Sourced by the ABP
চারুবাসনার চিত্তপ্রসাদ গ্যালারিতে সম্প্রতি আত্ম-অন্বেষণের বিশেষ দৃষ্টান্ত রাখলেন দুই শিল্পী, তাপস কোনার এবং শাইনি মিসাকো। ‘থ্রু দ্য সার্কল’ শিরোনামের এই প্রদর্শনীতে দু’জনের ছবিতে প্রাথমিক ভাবে যা উঠে আসে, তা রবীন্দ্রনাথের আত্মদর্শন। দু’টি দেশের স্বতন্ত্র ধারা হলেও, সেই চেতনার মূলে রয়েছে জাপান ও ভারতের মিলিত সংস্কৃতি।
শিশুবয়স থেকে মিসাকো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শন এবং চিন্তাবিদ ওকাকুরার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের শিল্প-ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী হন। উপলব্ধি করেন, এই দুই দিশারীর ভাবনার আদানপ্রদানে শিল্পজগৎ যে ভাবে উন্নত হয়েছে, তা অবর্ণনীয়। ১৯৮৭ সালে জাপানি দৃশ্যকলা নিয়ে উত্তীর্ণ মিসাকো গত ১০-১১ বছর ধরে ভারতে আসা-যাওয়ার সুবাদে এ দেশকে নিজের দ্বিতীয় মাতৃভূমি বলে মনে করেন। জাপানের এই শিল্পী নিজের কাজ নিয়ে বিভিন্ন রাজ্য ও দেশে প্রদর্শনের পাশাপাশি, আমন্ত্রিত কর্মশালায় সুমি কালির সেরা ব্যবহারিক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করে চলেছেন। নিজস্ব চিত্রকর্মে সুমি কালির অনিবার্য ব্যবহার প্রসঙ্গে শিল্পীর বক্তব্য হল— রং হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু, কোনও জিনিসের সারকথা নয়। ভাবনার সঙ্গে সুমি কালি মিশিয়ে ভিতরের চেতনকে তুলে ধরেন মিসাকো।
মিলন-মহান: চারুবাসনায় আয়োজিত যৌথ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
প্রদর্শনীতে শাইনি মিসাকোর কাজগুলি ছিল প্রকৃতিনির্ভর। তার মধ্যে জলপ্রপাত, পাখি ও গাছ ছাড়া রয়েছে বিশেষ অর্থ নির্ণীত কিছু ফুল। মানবতার মূল অভিযানে মুমূর্ষু ফুলের কাছে এগিয়ে যান তিনি। ফুলের গুণাবলির নির্যাস নিয়ে তাকে সর্বজনীন স্বচ্ছতায় মেলে ধরেন। তাঁর এই বিচরণ এতটাই সহজ যে, সুমি কালি শুধু কালো কালি না হয়ে, প্রকারান্তরে সমস্ত রঙের প্রতিনিধিত্ব করে। আর একটি ভাল লাগার মতো ছবি না উল্লেখ করলেই নয়, তা হল— ছিটিয়ে দেওয়া বিন্দু বিন্দু কালির পরাগরেণুর উপরে আছড়ে পড়া একটি কাকের আকর্ষক ভঙ্গি। এ সমস্ত কিছুর মার্জিত উদাহরণে ছিল শিল্পীর কুড়িটি অসামান্য ছবি।
গ্যালারির আর এক অন্যতম বিশিষ্ট চিত্রকর তাপস কোনারের কাজে শূন্য থেকে ফর্ম, আবার ফর্ম থেকে শূন্যে আসার প্রবণতা ক্রমশ প্রকাশ পায় ছবির আক্ষরিক সংজ্ঞা ছাপিয়ে। অধিবাস্তবতার পথে তাঁর কাজ ঘূর্ণন গতির প্রভাবে নানা ফর্ম নেয়।
শিল্পীর দশটি কাজের মধ্যে কিছু কাজ রবীন্দ্রনাথের বৌদ্ধিক চেতনার তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়। যেমন, বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের সাধনপ্রণালী হিসেবে রচিত চর্যাপদ-চর্চায় ব্যক্ত ছবির রাগসঙ্গীত। উদাহরণে ছিল, হ্যান্ডমেড পেপারের উপরে মিশ্র মাধ্যমে করা ‘সেরিমনি অব দ্য সাফিশিয়াল স্পেস’। ‘র-সায়না’র আলোছায়ায় পর্যবসিত যোগীর দেহের জয়েন্টগুলির আবেগ রাগসঙ্গীতের মূর্ছনায় তৈরি। আর একটির উল্লম্ব গঠন, সচরাচর দেখার স্তরকে নস্যাৎ করে দিয়ে বোল্ড রেখার বিবর্তনে হাঁটা দেয়। রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপির কাটাকুটির ফর্মের প্রভাব দেখা যায় শিল্পীর নিজস্ব রৈখিক রচনায়।
‘থিঙ্কার ইন ফ্রন্ট অব আ বার্ড’ ছবিতে অত্যন্ত আকর্ষণ করে লম্বা ঠোঁটওয়ালা অদ্ভুত পাখিটি, যার পদক্ষেপ এবং তির্যক চাউনির কাছে বাকি অনুজ্জ্বল উপাদান ঢেকে যায়। একটি ছবি অনেক অর্থ নিয়ে দেখার আগ্রহ বাড়ায়। যেমন একটি ফিগারের পাশাপাশি এসেছে একাধিক চোখ। অতিচেতনের সুপ্ত প্রকাশ ডানা মেলে ওড়ে।
মসৃণ আলোছায়ায় নানা ডট ও রেখা কোনও নির্ধারিত অনুশাসনের লেআউট নিয়ে আসেনি। প্রচণ্ড ভাবে ইনোসেন্স কাজ করেছে। প্রতিটি ফর্ম, আর একটি নতুন ফর্মের চাহিদা নিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়। রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’, ‘মুক্তধারা’, ‘অচলায়তন’-এর মূল ভাব নিয়ে ছবি পরপর আসতে থাকে। কাগজের উপরে ন্যাচারাল স্টেইন কালারের কষ এবং ভেষজ উপাদানের সংমিশ্রণে ব্যালান্স করে, ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে প্রাপ্ত অর্জিত শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যান। কিছু কাজে ছেঁড়া কাগজের এফেক্টে মনে হয় পেস্টিং করা, বাস্তবে আদৌ তা নয়। কাগজের বেসিক স্কিন রেখেই, হাইলাইট ছেড়ে নানা রকম ভগ্নাংশকে জীবজগতের রূপ দিয়েছেন শিল্পী।
একঘেয়েমি দেখতে দেখতে যখন ক্লান্ত হয়ে যায় চোখ, সেই সময়ে তাপস কোনারের চিত্রভাষা সঙ্গীতের স্বরক্ষেপণের মতো ওঠানামা করে। আবার শাইনি মিসাকোর প্রাঞ্জল অথচ গভীর ভাবাবেগের প্রকাশও দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। সব মিলিয়ে সার্থক প্রদর্শনী।