নৃত্যনির্মিতি: অনুষ্ঠানে নাচের মুদ্রায় এক শিল্পী
অতিমারির করাল কবলে আজ আমাদের জীবনযাপন। সমাজের সর্বস্তরে সামাজিক ব্যবধান বজায় রাখার কারণে বহু পেশা আজ বিপর্যস্ত, ওষ্ঠাগত প্রাণ। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী– আমরা কখনও থেমে থাকিনি, হেরে যাইনি। অন্যান্য বহু পেশার মতো মঞ্চশিল্পও তাই আজ মঞ্চ ছেড়ে ক্ষণিক আশ্রয় নিয়েছে ভার্চুয়াল জগতে। বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও সামাজিক প্রচারমাধ্যমকে অবলম্বন করেই আজ শিল্পচর্চা এগিয়ে চলার পথ খুঁজছে। তেমনই এক খোঁজে গত ১১ অগস্ট কলকাতার এক বিশিষ্ট ওড়িশি নৃত্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘দর্পণী’র ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের ফেসবুক পেজে উদ্যাপন করলেন এক ভার্চুয়াল জন্মাষ্টমী উৎসব। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেন ‘দর্পণী’র কর্ণধার, ওড়িশি নৃত্যশিল্পী, প্রশিক্ষক তথা পরিচালক অর্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়। সুতপা তালুকদার, রতিকান্ত মহাপাত্র ও পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের শিষ্য অর্ণব ইতিপূর্বে নিজে ও তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আঞ্চলিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বেশ কিছু নৃত্যানুষ্ঠান পরিবেশন করেছেন।
শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী উপলক্ষে এই সান্ধ্য অনুষ্ঠান আরম্ভ হয় রাজ্য সঙ্গীত অ্যাকাডেমি দ্বারা পুরস্কৃত অনুস্মিতা ভট্টাচার্যের অনাড়ম্বর অথচ প্রাণবন্ত, বাহুল্যহীন কিন্তু মনোময় বিষ্ণুবন্দনা ও মঙ্গলাচরণ পরিবেশনা দিয়ে। গুর্জরি-টোড়ি রাগে ও জ্যোতি তালে নিবদ্ধ ছিল এই নৃত্যনির্মিতি। এর পরে জগন্নাথ দেবকে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন করেন স্বয়ং অর্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়। আরভি রাগাশ্রিত ও একতালি তালে আধারিত তাঁর পদাভিনয় পরিবেশন ছিল বিলাসিত, ছন্দোবদ্ধ ও লীলাময়।
অনুষ্ঠানের তৃতীয় শিল্পী অনন্যা ঘোষ প্রচলিত সুরে, খেমটা তালে পরিবেশন করেন অপর একটি পদের অভিনয়, যেখানে সখীদের উদ্দেশে বর্ণিত হয় রাধাকৃষ্ণের যুগল লীলা। গানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনন্যার চপল ভাব ও অভিব্যক্তি দর্শকদের সন্তুষ্ট করে। এর পর জয়দেব প্রণীত ‘অষ্টপদী’র একটি পদ অবলম্বন করে নৃত্য পরিবেশন করেন সোহম দে। হয়তো কিঞ্চিৎ অনভিজ্ঞতার কারণেই সোহম কাঠের মেঝেতে তাঁর পদসঞ্চার নিয়ন্ত্রিত রাখতে পারেননি, যে কারণে মোবাইল বা কম্পিউটারের পর্দার এ পাশে থাকা দর্শকদের রসাস্বাদনে ব্যাঘাত ঘটে। এই প্রস্তুতি ছিল রাগ শঙ্করাভরণমে নিবদ্ধ। তবে এর তাল একতালি পরিবেশনের সময়ে কিছু কিছু বিচ্যুতি ঘটে। আশা রাখি, পরবর্তীতে তা নিশ্চয়ই সংশোধিত হবে। অনুষ্ঠানের সর্বশেষ শিল্পী ছিলেন নিকিতা দাস। জন্মাষ্টমীর শুভলগ্নে মোহন রাগে ও আদি তালে নিবদ্ধ তাঁর নৃত্য নিবেদনের মাধ্যমে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে মর্ত্যভূমিতে স্বাগত জানান।
অস্বীকার করার নয়, ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে আমরা অভাব বোধ করছি মঞ্চের সেই মায়াময় আলো-আঁধারির, সৃজনশীল মঞ্চসজ্জার, বৈচিত্রময়, দৃষ্টিনন্দন সমবেত উপস্থাপনার – যা ক্লিন্ন প্রাত্যহিকতা থেকে কিছু সময়ের জন্য বিভ্রান্ত করে আমাদের পৌঁছে দিত অলৌকিকতার আশ্রয়ে। কিন্তু বিকল্প হিসেবে এ-ও বা মন্দ কী? আমাদের দেহের সুরক্ষার অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু মনের গুরুত্বও তো কম নয়। তাই মনের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্য শিল্পীরা যে ভাবে নিজেদের দক্ষতর করার চেষ্টায় ব্রতী, তা যথার্থই সাধুবাদ দাবি করে। সুদিনের প্রতীক্ষায় আমরা।