Rabindra Sadan

রঙিন ছায়ার আচ্ছাদনে

রবীন্দ্রনাথের কাজের সঙ্গে উপমহাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের বাস্তুতন্ত্র শুরুর সময় থেকেই নানা ভাবে প্রভাবিত, সংযুক্ত। চলচ্চিত্র তার ব্যতিক্রম নয়। সবাক ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রায় প্রথম থেকেই গান বড় ভূমিকা নিতে শুরু করেছে।

Advertisement

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৪ ০৯:১৮
Share:

অনুষ্ঠানে নৃত্যরত শিল্পীরা। —নিজস্ব চিত্র।

প্রভাব, অনুকরণ, অনুসরণ— শব্দগুলো বেজায় আপেক্ষিক। কলাশিল্পে সে আপেক্ষিকতা কখনও বিতর্কিত, কখনও অবহেলিত, কখনও বিস্মৃত, কখনও বা নবতর আঙ্গিকের সূচিমুখ। গানের ক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে তার উদাহরণ দেখা গিয়েছে। উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় কাঠামোর গানবাজনা, ইউরোপীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত কিংবা বিশ্বের নানা প্রান্তের অবিনশ্বর লোকগান— একই ইতিহাসের সাক্ষী। অবশ্য প্রভাবিত হওয়ার ভাবনা তখনই আসে, যখন রচনাটি কোনও যুগান্তকারীর। রচয়িতাদের নাম কিছু ক্ষেত্রে হয়তো অজানাও থাকে, হয়তো বা ‘প্রচলিত’ তকমায় অরক্ষিতও। তবু মূল্যবান বলেই তাদের অনুকরণ হয়, অনুসরণের যোগ্য বলেই অনুসৃত হয়, স্থায়ী সৃজন-বিভাবের কারণেই প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। রবীন্দ্রনাথের গান তেমনই এক বিশ্বসম্পদ। আর সেই কারণেই কবির সমসময় থেকে আজ পর্যন্ত টানা তা নানা ভাবে রেশ রেখে গিয়েছে অন্যদের গানে, অন্যদের সুরে। প্রথমে উল্লিখিত শব্দগুলির কোনও না কোনও রঙিন ছায়া তার গায়ে লেগেছে।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথের কাজের সঙ্গে উপমহাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের বাস্তুতন্ত্র শুরুর সময় থেকেই নানা ভাবে প্রভাবিত, সংযুক্ত। চলচ্চিত্র তার ব্যতিক্রম নয়। সবাক ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রায় প্রথম থেকেই গান বড় ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। আর সেই সূত্রেই পরে বারবার ঘোষিত-অঘোষিত ভাবে রবীন্দ্রনাথের ডাক পড়েছে। কবির মৃত্যুর পরেও সে ডাক থামেনি। থামেনি আজও। সরাসরি রবীন্দ্রনাথের গানই শুধু নয়, রবীন্দ্রনাথের সুর, রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বা ভাবের অংশবিশেষ— সবই নানা ভাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে রুপোলি পর্দায়। হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের বহু নামী, পেশাদার সুরকার-গীতিকারেরা বারে বারে রবীন্দ্রনাথ ছুঁয়েছেন। সময় কখনও তাঁদের সেই কাজকে ‘চুরি’ বলেছে, কখনও প্রভাবিত, কখনও বুঝে উঠতে অপারগও হয়েছে।

রবীন্দ্রগানের প্রভাবে তৈরি এমনই একগুচ্ছ গান নিয়ে সম্প্রতি কলকাতার রবীন্দ্রসদনে আয়োজিত হল ভবানীপুর বৈকালী সংস্থার ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবর্ষের অনুষ্ঠান ‘গোপনে সৌরভী’। ব্যতিক্রমী এই আয়োজন সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত। পাশাপাশি পরিবেশিত হল রবীন্দ্রনাথের গান এবং তার প্রভাবে বা অনুসরণে তৈরি হিন্দি ছায়াছবির গান। সঙ্গে ছিল গ্রন্থনা-ভাষ্য, যা মূল গানের ইতিহাস ছুঁয়ে যাচ্ছিল এবং তৈরি হয়ে ওঠা হিন্দি গানটির ছবির নাম, সুরকারের নাম, গীতিকার এবং ছবির পরিচালকের নাম, বিবরণ ও অনুষঙ্গ-কথা তুলে ধরছিল। রবীন্দ্রনাথের যে গানগুলি নির্বাচন করা হয়েছিল, তা বাঙালির অতি-পরিচিত। প্রভাবিত হিন্দি গানগুলিও অপরিচিত নয়। পঙ্কজকুমার মল্লিক, অনিল বিশ্বাস, শচীন দেববর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, রাজেশ রোশন থেকে শুরু করে শান্তনু মৈত্রের সুরে তৈরি কিছু হিন্দি গান নির্বাচন করা হয়েছিল। যদিও প্রভাব-তালিকা এর বাইরেও বহু বিস্তৃত। বহু ক্ষেত্রেই হিন্দি ছায়াছবির এই গানগুলি দীর্ঘ সময় ধরে দেশ-উপমহাদেশের মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। তবে কিছু গানের ক্ষেত্রে এ কথাও প্রযোজ্য যে, তারা যে রবীন্দ্র-প্রভাবিত, তা আজও আধো-জানা, অজানাও। রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার হল শুরু’র প্রভাবে যে রাকেশ কুমারের ‘ইয়ারানা’ ছবিতে রাজেশ রোশনের সুরে ‘ছুঁ কর মেরে মনকো’ বা ‘যদি তারে নাই চিনি গো’র অনুসরণে যে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘অভিমান’ ছবিতে শচীন দেববর্মণের সুরে ‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে’, তা বহু বাঙালিরই জানা। কিন্তু সম্ভবত খুব একটা পরিচিত পরিধিতে নেই যে, ‘একদা তুমি প্রিয়ে’র রঙিন ছায়া পড়ে রয়েছে বিমল রায়ের ‘সুজাতা’ ছবিতে শচীন দেববর্মণের সুরে ‘জ্বলতে হ্যায় জিসকে লিয়ে’তে বা ‘যেতে যেতে একলা পথে’র মল্লার-গন্ধ লেগে বিমল রায়ের ‘প্রেমপত্র’ ছবিতে সলিল চৌধুরীর সুরে ‘শাওন কি রাতোঁ মে’ গানে।

Advertisement

এ সন্ধ্যার পরিবেশনায় রবীন্দ্রনাথের মোট ১৩টি গান বেছে নেওয়া হয়েছিল এবং তাদের প্রভাবে তৈরি ১৩টি হিন্দি গান, যাদের গায়ে কবির সুরের এবং কিছু ক্ষেত্রে কাব্যেরও খোদাই-কাজ সুস্পষ্ট, সুচিহ্নিত, আবার কিছু অগোচর আলিম্পনের প্রভাবে ঋদ্ধও। গানের পরিবেশনায় ছিল ভাবনা আর যত্নের স্পষ্ট ছাপ। রবীন্দ্রনাথের গান এ সন্ধ্যার আয়োজনের শিল্পীরাই গাইছিলেন যেমন, হিন্দি গানগুলিও একই ভাবে মঞ্চে গাওয়া হচ্ছিল, পুরনো রের্কড বাজানো হচ্ছিল না। বিস্মিত করছিল হিন্দি ছবির গানগুলির বিস্মৃত সঙ্গীতায়োজনের অবিকৃত উপস্থাপনা। হিন্দি গানগুলির মূল সঙ্গীতায়োজনের অনুরূপ বয়ানের ‘ট্র্যাক-রেকর্ড’ তৈরি করে তার সঙ্গে গাইছিলেন শিল্পীরা। ফলে পরিবেশনার মেজাজ ফিরে যাচ্ছিল দশকান্তরে। আরও একটি বিশেষত্ব, হিন্দি গানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছবির ভিডিয়ো-ক্লিপ প্রদর্শন। প্রথমত, ভাবনাটি দারুণ। দ্বিতীয়ত, ভাবনাটি কঠিন। কারণ, এ ক্ষেত্রে ছবির চরিত্রেরা ‘লিপ’ মেলাচ্ছিলেন না, বরং সে সন্ধ্যায় প্রেক্ষাগৃহের শিল্পীদের গাওয়া জীবন্ত গানই অবিকল মিলে যাচ্ছিল ছবির চরিত্রদের গায়নভঙ্গির সঙ্গে। কোনও ক্ষেত্রেই কণ্ঠ আর দৃশ্যের মিলন-রসায়নে বিঘ্ন ঘটেনি। এ ছাড়া মূলত রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে ছিল নাচের উপস্থাপনাও। শতাধিক শিল্পীর কণ্ঠে এবং কুড়ি জনেরও বেশি নৃত্যশিল্পীর উপস্থাপনায় সব মিলিয়ে উপভোগ্য পরিবেশনা। কণ্ঠশিল্পীরা প্রত্যেকে স্বতন্ত্র ভাবে সুন্দর, সম্মিলিত ভাবেও মধুর। একই মাধুর্য নৃত্যশিল্পীদেরও।

পুরো আয়োজনের ভাবনা, গবেষণা ও নির্দেশনার জন্য প্রমিতা মল্লিক এবং অনবদ্য সাউন্ডস্কেপ তৈরির জন্য সুব্রত মুখোপাধ্যায় বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখেন।


আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement