড়েছে? এই ভয় থেকে শুরু হয় পরস্পরকে দোষারোপ। কার দায়িত্ব কে নেয়নি? কার অমনোযোগের ফলে অন্তু এমন হল? অন্য দিকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমৃত্যু নিয়ে আন্দোলন চালায় দিব্যর স্ত্রী, সমাজকর্মী আফরিন। এ দিকে কনিষ্ঠ সরকারি আমলা হিসেবে দিব্য পায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ। কিন্তু স্বাধীনচেতা আফরিনের সরকার-বিরোধিতা দিব্যর কেরিয়ারকে নাড়িয়ে দেয়। সরকার দিব্যকে তার স্ত্রীর কার্যকলাপের জন্য সন্দেহ করে। দিব্য ভয় পায়। সে দিশেহারা হয়ে যায়। এর পর কী ঘটে রণ-শর্মিষ্ঠা ও দিব্য-আফরিনের— সেটাই এ নাটকের বিষয়বস্তু।
ভীতি নাটকটি একটি মিনিম্যালিস্টিক নাটক। এখানে মঞ্চ প্রায় নিরাভরণ। সাজসজ্জার আয়োজন যৎকিঞ্চিৎ। প্রখ্যাত ইংরেজ নাট্য-নির্দেশক পিটার ব্রুক (১৯২৫-২০২২) তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে এক সময়ে নাট্য নির্দেশনা করতে গিয়ে তিনি অনুভব করেছেন— ‘দ্য হিউম্যান বিয়িং ইজ় রিচার দ্যান দ্য গ্ৰেটার স্টেজ এফেক্টস দ্যাট এগজিস্ট’— অর্থাৎ মানবচরিত্র মঞ্চের কলাকৌশলের চেয়ে ঢের বেশি সম্পদশালী। এর ফলে তিনি ক্রমশ মঞ্চকে নিরাভরণ করে তোলেন। ভীতি নাটকেও এই মিনিম্যালিজ়মের প্রয়োগ রয়েছে।
এই নাটকে রণর ভূমিকায় সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় অভিনয়ের নানা সূক্ষ্মতার স্তর দক্ষতার সঙ্গে ছুঁয়ে গিয়েছেন। তবে তাঁর ‘লুক’টি অন্য রকম হলে হয়তো চরিত্রটি নতুন মাত্রা পেতে পারতো বলে মনে হয়। শর্মিষ্ঠার ভূমিকায় সুতপা ঘোষ দৃপ্ত। দিব্যর চরিত্রে জটিলতার পরতগুলো কৌশিক বসুর অভিনয়ে ফুটে উঠেছে। আফরিনের ভূমিকায় সোমা মুখোপাধ্যায় ভাল করেছেন, কিন্তু তাঁর স্বরক্ষেপণ আর একটু জোরালো ও স্পষ্ট হলে ভাল হয়। অন্তুর রাগ, ঘৃণা, তাচ্ছিল্য— বিশাল চক্রবর্তীর অভিনয়ে প্রাণ পেয়েছে। ভাল লেগেছে নাটকের মধ্যে সুজয়প্রসাদের গান। নাটকে ঘন ঘন মদ্যপান একটু চোখে লেগেছে। কিছুক্ষেত্রে এই মদ্যপানের ব্যবহার নাটকটিতে কোনও বিশেষ মাত্রা যোগ করেনি বলেই মনে হয়। নাটকে বাবলু সরকারের আলো, কৌশিক সজ্জনের আবহ-প্রক্ষেপণ যথাযথ। সোহাগ সেনের নির্দেশনায় সমগ্ৰ নাটকটিতে একটি ছিমছাম মেদহীনতা ও তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী গভীরতা পরিলক্ষিত হয়।
আমাদের চারপাশে খুব প্রত্যক্ষ ভাবে এখন ভয়কে অনুভব করি আমরা। নানা ধরনের ভীতি আমাদের জীবন, অস্তিত্ব ও চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, কুরেকুরে খাচ্ছে। সোহাগ সেনের ‘ভীতি’ নাটকটি এই সময়ের একটি দগদগে ছবি তুলে ধরে। দ্রুত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং অস্থিরতার মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছে জীবন। মানুষ নিজেকে আপাত-নিরাপদ ভেবে শান্তি পাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ কখনও এই সুস্থিরতায় চিড় ধরলেই অস্তিত্ব-গর্ভস্থিত অন্ধকার থেকে উঠে আসছে ভীতি, যা থেকে পালানোর পথ থাকছে না।