আবার ফিরে এল বাইশে শ্রাবণ। এই দিনটি কোনও দিনক্ষণ তিথি মাত্র নয়, চিরকালের অনুভব। তাঁর জন্মদিনের মধ্যেই আগাম মৃত্যুদিনের বার্তা আসন গেঁড়ে বসেছিল, এ কথা রবীন্দ্রনাথ জানতেন। যে দিন তিনি চলে গিয়েছিলেন অসীম জগৎপারে সেই ১৩৪৮ সালের বাইশে শ্রাবণ বর্ষণ হয়েছিল অবিশ্রান্ত। আমরা সততই দুঃখে, সুখে, সন্তাপে, শান্তিতে সর্ব অবস্থায় তাঁকে পেতে চাই বারে বারে। রবীন্দ্রনাথের তিরোধানের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আইসিসিআর ও ভবানীপুর বৈকালীর ‘বাইশে শ্রাবণ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানটি সেই অর্থে কবির প্রতি তর্পণ। ৭৫ বছর পরেও আজ স্পষ্ট করে চোখে পড়ে সুদূর দিগন্তে তাঁর নির্ভার চলে যাওয়া। আর সেই স্মৃতিকেই মনে করলেন কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ।
রবীন্দ্রনাথ ৭৩ বছর বয়সে রচনা করেছিলেন ‘যাবার সময় হল বিহঙ্গে’, যার শেষে লিখছেন ‘সব নিয়ে ধন্য আমি প্রাণের স্পন্দনে’। রবীন্দ্রনাথের জীবনে দীর্ঘ সময় জুড়ে মৃত্যু এসে বারে বারেই তাঁকে শোকাহত করেছে। শঙ্খ ঘোষের লেখনী থেকেই জানতে পারি ৬৫ বছর বয়স থেকেই সুরে বাঁধছিলেন অবসানের কথা। আসলে ডাকঘর নাটক রচনাকাল থেকেই কবি ভাবছিলেন মৃত্যুর কথা। এই নাটক রচনার কয়েক বছর পরেই তিনি একটা চিঠি লেখেন তাঁর মাকে—যেখানে তিনি লেখেন ‘মা আমি দূর দেশে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। আমার সেখানে অন্য কোনও প্রয়োজন নাই, কেবল কিছুদিন থেকে আমার মন বলছে যে, যে পৃথিবীতে জন্মেছি, সেই পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে নিয়ে তবে তার কাছ থেকে বিদায় নেব। এর পরে তো আর সময় হবে না।’ রবীন্দ্রজীবনে অস্তমিত রবি ২২ শে শ্রাবণের বর্ষণমুখর দিনটিকে কতটা বেদনার্ত করেছিল তারই এক মরমি ছবি ফুটে উঠল শঙ্খ ঘোষের এই সংকলনে। তিনি নিজে একজন নিপুণ কবি বলেই ‘বাইশে শ্রাবণ’কে রবীন্দ্রনাথের লেখায় ও গানে এতটাই মূর্ত করে তুলতে পেরেছিলেন যা সে দিনের আপামর দর্শক-শ্রোতাকে অশ্রুসিক্ত করে তোলে।
শঙ্খ ঘোষের এই পরিকল্পনাকে বাস্তবিকই সজীব করে তুললেন একক গায়নে প্রমিতা মল্লিক, সম্মেলক গানে বৈকালীর শিল্পগোষ্ঠী ও পাঠে সুবীর মিত্র। বিষাদঘন এই অনুষ্ঠানের সূচনা হল একক কণ্ঠে গীত পূজা পর্যায়ের ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই’ সহ। তার পরেই সুবীরের পাঠে এল সেই অবসানের কথা। এর পরেই এল শুধু মহিলা কণ্ঠে সম্মেলক ‘কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়’ গানটি। সাতটি সম্মেলক গান ছিল সবই মহিলা কণ্ঠে ও আটটি একক গান ছিল। পনেরোটি গানের এই চয়নে পূজা পর্যায়ের দশটি, প্রেম পর্যায়ের তিনটি, প্রকৃতি-বর্ষার একটি ও আনুষ্ঠানিকের একটি। যে সাতটি সম্মেলক গান বৈকালীর গানের দল গেয়েছিলেন সেই গানগুলি হল ‘কেন রে এই দুয়ারটুকু’, ‘দিন অবসান হল’, পথের শেষ কোথায়, ‘ধূসর জীবনের গোধূলিতে’, ‘আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে, ‘হে মহাজীবন ও সমুখে শান্তি পারাবার’। শুধু মহিলা কণ্ঠ হলেও জোয়ারি সমৃদ্ধ প্রকাশে গানগুলি এত নিবি়ড় ভাবে শোনানো হয়েছিল যে এক একটা সূক্ষ্ম মরমী বেদনা বোধের হাওয়া ছড়িয়ে পড়েছিল সারা প্রেক্ষাগৃহে। বিশেষ করে ‘পথের শেষ কোথায়’ গানটিতে কোনও অংশে একক, কোনও অংশে সম্মেলক প্রয়োগ করে প্রমিতা তাঁর ভাবনার বিশিষ্টতা প্রকাশ করেছেন। সুবীর মিত্রের পাঠে যেমন আন্তরিকতা, তেমনই বিষণ্ণতা। মনে হয় এই কণ্ঠই যেন একেবারে এই লেখনীর সঙ্গে উপযুক্ত। কী অসীম দরদ দিয়ে পড়েছেন না শুনলে বোঝানো সম্ভব নয়। ৩০শে জুলাই ১৯৪১ এ কবির শেষ লেখাটা যখন পড়ছেন তখন প্রতিটা কথার উচ্চারণ সমীহ আদায় করে নেয়। বিশেষ করে শেষ পঙক্তি দুটি—‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিত/সে পায় তোমার হাতে শান্তির অক্ষয় অধিকার।’, ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি’। এ বার প্রমিতার কথা। আমরা সবাই জানি তাঁর কণ্ঠ মুক্ত জোরালো। তাঁর অনুভবী নিবেদনও আমাদের জানা। কিন্তু কবির মৃত্যুর রূঢ়তাকে, তার বিষাদকে এ দিন যে ভাবে কণ্ঠে ফোটালেন তা বিরল বললে অত্যুক্তি করা হবে না। তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত সমস্ত গান সমগ্র পরিমণ্ডলকে গভীর বেদনার অভিঘাতে আপ্লুত করল। তাঁর কণ্ঠে ‘পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহো ভাই’ এক বিষণ্ণ বেদনাকে এঁকে দেয়। প্রাণ মন খুলে গলার সূক্ষ্ম কাজ ও মূর্ছনাকে উজাড় করে ‘চিরসখা হে’, ‘যেতে যদি হয়’, ‘যদি হায় জীবন পূরণ নাই হল মম’, দিনান্ত বেলায়’ গানগুলির অপরূপ রূপ দিলেন। তাঁর কণ্ঠের আয়াসহীন আবেগ ও স্বরস্থাপনের সাহায্যে ‘ওগো রহো রহো, মোরে ডাকি লহো কহো আশ্বাসবাণী। যাব অহরহ সাথে সাথে, সুখে দুখে শোকে, দিবসে রাতে অপরাজিত প্রাণে’ (কে যায় অমৃতধাম যাত্রী)-র প্রার্থনা আকুল হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘যা কিছু নিয়ে চলি শেষ সঞ্চয়। সুখ নয় দুঃখ সে নয়, নয় সে কামনা। শুনি শুধু মাঝির গান আর দাঁড়ের ধ্বনি তাহার স্বরে।’ এখনও তাঁর গান শ্রাবণের ধারার মতো অবিচ্ছিন্ন। প্রেক্ষাগৃহে সে দিন উপস্থিত শ্রোতারা সেই স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথায় যেন একাকার হয়ে গেলেন।