প্রতীকী: বিড়লা অ্যাকাডেমিতে ‘কালার্স অব উইন্টার’ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম
বিড়লা অ্যাকাডেমির এই দলীয় প্রদর্শনীটি একটু অন্য রকমের। এটির কিউরেটর শুভঙ্কর সিংহ, যিনি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হলেও সেই পেশা ছেড়ে চিত্রশিল্প নিয়েই থাকেন এবং আর্টভার্সের উদ্যোগে বহু নবীন এবং বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পীকে লোকসম্মুখে নিয়ে আসেন। এ ছাড়া শিল্পী শুভঙ্কর নিজেও বিভিন্ন প্রদর্শনীতে যোগদান করে থাকেন। ৬৮জন শিল্পী, যাঁদের মধ্যে চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, আলোকচিত্রী সকলেই রয়েছেন, তাঁদের নিয়েই বিড়লা অ্যাকাডেমির প্রদর্শনী ‘কালার্স অব উইন্টার’ উপস্থাপিত হয়েছিল সম্প্রতি।
প্রথমেই যাঁর কথা বলতে হয়, তিনি ডা. রঞ্জন বসু। নিসর্গ, প্রকৃতি নিয়ে ছবি আঁকেন। নিসর্গচিত্রে একটু অন্য রকম ভাব নিয়ে আসতে শিল্পী সক্ষম। তাঁর একটি চিত্রকর্মের নাম ‘টুওয়ার্ডস ইনফিনিটি’ অর্থাৎ ‘অনন্তের দিকে’। বেশ মনোগ্রাহী ছবিটি। অল্প রঙের ব্যবহার দর্শকের মনকে উদাস করে।
প্রসূন অধিকারীর একটি ছবিতে একত্রিত করা হয়েছে নানা পশুকে, যেমন বাঘ, সিংহ, হরিণ, জিরাফ, হাতি ইত্যাদি। কারণ এই সব পশু মানুষের বন্দুকের সামনে নিরাপদ নয়। এই অন্ধকারের প্রাণীরা দিনের আলোয় দৃশ্যমান হলে ওদের প্রাণ সংশয় হতে পারে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে একটি জোনাকির আলোতেও তাদের উজ্জ্বলতা বাড়ে। শিল্পী প্রসূন নিজেকে ওই ছবিতে বসিয়েছেন ওই অন্ধকারের পশুদের পাশেই। সেই পশুর দঙ্গলের সঙ্গে জোনাকি এঁকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, আলোতে তাদের উজ্জ্বল করা নিরাপদ নয়, এতে প্রাণসংশয় হতে পারে। অ্যাক্রিলিকে করা ক্যানভাসের উপরে সাদাকালোর একবর্ণী কাজ।
অভিষেক মিত্রর চারটি ডিজিটাল কম্পোজ়িশন নজর কাড়ে। ছবি তুলে সেগুলিকে সোজাসুজি পরিবেশন না করে সাজিয়েগুছিয়ে এক অন্য মাত্রা দেওয়া হয়েছে। তার ‘মিসিং লিঙ্ক’ বা ‘ইলিউশন’ ছবির গঠনে বেশ আকর্ষক এক ধরনের চিত্রবিভ্রম ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
সুস্মিতা পালের তিনটি ছবি। মূল বিষয়বস্তু থ্রেড বা সুতো। শিল্পী বলতে চেয়েছেন যে, আমরা আশপাশের মানুষগুলির সঙ্গে নানা সূত্রে গাঁথা হয়ে পড়ছি সারা জীবন ধরে। ধীরে ধীরে সেই সুতোগুলি ছিঁড়তে থাকে, আলগা হয়ে খসে খসে পড়ে। সুস্মিতা বলছেন যে, শেষ পর্যন্ত সুতোর বাঁধন অর্থাৎ সম্পর্ক হয়তো নিজের সঙ্গেই স্থাপন করতে হয়। তখন শুরু হয় নিজেকে চেনার পালা। মিক্সড মিডিয়ায় বেশ সাহসী কাজ। ভাবনাচিন্তার ছাপ রয়েছে তরুণ শিল্পীর কাজে।
তুহিন দাস সম্ভবত এই দলের সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী। তাঁর হাতের চারকোল এবং পেন্সিলে করা দু’টি প্রতিকৃতি প্রদর্শনীতে দেখা গেল— একটি উৎপল দত্তের এবং অন্যটি সত্যজিৎ রায়ের। সম্ভাবনাপূর্ণ কাজ।
সৌরিন কর্মকারের একটি পেন অ্যান্ড ইঙ্ক ড্রয়িং চোখ টানে, যেটিতে তিনি তানসেনকে মধ্যে রেখেছেন। মিয়াঁ তানসেন দীপক রাগ গেয়ে আগুন জ্বালিয়েছেন এবং ওঁর সঙ্গীরা মল্লার রাগ গেয়ে বৃষ্টি নামাচ্ছেন। একটি বিমূর্ত লাইন ড্রয়িং পরিবেশন করেছেন।
প্রদর্শনীর একেবারে মাঝখানে চোখে পড়ে সুদীপ্ত অধিকারীর ক্যানভাসের উপরে অ্যাক্রিলিকে করা একটি কাজ— ‘অনন্তের সন্ধানে’। একবর্ণীয় বা মোনোক্রোম্যাটিক কাজ, শুধু মাঝখানে একটু লালের ছোঁয়া— নাটকীয়তা আছে কাজটিতে। যে ভাবে রংটুকুর ব্যবহার দেখা যায়, সেখানে শিল্পী নিজেকে যথেষ্ট সংযত রেখেছেন, সেখানেই তাঁর কৃতিত্ব।
এ ছাড়া চোখে পড়ার মতো কাজ আরম্ভিক ঘোষের আলোকচিত্র। এখানে ডিজিটাল সাহায্য ছাড়াই শিল্পী একটি ছবিতে দেখিয়েছেন, এক পুরুষ তার সর্বাঙ্গ প্লাস্টিকে মুড়ে ছুটে চলেছে। যেমন মানুষ সব সময়ে বাধা-বিপত্তি পার করে গতিশীল থাকে। শিল্পীর ভাবনা-চিন্তা যথেষ্ট পরিণত। অর্পণ ঘোষের টেরাকোটার হ্যারিকেনটি আকর্ষণ করে।
প্রদর্শনীর নামের অর্থ, শীতকালের রং। প্রদর্শনীটি যেন গাঢ় রঙের মেলা। শিল্পীর চোখে সব কিছুই বর্ণময় হতে পারে। এই কারণেই কিউরেটর শুভঙ্কর সিংহ ৬৮জন শিল্পীর ১৭৯টি শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর নাম রেখেছেন নিজের কল্পনার রং দিয়ে।