ঘরের ভেন্টিলেশন যেন ঠিকঠাক থাকে:
ডা. অমিতাভ রায়চৌধুরী
প্র: দিল্লির মতো না হলেও কলকাতাতেও তো ধোঁয়াশার কমতি নেই। এর গ্রাস থেকে বাঁচব কী করে?
উ: এখনও পর্যন্ত যা অবস্থা, তাতে অ্যালার্জি-হাঁপানির ধাত না থাকলে বা বিড়ি সিগারেট না খেলে অত চিন্তার কিছু নেই।
প্র: সমস্যা হবে না বলছেন?
উ: একটু-আধটু হতে পারে। কারণ শুধু ধোঁয়াশা বা পলিউশন তো নয়, ঋতু পরিবর্তনের সময় ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসেরও বাড়বাড়ন্ত হয়। তবে নাক-গলা-ফুসফুসের ইমিউনিটি ঠিক থাকলে ব্যাপারটা অল্পের উপর দিয়ে যায়।
প্র: ইমিউনিটি আবার ও রকম আলগা আলগা ভাবে থাকে নাকি?
উ: থাকে তো। অনেকের দেখবেন একটুতেই হাঁচি হয়, নাক দিয়ে জল পড়ে শ্বাসকষ্ট হয়। অ্যালার্জির ধাত থাকে বলে এ রকম হয়। এই ধাত থাকার ফলেই নাক, গলা, ফুসফুস সবের ইমিউনিটি কমে যায়। ফলে শীতের শুরুতে বা শেষে এঁদের বেশি ঝামেলা হয়।
প্র: কেন এ সময় হয় এমন?
উ: শীতকালে বাতাস ভারী থাকে বলে তাতে যত ধুলো, ফুলের রেণু, বিষাক্ত কণা ইত্যাদি মিশে থাকে তা আমাদের আশপাশে নেমে আসে। কুয়াশার সঙ্গে মিশে সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশা। এ বার যাঁদের এ সবে অ্যালার্জি আছে তাঁদের বিপদ হয়। আবার অ্যালার্জির ধাত থাকলে ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস সংক্রমণও বেশি হয়। সব মিলে বিরাট ঝামেলা।
প্র: ফুলের রেণু থেকে সমস্যা?
উ: অবশ্যই। পোলেন অ্যালার্জি খুব বিরাট ব্যাপার। ধরুন এমন জায়গায় গেছেন, য়েখানে আকাশ পরিষ্কার, পলিউশনের নাম-গন্ধ নেই, সেখানেও যদি যে ফুল বা গাছের পরাগে আপনার অ্যালার্জি আছে তা থাকে, বিপদে পড়ে যেতে পারেন। বসন্তের শুরুতে এই ব্যাপারটা মারাত্মক রূপ নেয়।
উ: নির্দিষ্ট কোনও ফুলের গন্ধ শুঁকলে, বাগান বা পার্কে গেলে যদি হাঁচি শুরু হয়, নাক দিয়ে জল পড়তে শুরু করে বা বুকে হালকা চাপ ধরা ভাব হয়, তা হলে বুঝবেন সমস্যা আছে। তবে অনেকে সময়ই একাধিক জিনিসে অ্যালার্জি থাকে বলে আলাদা করে বোঝা মুশকিল।
প্র: তা হলে উপায়?
উ: সবার প্রথমে বিড়ি-সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিন।
প্র: বিড়ি-সিগারেট আবার কী করল?
উ: নাক-গলা-ফুসফুসের ইমিউনিটি কমাতে সে তো একাই একশো।
প্র: সিগারেট খেলে গলা ফুসফুসের ইমিউনিটি না হয় কমতে পারে, নাকের কেন কমবে।
উ: মুখ দিয়ে ধোঁয়া টানছেন। সে ধোঁয়া শ্বাসনালীর পথ পেরিয়ে যাচ্ছে ফুসফুসে, নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছেন। হেভি স্মোক করলে তাই সবাই দুর্বল হয় একে একে।
প্র: কিন্তু সিগারেট তো আর মানুষ এক কথায় ছাড়তে পারবেন না, কাজেই অন্য আর কী রাস্তা আছে বলুন।
উ: নিকোটিন গাম বা প্যাচের সাহায্যে বিড়ি-সিগারেট ছাড়ুন আগে। না হলে মাস্ক পরুন আর যাই করুন, বিপদ পুরো এড়াতে পারবেন না।
প্র: মাস্ক পরলে তা হলে বিপদ কিছুটা এড়ানো যায়?
উ: তা যায়।
প্র: কিন্তু সুন্দর করে সেজেগুজে নাকে মাস্ক! ভাবা যায়।
উ: পার্টিতে যাওয়ার সময় তো আর পারবেন না। যদি মর্নিংওয়াকের অভ্যেস থাকে, তা হলে প’রে বেরোন। বিকেল-সন্ধের দিকে আবার ধোঁয়াশা বাড়ে। তখন পরুন।
প্র: মর্নিং ওয়ার্কে যাওয়া কি এ সময় ঠিক?
উ: মাস্ক পরে যেতেই পারেন।
বিপদ এড়াতে
•স্বাভাবিক ঠান্ডা জল সারা দিন ধরে অল্প অল্প করে খান।
•ঘন কুয়াশার মধ্যে বেরোলে মাস্ক পরে নিন।
•কচি বাচ্চাদের যথাসম্ভব ঘরে রাখুন।
•বয়স্ক ও অসুস্থরা ঘন কুয়াশার মধ্যে বেরোবেন না।
•ঘরে যেন ঠিকঠাক ভেন্টিলেশন বজায় থাকে।
•রাত্রে খুশখুশে কাশি হলে ঘরে বড় এক গামলা জল রেখে দিন।
প্র: কী ধরনের মাস্ক?
উ: মোটা কাপড় দিয়ে বানিয়ে নিন।
প্র: তাতে নাকি পুরো কাজ হয় না।
উ: বাইক চালানোর সময় যেমন মাস্ক পরেন, তেমন পরতে পারেন।
প্র: সার্জিকাল মাস্ক?
উ: তাও পরা যায়। আসলে নাক তো একটা ফিল্টারের মতো কাজ করে, দূষণ ঢুকতে বাঁধা দেয়। এ সব তার উপর আরেকটা অতিরিক্ত ছাঁকনির মতো কাজ করে আর কী। যা পরবেন তাতেই কম-বেশি কাজ হবে।
প্র: বাচ্চাকে তা হলে মাস্ক পরাতে হবে?
উ: তাদের কি আর পরাতে পারবেন? টেনে খুলে দেবে। তা ছাড়া, কচি বাচ্চাদের এখন বাইরে যত কম বার করবেন তত ভাল। কারণ আমরা যতবার শ্বাস নিই, বাচ্চারা নেয় প্রায় তার দ্বিগুণ। অর্থাৎ আমাদের গলায়-বুকে যত দূষিত পদার্থ ঢোকে তাদের ঢোকে তার দ্বিগুণ। আবার তাদের ইমিউনিটিও কম। সবে মিলে বিপদের চান্স প্রতি পদে।
প্র: বয়স্কদের?
উ: বয়স্ক মানুষ যদি সুস্থ-সবল থাকেন, অত চিন্তা নেই।
প্র: অসুস্থ হলে চিন্তা?
উ: অবশ্যই। রোগে জর্জরিত হলে ইমিউনিটি কম থাকবে। বিপদ তাড়াতাড়ি হবে। তার উপর বিড়ি-সিগারেটের অভ্যেস থাকলে তো হয়েই গেল।
প্র: বিপদের চান্স তো ঘরেও। এয়ার পিউরিফায়ার লাগালে কাজ হবে?
উ: অত কিছু করতে হবে না। দরজা-জানালা মাঝে মাঝে খুলে দিন যাতে ঘরে বদ্ধ হাওয়া না থাকে।
প্র: বড় রাস্তার ধারে বাড়ি হলে বা আশপাশের ঘর-বাড়ি উঠছে এমন হলে?
উ: রাত্রের দিকে বা সকালে যখন গাড়ি-ঘোড়া কম চলছে, তখন দু’এক ঘণ্টার জন্য খুলে রাখুন।
প্র: এ সময় বাতাসের আদ্র্যর্তা কমে যায় বলেও নাকি সমস্যা হয়? সে ক্ষেত্রে ঘরে হিউমিডিফায়ার লাগালে কাজ হতে পারে কী?
উ: ঘরোয়া ও সস্তার হিউমিডিফায়ারের কথা বলছি শুনুন। অ্যালার্জির জন্য গলা-ফুসফুসে শুকনো ভাব হয়ে খুশখুশে কাশি হলে রাত্রে শোওয়ার সময় বড় গামলায় জল নিয়ে ঘরে রেখে দিন। তাতেই কাজ হবে। তবে এই জলটা কিন্তু রোজ পাল্টাবেন। না হলে তাতে মশার বাড়-বৃদ্ধি হতে পারে।
যোগাযোগ: ৯৮৩০২১৪০৮৮
কাশি হলেই সিরাপ বা অ্যান্টিবায়োটিক নয়:
ডা.দেবাশিস মুখোপাধ্যায়
প্র: ধোঁয়াশার এই মরসুমে চিকিৎসকেরা সাবধানে থাকতে বলছেন। কিন্তু অ্যালার্জি থাকলে সাবধান হয়েও নিস্তার নেই।
উ: কিছুটা তো নিস্তার হয়।
প্র: সাবধান হওয়ার সুযোগই বা কোথায়? পথে বেরোলেই দূষণ।
উ: তা ঠিক। অটোতে-বাসে যাঁদের প্রচুর ঘুরে বেড়াতে হয়, তাঁদের মুশকিল আছে বই কী। এঁদের অনেকেরই হাঁচি, সর্দি যেমন থাকে, অনেকের আবার লেগে থাকে খুশখুশে কাশি। সে কাশি কখনও এমন পর্যায়ে যায় যে রাতের ঘুম বরবাদ হয়। কাশতে কাশতে জামা-কাপড়েও ইউরিন হয়ে যায়।
প্র: ধোঁয়াশা থেকে কাশি?
উ: অ্যালার্জির ধাত থাকলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলেই হবে। ঘরে থাকলেও হতে পারে। তবে দূষণ যত বাড়ে, তত বাড়ে সমস্যা।
প্র: কিন্তু আমরা তো কাশি হলেই ইনফেকশনের কথা ভাবি।
উ: সে জন্যই সমস্যা বাড়ে।
প্র: কী রকম?
উ: কাশি চলতে থাকে। কখনও তিন-চার সপ্তাহ পার হয়ে যায়। বরবাদ হয় কাজকর্ম, ঘুম। বোতল বোতল কাশির সিরাপ খেয়ে টাকা নষ্ট হয়। অনেকে অ্যান্টিবায়োটিক খান, যা মোটেই ঠিক নয়। কেউ আবার টিবি হল কি না আতঙ্কে ভোগেন। তার পর নাজেহাল হয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন।
প্র: আমরা কী করে বুঝব কাশির মূলে অ্যালার্জি আছে?
উ: উপসর্গ দেখে। অ্যালার্জির কাশিতে গলা চুলকোয় খুব, খুশখুশ করে। মনে হয় কিছু আটকে আছে। কফ বা জ্বর-জারি থাকে না। কাশতে কাশতে বেহুঁশ হয়ে যান মানুষ।
প্র: সমাধান?
উ: অ্যান্টি অ্যালার্জিক ওষুধ।
প্র: কাফ সিরাফ?
উ: গলার মধ্যেটা একটু মোলায়েম করে প্রলেপ দিতে কিছু কাফ সিরাপ দেওয়া হয় অনেক সময়। কাফ লজেন্স, স্টিম, এ সবেও আরাম হয়। আর সঙ্গে সাবধানতা। তার কোনও বিকল্পই নেই।
প্র: সাবধানে থাকা মানে মাস্ক পরা! দিবা-রাত্রি কি তা সম্ভব?
অ্যালার্জির কষ্ট
•হাঁচির পর হাঁচি, নাকবন্ধ, নাক দিয়ে জল পড়া।
• নাক-কান-গলা চুলকানো বা সুড়সুড় করা।
• মাথায়-কানে ভারী ভাব।
• প্রবল মাথাব্যথা নিয়ে সাইনোসাইটিসেরও সূত্রপাত হতে পারে।
•চোখ লাল, চোখে চুলকানি, চোখ দিয়ে জল পড়া।
•দিনের পর দিন ধরে চলতে থাকা শুকনো কাশি।
•শ্বাসকষ্ট
•বেশি দিন চললে মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি, পড়াশোনা ও কাজকর্মের দক্ষতা কমে যেতে পারে।
উ: দিবা-রাত্রি পরবেন কেন, ধোঁয়া, ধুলো বা ধোঁয়াশার মধ্যে পড়ুন।
প্র: আর হাঁচি-নাক বন্ধ হলে?
উ: তখনও সাবধান হয়ে চলতে হবে। চলতে হবে ডাক্তারদের কথামতো। তার পাশাপাশি চিকিৎসা করাতে হবে ধারাবাহিক ভাবে।
প্র: চিকিৎসা মানে তো অ্যান্টি অ্যালার্জিক খাওয়া, সে যখন দরকার হবে তখন খাওয়া যাবে।
উ: ভুল ধারণা। নানা রকম চিকিৎসা আছে। রোগের পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে ডাক্তার সে সব করে থাকেন। ওষুধ, নাকে স্টেরয়েড স্প্রে...।
প্র: স্টেরয়েড!
উ: ভয় নেই। এতে কোনও ক্ষতি হয় না।
প্র: ক্ষতি তো হয়। ইমিউনিটি কমে, ওজন বাড়ে।
উ: সে স্টেরয়েড খেলে হয়। এ ক্ষেত্রে সে সব ভয় নেই। কারণ এ রোগে দরকার ন্যাজাল স্প্রে। রোগকে বশে রাখতে এর জুড়ি নেই।
প্র: স্টেরয়েড নিলেই তা হলে রোগ মুক্তি?
উ: মুক্তি নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর কথায় কথায় অ্যালার্জি হয় না।
প্র: কিছু ক্ষেত্রে হয়?
উ: অ্যানাটমিকাল ডিফেক্ট থাকলে হতে পারে।
প্র: মানে?
উ: ওই যাঁদের নাকের হাড় বাঁকা, নাকে পলিপ আছে বা নাকের মধ্যে টারবিনেট নামে যে অংশ আছে তা কিছুটা ফোলা, তাঁদের ক্ষেত্রে ওষুধপত্র দিয়ে চিকিৎসা করা সত্ত্বেও ঘন ঘন অ্যালার্জি বা ইনফেকশন হতে পারে।
প্র: তা হলে?
উ: অপারেশন করে নিতে হয়।
প্র: অপারেশন করে নিলে তো আর ধোঁয়াশা নিয়ে ভাবতে হবে না?
উ: অপারেশন খুব কম ক্ষেত্রেই করতে হয়। যাই করুন না কেন, অ্যালার্জিকে পুরো বশে রাখতে গেলে কিছুটা সাবধান হয়ে চলতেই হবে। বিশেষ করে শীতের শুরুতে ও শেষে, যখন ধোঁয়াশায় ঢাকে।
যোগাযোগ-৯৮৩০০৪৮৫০৬