CIMA Gallery

রূপ সাধনের চরম সিদ্ধি

তিরিশ বছরের জন্মদিনের এই যাত্রার তৃতীয় এবং শেষ অধ্যায়ে এ বারের প্রদর্শনীতে চার জন মাস্টার শিল্পীর অনবদ্য সব কাজ দর্শকের কাছে তুলে ধরা হয়েছিল। প্রদর্শনীর নাম, ‘টুওয়ার্ডস দ্য পার্সোনাল’।

Advertisement

শমিতা বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:০৪
Share:

অননুকরণীয়: সিমা আর্ট গ্যালারিতে আয়োজিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। ছবি সৌজন্য: সিমা গ্যালারি, কলকাতা।

সেন্টার অব ইন্টারন্যাশনাল মডার্ন আর্টের তিরিশ বছরের জন্মদিনের এই যাত্রার তৃতীয় এবং শেষ অধ্যায়ে এ বারের প্রদর্শনীতে চার জন মাস্টার শিল্পীর অনবদ্য সব কাজ দর্শকের কাছে তুলে ধরা হয়েছিল। প্রদর্শনীর নাম, ‘টুওয়ার্ডস দ্য পার্সোনাল’।

Advertisement

এই পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যক্তিগত কালেকশন থেকে সংগৃহীত বাংলার শ্রেষ্ঠ চার শিল্পীর কাজ উপস্থাপন করা হয়েছে। দর্শক দেখতে পেলেন ভাস্কর শর্বরী রায় চৌধুরীর ব্রোঞ্জের কাজ, সোমনাথ হোরের গ্রাফিক্স এবং ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য। শেষে লালুপ্রসাদ সাউ এবং সনৎ করের গ্রাফিক্স এবং টেম্পারার ছবিও।

নিজের ভাস্কর্যে গানের ছন্দ আনতে চেষ্টা করেছেন শর্বরী। নিজের অনুভূতিতে বুঝেছেন, সঙ্গীত যে রকম ইন্দ্রিয়ের অনুভবকে সরাসরি একটা জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে, ভিসুয়াল মাধ্যম সেটা করতে অপারগ। তাই বাস্তবানুগ শিল্পকর্ম থেকে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেটেছেঁটে নিজস্ব বিমূর্ত ভাষা তৈরি করে নিয়েছেন তিনি, যেখানে আছে শুধুই সারবস্তুটি। তাঁর শৈল্পিক চিন্তাভাবনার সার কথাটি হল, সব রকম সৃজনশীলতার মূল হচ্ছে মানুষের অন্তরের যন্ত্রণা। শর্বরী রায় চৌধুরীর সৃষ্টিতে আলি আকবর খান, বড়ে গোলাম আলি খান এবং সিদ্ধেশ্বরী দেবীর তিনটি আবক্ষ মূর্তি। তাতেই এই কাজের অভ্যন্তরীণ ছন্দোময়তা অনুভব করা যায়। যদিও তিনটির ভাব সম্পূর্ণ অন্য রকম।

Advertisement

১৯৮২ সালে তাঁর ব্রোঞ্জে করা ‘রিক্লাইনিং উওম্যান’-এ বিশেষ কোনও ডিটেল চোখে পড়ে না। বিশ্রামরতা এক মহিলা যে ভাবে আরাম করছেন, বিমূর্ত রূপেও সেই ভাবটি ধরা পড়ে। ১৯৯৫ সালে করা শর্বরী রায় চৌধুরীর আর একটি ভাস্কর্যের নাম ‘এপ্যাশনাটা’। এখানে শিল্পী সম্পূর্ণ বিমূর্তকরণ করেছেন এক নারীর যোনিদেশ, তাঁর সারা শরীর পরিহার করে, অন্যান্য অপ্রয়োজনীয়তা ব্যতিরেকে।

প্রদর্শনীর অপর এক শিল্পীর নাম লালুপ্রসাদ সাউ। তাঁর ‘বাবু বিবি’ ছবির সঙ্গে অনেকেই হয়তো পরিচিত। কিন্তু প্রদর্শনীতে তার সঙ্গে দেখা গেল লালুপ্রসাদের অনবদ্য সব গ্রাফিক্সের কাজ। তার মধ্যে দু’টি এচিং ১৯৭৬/’৭৭ সালে করা। অনমনীয় কালো এবং সাদায় করা কাজ। বাকি অংশে সূক্ষ্ম লাইন এবং মিশকালোর আশপাশে ছাই রঙের উপচ্ছায়া। এ ছাড়া আছে গতির মিতব্যয়িতা। হয়তো এগুলো মেশিনারি বা যন্ত্রপাতিকে খুব কাছ থেকে দেখার ফল। অপূর্ব সব এচিং এবং লিথোগ্রাফ।

অননুকরণীয়: সিমা আর্ট গ্যালারিতে আয়োজিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। ছবি সৌজন্য: সিমা গ্যালারি, কলকাতা।

প্রদর্শনীতে তাঁর স্বাক্ষরবাহী কাগজ এবং বোর্ডের উপরে টেম্পেরাতে করা দ্বিমাত্রিক বেশ কিছু ছবি দেখা গেল। একটি ছবিতে বিশ্রামরতা এক শূকর-জননী। ফ্ল্যাট রং এবং কিছু লাইনের কাজ। সামান্য কাজে সুন্দর অনুভূতির প্রকাশ।

এই প্রদর্শনীতে সনৎ করের ১৯৭৫-’৭৬ সালের একটি ছবির নাম ‘সতী’। এটি ইন্টালিয়ো প্রিন্ট। ওই সময়ে এক অধ্যায়ে শিল্পী বৈষ্ণব পদাবলি নিয়ে পড়াশোনা করেন। তারই ফলস্বরূপ কিছু ছবি তিনি এঁকেছিলেন। ‘সতী’ নামের ছবিটিতে বিমূর্ত সতীকে দুই হাতে ধারণ করে রেখেছেন শিব। সতীর উপরে শিবেরই প্রতিচ্ছায়া। এই ছবিতে শিল্পী খুব পরিশীলিত সব রং ব্যবহার করেছেন— যেমন ছাই রং, নীলাভ, সাদা, এবং কালো। এক অদ্ভুত ভাবের সৃষ্টি হয়েছে।

১৯৮০ এবং ’৯০-এর দশকে শিল্পী সনৎ কর সমাজের অসহায়, হেরে-যাওয়া, খেটে-খাওয়া মানুষের ছবি আঁকায় ফিরে গিয়েছেন। তাঁর ‘ড্রিমার’ সিরিজ়ের ছবিগুলি এঁকেছেন অত্যন্ত আধুনিক মানসিকতা নিয়ে। সম্পূর্ণ বিমূর্ত, অসামান্য সব ছাপাই ছবি। আঙ্গিক তাঁর একান্ত নিজস্ব।

অননুকরণীয়: সিমা আর্ট গ্যালারিতে আয়োজিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। ছবি সৌজন্য: সিমা গ্যালারি, কলকাতা।

সোমনাথ হোরকে ছাপাই ছবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী বলে মানা হয়, কারণ লিথোগ্রাফ, এচিং, এনগ্ৰেভিং, উডকাট, ড্রাই পয়েন্ট এচিং, ইন্টালিয়ো, রঙিন ইন্টালিয়োতে তাঁর চরম দক্ষতা সর্বজনবিদিত। এ ছাড়াও এই প্রদর্শনীতে তাঁর অসাধারণ সব ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য দেখা গেল। সোমনাথ হোরের একটি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের নাম ‘দ্য ক্রাই’। এখানে দু’টি হাত আকাশে তুলে যেন এক মানুষ করুণাপ্রার্থী। তার মুখে আর্তনাদ।

আর একটি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের নাম ‘ডেসোলেট’। মন্বন্তরের মুখ থেকে উঠে আসা একটি মেয়ের অবয়ব, যেন হতাশার প্রতিমূর্তি।

সোমনাথের ‘উন্ড’ সিরিজ়ে ব্রোঞ্জের দু’টি ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে দেখা গেল। দু’টিতেই অবহেলিত, পরিত্যক্ত মানুষের অন্তরের যাতনা সম্পূর্ণ ভাবে অনুভব করা যায়।

এ বারে একটি রঙিন ইন্টালিয়োর অসামান্য কাজের উল্লেখ করতেই হয়। কাজটির নাম, ‘নাইন্থ সিম্ফনি’। ন’টি ছাপাই ছবি, বিভিন্ন পদ্ধতিতে, বিভিন্ন আকারে, বিভিন্ন রঙে সম্পন্ন করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ছোট, বড় নানা আকারের ছবি। একটিতে শুধু সাদা-কালোর ইন্টালিয়ো আছে। এ ছবির সামনে দর্শক বহু সময় কাটাতে পারবেন। কারণ, এত রকমের উপাদান এই ছবিতে আছে, যা মানুষকে স্পর্শ করে একেবারে তার অনুভূতির মূলে গিয়ে।

এ বার সোমনাথ হোরের ‘হোয়াইট অন হোয়াইট’ নামাঙ্কিত ছাপাই ছবির কথা বলতে হয়। কী অসাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন শিল্পী! এগুলিকে ছাপাই ছবি বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু যেন সত্যিকারের আঘাতের ছবি। মাটি বা মোমের পাতের উপরে ছুরি বা অন্য কোনও অস্ত্র দিয়ে এই আঘাতগুলিকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তার উপরে আগুনে তেতে ওঠা লাল লাঠি দিয়ে আরও মারাত্মক করা হয়েছে এই ক্ষতকে। কাঠ বা ধাতুর পাতের উপরে অ্যাসিড দিয়ে যে কাজটি করা হয়, সেটিই উনি সম্ভবত করেছেন মোমের উপরে। আরও একটি অনন্য কাজে ‘হোয়াইট অন হোয়াইট’-এর উপরে রক্তিম আভা।

সিমা গ্যালারির তরফ থেকে চার মাস্টার শিল্পীর কাজ একত্র করে দর্শকের সামনে তুলে ধরার এই প্রচেষ্টা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। শিল্পী, শিল্পরসিক, শিল্পসমালোচক প্রত্যেকের কাছেই এ যেন এক বিরাট পাওনা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement