প্রথম প্রেগন্যান্সিতে ‘বেডরেস্ট’ ভুলেও নয়

বরং কাজে ডুবে থাকুন। পুরনো ধ্যানধারণা বদলাতে বললেন ডা: গৌতম খাস্তগীর। শুনলেন বিপ্লবকুমার ঘোষনীনার অন্য সমস্যা। আই টি সেক্টরে কনটেন্ট ম্যানেজারের বিরাট পে প্যাকেজ। কানাডা আর আমেরিকার দুটো বিরাট অ্যাকাউন্ট তাকেই সামলাতে হয়। স্মার্ট স্বামী বার বার বারণ করেছিল, একটু অপেক্ষা করো, সবে তুমি তেত্রিশ। কেরিয়ার আরও মজবুত হোক। নাছোড়বান্দা নীনা কথা শুনল না। কিন্তু কনসিভ করার পরদিন থেকেই বিপত্তি। স্পেশালিস্ট বলে দিয়েছেন বেশ ঝুঁকি আছে, বিশ্রাম চাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৫
Share:

নীনার অন্য সমস্যা। আই টি সেক্টরে কনটেন্ট ম্যানেজারের বিরাট পে প্যাকেজ। কানাডা আর আমেরিকার দুটো বিরাট অ্যাকাউন্ট তাকেই সামলাতে হয়। স্মার্ট স্বামী বার বার বারণ করেছিল, একটু অপেক্ষা করো, সবে তুমি তেত্রিশ। কেরিয়ার আরও মজবুত হোক। নাছোড়বান্দা নীনা কথা শুনল না। কিন্তু কনসিভ করার পরদিন থেকেই বিপত্তি। স্পেশালিস্ট বলে দিয়েছেন বেশ ঝুঁকি আছে, বিশ্রাম চাই। বিছানা থেকে উঠে বেশি নড়াচড়াও চলবে না। অটো বা বাসে ঝাঁকুনি এড়িয়ে চলতে হবে। নিজে গাড়িও চালানো যাবে না। শ্যাম না কুল- কোনটা রাখবে নীনা? প্রেগন্যান্সি তো সে নিজেই ডেকে এনেছে। কিন্তু সঙ্গে এই বেডরেস্টের আবশ্যিক প্যাকেজ!

Advertisement

সজোরে একটা ধাক্কা

Advertisement

দুনিয়া বদলাচ্ছে। বিজ্ঞানী আর গবেষকরা নতুন করে আলোকপাত করছেন। মা-ঠাম্মা আদ্যিকালে যা বলেছেন এখনকার সময়ে তার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। গর্ভসঞ্চারের পর শয্যা নিতে বলা হত কেন? বিশ্রাম নাকি শরীর ও মনের যাবতীয় স্ট্রেস দূর করে। রক্তচাপ কমায়। প্রচুর কাজ করলে, কোনও ওজন তুললে, এ-সময়ে যৌনসংসর্গ ঘটলে বা ভারী ব্যায়াম করলে যোনিদ্বার থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে। সার্ভাইকাল ইনকম্পিটেন্স বা জরায়ুমুখের শিথিলতাজনিত গর্ভচ্যুতির সম্ভাবনা বাড়ে। সময়ের আগে প্রসবযন্ত্রণা দেখা দিলে প্রি-টার্ম লেবার ত্বরান্বিত হয়। প্রেগন্যান্সিতে শয্যাগ্রহণের পরামর্শদাতারা মনে করতেন এই বিশ্রাম গর্ভফুল বা প্ল্যাসেন্টায় রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে ভ্রুণের বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। ফিটাল ডেভেলপমেন্ট ও গ্রোথের আদর্শ ফর্মুলা যেন। মজার কথা পরিবারের সুপ্রাচীনাদের মতো আমাদের পেশারও বহু বিজ্ঞজন তাঁদের ক্লিনিক থেকে ভাবী মায়েদের একই ধরনের নিদান বিলি করেন। অথচ কেউ প্রকৃত তথ্য ও তত্ত্ব খুঁজে দেখার চেষ্টা করলে ঠিক উল্টো মতামতই পেতেন।

অথ সংসার কথা

আই টি-র নীনার জন্য বেডরেস্টের পরামর্শ সর্বার্থেই তাঁদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলবে। এ যুগে সবারই সমস্যা মোটামুটি এক। চাকরি করলে তার বিশাল দায়দায়িত্ব। কিন্তু শুধু নীনা কেন, কোনও গৃহবধূও কি গোটা গর্ভকাল শুয়ে-বসে আলস্যে কাটানোর বিলাসিতা দেখাতে পারেন? এ যুগের নারীদের অসংখ্য কাজ করতে হয়। কী ঘরে, কী বাইরে। এই টানা শুয়ে পড়া শুধু পারিবারিক স্ট্রেস এবং আর্থিক সংকটই ডেকে আনবে না, মনোবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন সন্তানসম্ভবা এক অদ্ভুত মানসিক আঁধারে তলিয়ে যেতে পারেন।

আসলে যেটা হয়

‘বেডরেস্ট’ দীর্ঘায়িত হলেই শুরু হতে পারে মাথাব্যথা, অবসাদ। আসে উদ্বেগও। মাংসপেশি এবং হাড় দুর্বল হতে থাকে। শুরু হয় শরীরের নানা অঙ্গে যন্ত্রণা, বিশেষত কোমরে ব্যথা। সবচেয়ে বড় কথা, দেখা গেছে শয্যাশায়ী মহিলাদের প্রসবের পর ঘুরে দাঁড়াতে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে। অতিরিক্ত বিশ্রাম এবং দীর্ঘ সময় শুয়ে থাকার ফলে শরীরে রক্ত সঞ্চালনে বিভ্রাট দেখা দেয়। ব্লাড ক্লট তৈরি হতে পারে, এমনকী ঘাতক থ্রম্বো- এমবলিজমও। সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়, শুয়ে থাকা আসন্নপ্রসবা মায়েরা বড্ড কম খাবার খান। খিদে থাকে না। এ জন্যই তাঁদের নিজের ওজন কমে এমন নয়, স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের সন্তানও জন্মায়। পেশির টোন ও স্থিতিস্থাপকতা কমে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সমস্যা হাড় থেকে খনিজ পদার্থ বেরিয়ে যায় যাকে ‘বোন ডি-মানারেলাইজেশন বলে। সেটা পরবর্তীতে দেহের বেশ ক্ষতি করে।

বাস্তবের ছবিটা

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষকরা রীতিমতো রেগে আছেন। তাঁদের দীর্ঘ গবেষণায় দেখিয়েছেন, প্রেগন্যান্সিতে বেডরেস্ট সুপারিশ করা বড় অনৈতিক কাজ। ভাবী মায়ের ক্ষতিই হচ্ছে। অথচ দেখুন, যে সব কারণে বেডরেস্ট নিতে বলা হয় তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যূনতম উপকার খুঁজে পাওয়া যায়নি। আসন্ন ও অবশ্যম্ভাবী গর্ভপাতের পর বিছানায় বিশ্রাম কোনও কাজে আসে না। কারণ গর্ভপাতের প্রধান কারণ ভ্রণের গঠনগত ত্রুটি যেটা বিছানায় শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যায় না। উচ্চ রক্তচাপ কমে না বরং প্রেগন্যান্সি হাইপারটেনশনের ভয়টা রয়েই যায়।

বিশ্রামে থাকলে সময়ের আগে প্রসব এড়ানো সম্ভব নয়। একাধিক প্রেগন্যান্সি বা মাল্টিপল জেস্টেশনেও কোনও উপকার নেই ওই বিশ্রামে। এমনকী সন্তানের বৃদ্ধিতেও কোনওভাবেই সহায়ক নয় এই শুয়ে থাকার উপদেশ। দেশে বছরে কয়েক কোটি প্রেগন্যান্সিকে ‘হাই-রিস্ক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাঁদের ৭০% কোনও না কোনও সময়ে শুয়ে-বসে কাটাতে বাধ্য হন তাঁদের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে। এখনও আমরা এমন অন্ধবিশ্বাস পোষণ করি যে শুয়ে থাকলে জরায়ু মুখের ওপর চাপ কমে। ভাবী মায়ের হার্টেও কম ধকল পড়ে। কিডনিতে রক্তপ্রবাহ বাড়ে। তাতে গর্ভস্থ সন্তান বাড়তি অক্সিজেন ও পুষ্টিলাভ করে। এখন ‘ভুল সবই ভুল’ বলে তা উড়িয়ে দেবেন কি না আপনি তার সেরা বিচারক। একেবারে বিছানায় না শুয়ে থেকে বাড়িতে বা অফিসে চলাফেরা ও হালকা কাজকর্ম অবশ্যই করা যেতে পারে। দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা, উবু হয়ে মাটিতে বসা এবং খুব ঝাঁকুনি হয় এমন যানবাহনে না চড়াই বাঞ্ছনীয়।

যোগাযোগ-৯৮৩০৬৬৬৬০৬

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement