পরেশ মাইতি
প্র: আমরা বাঙালিরা নদীমাতৃক দেশে থাকি। জলের প্রতি আমাদের জন্মগত ভালবাসা আছে...
উ: আমার জন্মস্থান তমলুক। চারপাশে জল, খাল-বিল-পুকুর। বর্ষাকালে ক’মাস জলেই ডুবে থাকে। তাই জলের সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে। ছোটবেলা থেকেই পুকুরে সাঁতার কাটতাম। আমি হলাম জলের পোকা। এতক্ষণ জলে থাকতাম যে, চোখ লাল হয়ে যেত। এখনও যেখানেই জল দেখি সেখানেই ছুঁতে যাই।
প্র: স্কুলেই ছবি আঁকা শুরু জলরং দিয়ে, তাই না?
উ: মাটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি দিয়ে শুরু করেছিলাম। তার পর সাত-আট বছর বয়স থেকে জলরং দিয়ে ছবি আঁকা শুরু। একটা ওয়াটার কালার বক্স আর ছোট্ট একটা তুলি নিয়ে রং করা। তার পর সতেরো আঠেরো বছর বয়সে, যখন গ্রাফাইট পেলাম, সে কী আনন্দ!
প্র: আচ্ছা, আপনি তো অন্য মিডিয়ামেও কাজ করছেন। যদি কেউ পোর্ট্রেট আঁকতে দেন, তা হলে অয়েল পেন্টে করতে হয়। কেউই তো জলরঙে করতে চান না। এর কারণ কি জলরং বেশি দিন টেকে না ?
উ: তেলরং দিয়ে পোর্ট্রেট আর জলরং দিয়ে প্রকৃতিকে বেশি ভাল ভাবে ধরা যায়। আমি প্রকৃতি ভালবাসি। প্রকৃতি আমার মূল প্রেরণা। অ্যারিস্টটল বলেছেন, আর্ট মাত্রেই প্রকৃতির অনুকরণ। আর জলরং একটা আল্টিমেট মিডিয়াম।
প্র: সাধারণত জলরং দিয়ে ছবি আঁকা শুরু হয়। এর কারণ কি জলরং সহজলভ্য আর তেলরঙে অনেক টেকনিক শিখতে হয় বলে?
উ: জলরঙে কাজ করা সবচেয়ে শক্ত। হয় পারলেন, নয়তো ব্যর্থ। মাঝামাঝি কিছু হয় না। ৮.৫’ X ৪.৫’ পেপারে জলরং করা এক রকম যুদ্ধ করার মতো ব্যাপার। আমি দু’রকম কাগজে জলরং করি। ফ্যাব্রিয়ানো কাগজ ইটালি থেকে আসে, আর অ্যাকোয়ারেল আর্চেস ফ্রান্সে তৈরি হয়। ৬৪০ গ্রাম ও ৮৪০ গ্রাম কাগজে আমি কাজ করি।
বাবুঘাট ছবি সৌজন্য: সিমা গ্যালারি
প্র: আপনি বললেন, প্রকৃতির ছবি সবচেয়ে ভাল হয় জলরঙে...
উ: নিসর্গচিত্র। জলরঙের সঙ্গে প্রকৃতির একটা আত্মিক যোগ আছে। ডিরেক্ট ট্রান্সফর্মেশন অফ এক্সপ্রেশন জলরঙের মাধ্যমে পাওয়া যায়। ধরুন, একটা নদী আঁকছেন, তার পাশে গাছপালা আছে। ওখানে জলরং নানা মাত্রার এফেক্ট সৃষ্টি করে। জলরঙে একটা কোমলতা থাকে কিন্তু তেলরঙে থাকে ভারিক্কি ভাব, মিডিয়ামের কারণেই। আর একটা কঠিন ব্যাপার হল, জলরঙে সাধারণত আপনি সাদা রং ব্যবহার করতে পারবেন না। জলরঙের ছবিতে আলো আসে একমাত্র কাগজের সাদা থেকে। ছবিতে আলো না থাকলে কোনও ছবিই ছবি হয়ে ওঠে না। অতি সামান্য ভুলে গোটা ছবিটাই বাতিল করতে হয়। এই জন্যেই জলরঙে ছবি আঁকা খুবই কঠিন। জলরঙের প্রতি আমার আকর্ষণ অন্য সব মিডিয়ামের তুলনায় অনেক বেশি। কারণ আমার জন্ম, বড় হওয়া জল খাল বিল পুকুরের চারপাশে। জল থেকে যেমন আমাকে আলাদা করতে পারবেন না, তেমনই আমার থেকে জলকে আলাদা করতে পারবেন না।
প্র: আচ্ছা, আর কোন বিষয় আপনি মনে করেন জলরঙের উপযোগী?
উ: আমি পোর্ট্রেট এঁকেছি, তবে খুবই কম। স্টিল-লাইফও করেছি যখন ছাত্র ছিলাম। এ ছাড়া তেলরঙে স্টিল-লাইফ আঁকার আগে জলরঙে তার একটা খসড়া ছবি করেছি।
প্র: জলরঙে যে এক্সপার্ট, তাঁর পক্ষে অন্য মাধ্যমে কাজ করাটা কি সহজ হয়ে যায়?
উ: জলরং ভাল করে শিখতে পারলে অন্যান্য মিডিয়ামও সহজ হয়ে যায়।
প্র: এর আগে বলেছিলেন, আপনার জীবনের কেন্দ্রে আছে ওয়াইডার অ্যান্ড ব্রডার পারস্পেকটিভ। এটিই কি কারণ এ বারের ছবিগুলোতে এত বড় করে এই আঙ্গিকটি ধরার?
উ: আমি বড় হয়েছি উন্মুক্ত আকাশের নীচে, খোলা মাঠ, নদীর ধারে। সেই কারণেই আমার ভিশন লার্জার দ্যান লাইফ। একটা ছোট জিনিসকে যে ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেটা বড় জিনিসকে করা যায় না। আর সেখানেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। সব সময়ে আমার মধ্যে একটা বড় মাপের কাজ করার প্রবণতা রয়েছে। বড় সাদা ক্যানভাসে কাজ শুরু করতে অসুবিধে হয় কিন্তু শেষ হয়ে গেলে আনন্দ হয়। বড় কাজ করার জন্য বড় তুলি অর্ডার দিয়ে বানানো হয়। বড় জলরঙের কাজ করতে এত পরিশ্রম করতে হয় যে, শীতকালেও ঘাম বেরিয়ে যায়! জলরঙে কাজ করতে হয় এক নির্দিষ্ট তাপমাত্রায়। তাপমাত্রা ঠিক না থাকলে রং তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। আমি কী চাই, তার চেয়েও বড় কথা, ছবি কী চায়। আমি শুরু করি তার পর বিভোর হয়ে মিলিয়ে যাই। তখন ছবি আমাকে পরিচালনা করে। এবং সৃষ্টি হয়।
প্র: ভিজে কাগজের উপরে রং যখন ছাড়েন, তখন তা ছড়িয়ে যায় চারিদিকে। এর মধ্যে আপনি যে ফর্মটা করতে চান, সেটা কী ভাবে বার করে আনেন?
উ: রং দিয়ে। বহু দিন হয়ে গিয়েছে আমি আর আলাদা করে ড্রয়িং করি না। মানুষ, গাছ, কুঁড়েঘর বলুন, সবই রং তুলি দিয়ে করা। লেস ইজ় মোর, কিছু নেই আবার সব কিছু রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, একটা জিনিসকে সহজ ভাবে বোঝাতে পারার মধ্যেই রয়েছে সার্থকতা। জাপানি, চিনা শিল্পীদের কাজের মধ্যে একটা ভাস্ট ব্যাপার দেখা যায়, বড় পেপারে ছোট্ট একটা বাঁশ গাছ। এই যে বড় পেন্টিংগুলো, শুধু আকাশ আর নানা রকম রঙের চলন। মনে হবে পৃথিবীটা একটা বড় জলাশয়, তার পাশে ঘাস, নৌকো। প্রকৃতিতে কোনও আউটলাইন থাকে না। যখনই সীমানা দাগিয়ে দেওয়া হবে, জলরঙের নরম ভাব নষ্ট হয়ে যাবে। জলরং করতে গেলে অনেক অভিজ্ঞতার দরকার।
প্র: আপনি যে বর্ষার ছবি এঁকেছেন, যেমন পিকক মনসুন, রেন মাস্ট ফল... এগুলো কি যে সব জায়গার ছবি সেখানে বসেই এঁকেছেন?
উ: আমার জলরঙের প্রায় সব ছবিই সে ভাবে আঁকা। আমি রং তুলি নিয়ে ঘুরি। বর্ষা দেখি আর ওখানেই আঁকি। এতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। প্রকৃতি থেকে সরাসরি ছবি আঁকা খুবই জরুরি, তাতে প্রাণের ছোঁয়া থাকে। গাছের পাতা দেখে আঁকলে তবেই তো নড়বে। বর্ষার মেঘ দেখে ছবি আঁকলে তবেই তো মনে হবে ছবিতে বৃষ্টি পড়ছে। সামনে দেখে না আঁকলে স্পিরিটটাই ধরা যায় না। আমি কেরলে হাউসবোটে ঘুরে বেড়াচ্ছি আর সেখানেই ছবি আঁকছি। ভেনিসে পালমেতো স্কোয়্যারে, বেনারসে গলিতে বসেই ছবি এঁকেছি।
বেনারস ছবি সৌজন্য: সিমা গ্যালারি
প্র: লন্ডনের পিকাডিলি স্কোয়্যারের যে ছবিটা এঁকেছেন, তাতেও জলের স্পর্শ...
উ: লন্ডনে তো প্রায় সারাদিনই বৃষ্টি হয়। আর বৃষ্টি আমার মধ্যে একটা অনুভূতির সৃষ্টি করে।
প্র: আপনি দুপুরের ছবিও এঁকেছেন।
উ: এমন অনেক ছবি আছে যেগুলো মে, জুন মাসে রোদে বসে আঁকা। কালিদাস বলেছিলেন এমন মেঘ আঁকতে, তা যেন আকাশে ঘুরে বেড়ায়। চিত্তবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ।
প্র: আপনার বেশ কিছু ছবিতে, যেমন মিস্টিক জার্নি, স্প্রিং-এ চাইনিজ় ক্লাসিক্যাল পেন্টিংয়ের একটা প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে...
উ: এই সব ছবি আমি যখন জাপান, চিন বেড়াতে যাই, ওখানে বসেই আঁকি। ওখানে অনেক পুরনো আর্টিস্টের ছবি দেখেছি। সে সব ছবি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এই ছবিগুলো আঁকা। আপনি যে সমাজে, যে জায়গায় থাকবেন, তার প্রভাব
ছবিতে পড়বে।
প্র: কুলুর ব্যালকনি, কোচিনের বন্দর, গোয়ার দৃশ্য... এই সব ছবিতে যে ডিটেল রয়েছে, সেগুলো কি সেখানে বসেই আঁকা?
উ: সব ছবিই সে জায়গায় গিয়ে আঁকা। ১৯৮৬ সালে, কলেজে পড়াকালীন আমি আর আমার দুই বন্ধু সিমলা, কুলু, মানালি বেড়াতে গিয়েছিলাম। তার পর যখন কেরলে বেড়াতে গিয়েছি, মনের আনন্দে ছবি এঁকেছি। যেখানেই গিয়েছি পেপারের বান্ডিল, রং, তুলি আর কাঁধে একটা বোর্ড সব সময়ে আমার সঙ্গে ছিল।
প্র: আপনার ছবি আঁকার চার দশকে সারা পৃথিবীতে ছবির ইতিহাসে ছবির ধরন, কনসেপ্টে পরিবর্তন এসেছে। আমরা ছেলেবেলা থেকে ধারণা নিয়ে বড় হয়েছিলাম যে, প্রকৃতির সঙ্গে ছবির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, ছবি সে জায়গা থেকে সরে এসেছে। আর্ট এখন যেন প্রকৃতির, এমনকি দৃশ্য জগতের সঙ্গেও সম্পর্কহীন, যার চরম পরিণতি হচ্ছে অ্যাবসট্রাক্ট আর্ট। এ সব নিয়ে কিছু ভেবেছেন?
উ: বিমূর্ত ছবি নিয়েও অনেক কাজ করি। আমি পৃথিবীকে দেখি নিরাকার। তার পর রূপের কল্পনা আসে। ফিগারেটিভ ছবি শুরুই করি নিরাকার থেকে। তার পর রং ছড়িয়ে দিই। যেমন, আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘকে কখনও বাঘ, কখনও সিংহ, কখনও হাতির মতো দেখি। তেমনই সব আকার, অবয়ব বেরিয়ে আসে আমার ছবিতে। আমি মনে করি, কেউ যদি ভাল করে হাঁটতে না জানে, সে ভাল দৌড়তেও পারবে না। আপনি পাবলো পিকাসোকে দেখুন, উনিও শুরুর জীবনে বাড়ির প্রতেকের পোর্ট্রেট করেছেন, নৌকা এঁকেছেন, পায়রা এঁকেছেন। বেনারসে আমি যেমন ডিটেল ল্যান্ডস্কেপ পেন্টিং করেছি, আবার সেখানেই ১২ ফুট ১৪ ফুট অ্যাবসট্রাক্ট পেন্টিং করেছি এসেন্সকে ধরার তাগিদে।
প্র: আপনার জীবনে আর কী কী পরিকল্পনা রয়েছে?
উ: নতুন নতুন ছবি আঁকা। আরও এক্সপেরিমেন্ট করা। নতুন স্কাল্পচার, ইনস্টলেশন বানানো। আরও বড় ছবি আঁকা। নতুন করে লাইন, ফর্মস ক্রিয়েট করা। দর্শককে আরও নতুন কিছু দেওয়া।
প্র: আপনার ইনস্টলেশন সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা সম্বন্ধে জানব...
উ: ওয়েস্ট মেটিরিয়াল দিয়ে কী ভাবে কাজ করা যায়, তা আমার অনেক বছরের পরিকল্পনা। যেমন, একান্নটি গঙ্গাফড়িংয়ের ইনস্টলেশন। একশো দু’টি রয়্যাল এনফিল্ড বাইককে ডিসম্যান্টল করে ওর বডি তৈরি হয়েছে। পুরনো পাখার ব্লেড দিয়ে ডানা বানানো হয়েছে। জাইগ্যানটিক চেহারা, এক একটা পাঁচ ফুট হবে।
প্র: আপনার এ বারের প্রদর্শনীর বাঁদরলাঠি গাছ, টেম্পো গাড়ি... স্কাল্পচারগুলো সবই কি কাস্টিং করা?
উ: সবই কাস্টিং করা। টেম্পোর মাথায় লঙ্কা রয়েছে। আমাদের ভারতীয়দের জীবনে একটা বড় অংশ জুড়ে আছে মশলা এবং মশলাদার খাবার। রাজস্থানে দেখেছি, কত লাল-হলুদ লঙ্কা টেম্পো করে নিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে এই ইনস্টলেশনটা করেছি। একটা অরিজিন্যাল টেম্পো ভাড়া নিয়েছিলাম। সেখান থেকে মোল্ড নিয়ে তার পর কাস্টিং করা হয়েছে।
প্র: আপনার সব ক’টি স্কাল্পচারের মধ্যে আমার বাঁদরলাঠি গাছটি সবচেয়ে মজার লেগেছে...
উ: এই গাছটি সব সময়ে আমার মধ্যে একটা অনুভূতি তৈরি করত। গরমকালে এই গাছের সমস্ত পাতা ঝরে যায়, তখন দেখলে মনে হয় যেন গাছটি মৃত। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাতায় ভরে যায়। প্রকৃতির যে কী অদ্ভুত রূপ! এই সমস্ত কিছুই আমার অনুপ্রেরণা ছিল এই স্কাল্পচারটি বানানোর ক্ষেত্রে। সব ক’টি স্কাল্পচার একে অপরের থেকে আলাদা, আবার কোথাও একটা
মিল রয়েছে।
প্র: এখানে আপনার একটি কাজ আছে, নারীর বড় একটি মুখ। এটা যেন আমি কোথাও দেখেছি...
উ: এটা একটা ১২ ফুটের কাজ। এর আগে ছোট করেছি। এই সুবিশাল নারীর মুখে আমি প্রকাশ করতে চেয়েছি নারীর শক্তি, ক্ষমতা, সৌন্দর্য... সব কিছু।
প্র: জল নিয়ে যে ইনস্টলেশন বানিয়েছেন, সেটা সম্পর্কে কিছু বলুন...
উ: নয়েজ় অফ ওয়াটার, জলের কোলাহল। বর্ষার সময়ে জল নানা ভাবে পড়ে। কখনও টুপটুপ করে, কখনও ঝিরঝির করে, আবার কখনও জোরে। জল একটা অদ্ভুত চরিত্র। পৃথিবীর তিন ভাগ জল। আর জল আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করে। জলপথে যাতায়াতের একটা অন্যতম মাধ্যম হল নৌকা। ছোটবেলা থেকেই তা দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। এই সব চিন্তাভাবনা থেকেই কাজটা করা।