নিশাচর: বিমল কুণ্ডুর একক প্রদর্শনী
পেঁচা বা পেচক পক্ষিবিশ্বে অদ্বিতীয়। যদিও ‘ঠোঁটে ছুরি পায়ে বঁড়শি লক্ষ্মী দেবীর রক্ষী / চোখেমুখের গড়ন দেখে মনে হয়না পক্ষী’ যোগীন্দ্রনাথ সরকার এই ছড়ায় পেঁচাকে পাখি হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। অনেকেরই এমন আপত্তি। পেঁচা আবার পাখি! সে যাই হোক, দেবী লক্ষ্মীর এই বাহনকে ঘিরে অজস্র কাব্য-কাহিনি, রূপকথা, উপকথা, কাব্যগাথা থেকে চিত্র-ভাস্কর্যের এমন উদাহরণ— যা বিপুল ও বিস্ময়কর। পেচক-রূপ নিয়ে শিল্পী-ভাস্কররা যুগ যুগ ধরে যা সৃষ্টি করে চলেছেন, এক কথায় তা অভূতপূর্ব। নিত্যনতুন চেহারা, স্টাইল ও টেকনিকে পেঁচা একমেবাদ্বিতীয়ম।
শিল্পকলার পৃথিবীতে পেঁচার আশ্চর্য সব নির্মাণ ঘিরে যে কৌতূহল ও সংগ্রহ, যে উন্মাদনা ও প্রদর্শনের আগ্রহ, যে বাজার ও ক্রেতা-বিক্রেতার আদানপ্রদান তথা ব্যবসা, তা একমাত্র গণপতি ছাড়া অন্য কিছুতে নেই।
দেবভাষা কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি এই পেঁচা নিয়েই বিমল কুণ্ডুর একক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। ২০১৯-এর সেরা বাঙালির তালিকায় তিনিই একমাত্র ভাস্কর। তাঁর প্রদর্শনীতে স্বভাবতই পেঁচার বিবিধ ভাস্কর্য থাকার কথা। সদাব্যস্ত এই শিল্পী এক মাসের কম সময়ে স্বাভাবিক করণকৌশলগত কারণেই ব্রোঞ্জের কাজ বেশি করে উঠতে পারেননি। প্রদর্শনীতে তিনি ২১টি ড্রয়িং ও দু’টি ব্রোঞ্জের কাজ রাখতে পেরেছেন। একজন ভাস্করের ড্রয়িংয়ের প্রদর্শনী ক’টিই বা দেখা গিয়েছে কলকাতায়! সেই হিসেবে যথেষ্ট উপভোগ্য তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী।
কালো পেনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অর্বুদ রেখার ঘূর্ণনে ভাস্কর্যগুণ স্পষ্ট। ছায়াতপের ভিন্ন ধরনের স্তর তৈরি করে, অপেক্ষাকৃত প্রয়োজনীয় গাঢ়ত্বের ক্রমান্বয়ে তিনি পাঁচটি পেচক এঁকেছেন। দু’টি ছোট-বড় ব্রোঞ্জ। বাকি সব ফেল্ট, মার্কার ও কালো পেনের ড্রয়িং। এগুলি সব রেখাঙ্কনধর্মী। কাজগুলির মধ্যে তাঁর নিজস্বতাকে সচেতন ভাবে রক্ষা করেছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার নানা পর্বে, একটি বা একাধিক পেঁচার সহজাত ফর্মের সনাতনী ভাবনাকে মাথায় রেখেই, নিজের মতো করে ওই রূপগুলিকে বিবর্তিত করেছেন। এই বিবর্তনের বৈচিত্রে কিন্তু একটি পরিচিত রূপের আদলকে কী ভাবে কোথায় ভাঙতে হবে বা রাখতে হবে অন্যরকম ভাবে, কতটা গ্রহণ-বর্জন করে নতুনত্ব আনা যায়, এইসব দিক নিয়েই অনেক পরীক্ষা ও চর্চা করেছেন। ড্রয়িংগুলি দেখে মনে হয়, পেঁচার এত রকম স্টাইলে তিনি একঘেয়েমিকে পরিহার করতে চেয়েছিলেন। ফলে নিজস্ব নিরীক্ষার আঙ্গিকে তারা নিত্যনতুন। পেঁচাকে তিনি বিভিন্ন ভাবে স্টাডি করেছেন।
পেঁচা তো প্রথম থেকেই লক্ষ্মীর বাহন ছিল না। প্রাচীন শিল্প-সাহিত্যে পেঁচা অনুল্লিখিত। কুষাণ যুগের এক লক্ষ্মীমূর্তিতে পেঁচা আবিষ্কৃত। অর্বাচীন কালেই সে লক্ষ্মীর বাহন হয়েছে, সে বিস্তর ইতিহাস। কিন্তু অজস্র ডাকটিকিট ও মুদ্রায় পেঁচা বিশ্বের বহু দেশে বহুকাল ধরেই প্রচলিত।
বিমলের ব্রোঞ্জের বড় ভাস্কর্যে সটান দাঁড়ানো পেঁচার আভিজাত্য ও সপ্রতিভতা, বিশেষ করে মেজাজটি ভীষণ ভাবে অক্ষুণ্ণ। এখানে ব্যক্তিত্বের প্রখরতা ও দৃপ্ত ভঙ্গির মূল জায়গাটিই ওই জ্যামিতিক বিন্যাস। কপাল, চোখ, ঠোঁট, বুক, দু’পাশের ডানা ও পা-দু’টিতে যে জ্যামিতি তিনি নির্মাণ করেছেন, তা অসাধারণ। অনুরূপ ভাবনা কাজ করেছে ছোট ব্রোঞ্জটিতেও। চরিত্রে, স্টাইলে, কম্পোজ়িশনে, বর্ণেও দু’টি দু’রকম। ছোটটির অতিকাব্যিক জ্যামিতি, ডাইমেনশন, ফর্মেশন অন্যরকম। অসামান্য ভাস্কর্য।
রেখাঙ্কনের কাজগুলিতে টানটোনের স্বাচ্ছন্দ্য, স্পেস নিয়ে ভাবনা, রূপের অন্তর্গত স্পেসে নকশাময় আলিম্পনের মোটিফ প্রাধান্য পেয়েছে। পৌত্তলিকতা ও লোকজ গ্রামীণ শিল্পের এক বাতাবরণ মিলেমিশে আছে। ইলাস্ট্রেশনের বিভ্রমকে ভাঙতে চেয়েছেন। হয়তো সবটা পারেননি, তবু একটা পরিবর্তন এনেছেন স্টাইলকে নানাভাবে দেখাতে গিয়ে। উল্লেখ্য যে, তীক্ষ্ণ নখরযুক্ত পা না এঁকে স্টাইলাইজ় করেছেন। রূপান্তরে, শিশুসুলভ অঙ্কনের দ্রুততায় এমনকি বকের মতো সরু, লম্বা পা-ও এঁকেছেন। তাঁর লাইনগুলি রূপান্তরের মাধ্যমে যে গতিকে দিকনির্দেশ করছে— লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেই বঙ্কিম, তরঙ্গায়িত, দ্রুত, সর্পিল, আধাবর্তুল-বর্তুল, ভঙ্গুর, অলঙ্কৃত গ্রাম্যলৌকিক শিল্পের সংকেতময় কিছু চিহ্ন অত্যল্প পরিসরেও একটি চমৎকার ডিজ়াইনের রূপ নিয়েছে। তা একেবারেই তাঁর সেই নির্দিষ্ট রচনাটির ক্ষেত্রেই যেন প্রযোজ্য ছিল। সমগ্র রেখাসৃষ্ট সরলীকরণ প্রক্রিয়ায় নিহিত যে পেচক রূপ, তার পরতে পরতে কিন্তু ভাস্কর্য-গুণান্বিত এক স্বাভাবিক ফর্ম লক্ষ করা যায়। সমগ্র সরলীকরণের স্বতঃস্ফূর্ততা তাঁর রেখাধর্মী কাজগুলিকে আলঙ্কারিক নকশার সংক্ষিপ্ততা ও রেখার কাব্যময়তার এক লৌকিক উপাখ্যান বলা যায়।