ভারতীয় সিনেমা যখন কথা বলতে শুরু করেছে, ছবির গল্প বলতে গিয়ে গানকেও ব্যবহার করার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন তখনকার পরিচালক ও প্রযোজকরা। কিন্তু ছবিতে সংলাপ যে কেউ বলতে পারলেও অভিনয় করতে-করতে গান গাইতে হলে অভিনেতার গলায় সুর থাকাটা ছিল জরুরি। ফলে এমন অভিনেতাদের খোঁজ পড়েছিল, যাঁরা চেহারায় নায়কোচিত এবং গাইতে পারেন। কিন্তু তেমন গায়ক-অভিনেতা খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। প্রথম যে গায়ক-অভিনেতাকে সফল ভাবে কাজে লাগানো গিয়েছিল, তিনি কুন্দনলাল সায়গল। এর পর ক্রমশ পঙ্কজ মল্লিক, কৃষ্ণচন্দ্র দে ও পাহাড়ী সান্যাল। এঁদের নায়ক-গায়ক হয়ে ওঠার পিছনে রাইচাঁদ বড়ালের অবদান ছিল অনেকটাই।
১৯৪০ সালের গোড়ার দিকে সায়গল মুম্বই চলে গেলেন। ফলে তাঁর স্থানপূরণ করার জন্য নতুন গায়ক-নায়কের প্রয়োজন হল। কৃষ্ণচন্দ্র দে, পাহাড়ী সান্যাল ও রবীন মজুমদাররা থাকলেও নতুন এক গায়ক-নায়ক খুঁজছিলেন নিউ থিয়েটার্সের বীরেন সরকার। এমনই এক সময়ে আকাশবাণীর সঙ্গীত সম্মেলনে ২৫ বছরের সুদর্শন এক যুবকের তবলা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করলেন সঙ্গীতরসিক পাহাড়ী সান্যাল। কথায়-কথায় তিনি জানতে পারলেন, সে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ছাত্র এবং ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসের আকাশবাণীতে তবলিয়া হিসেবে যুক্ত।
পাহাড়ী সান্যাল তাঁকে বাংলা সিনেমায় অভিনয় করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে হেমচন্দ্র চন্দ্রের পরিচালনায় ‘প্রতিশ্রুতি’তে নিজের ভাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। ছেলেটিকে নিয়ে এসে স্টুডিয়োর কর্ণধার বি এন সরকারের সঙ্গে আলাপও করিয়ে দেন। অডিশনে খুব সহজেই উত্তীর্ণ হয় ছেলেটি। জন্ম হল বাংলা সিনেমার নতুন এক গায়ক-নায়ক অসিতবরণ মুখোপাধ্যায়ের। সংক্ষেপে অসিতবরণ।
হেমচন্দ্র চন্দ্রের এই ছবিতে অসিতবরণ প্রথমবারের জন্য ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যে রকম কাজ করেছিলেন, তা আজ দেখলে অবাকই হতে হয়। ছবিতে তাঁকে অভিনয় করতে হয় পাহাড়ী সান্যাল, ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তী, চন্দ্রাবতীদেবী, জহর গাঙ্গুলি, অহীন্দ্র চৌধুরী ও ভারতীদেবীর মতো তাবড় অভিনেতাদের সঙ্গে। ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি দু’টি গানও তাঁকে গাইতে হয়, ‘রাজার মেয়ে কাহার লাগি গাঁথছ মণিহার’ ও ‘আমারও জীবনে এল বসন্ত’। তবে শুধু বাংলায় নয়, হিন্দিতেও। ‘প্রতিশ্রুতি’ ও ‘সৌগন্ধ’ নামে ছবি দু’টি মুক্তি পায় যথাক্রমে ১৯৪১ ও ১৯৪২ সালে। অসিতবরণের বয়স তখন ২৮। অসিতবরণ-ভারতীদেবীর জুটি বিরাট এক সম্ভাবনা নিয়ে বাংলা সিনেমার প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াল। প্রমথেশ বড়ুয়া পরবর্তী ও উত্তমকুমার পূর্ববর্তী বাংলা সিনেমা পর্বে জনপ্রিয় যত গায়ক-নায়ক এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রবীন মজুমদারের পাশাপাশি অসিতবরণের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়েছিল বলে মনে করতেন
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
দুই কন্যা ও দুই পুত্র-সহ সস্ত্রীক অসিতবরণ।
১৯১৩ সালের ১৯ নভেম্বর যশোরে জন্ম অসিতবরণ মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর ডাকনাম ছিল কালো। পরিবারের আদি নিবাস সেখানেই। বাবা তারাপদ ও মা বীণাপাণিদেবী। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে বড় প্রভাতবরণ, মেজ অসিতবরণ ও ছোট বারিদবরণ। বোন মায়া। কলকাতায় প্রথমে তাঁরা থাকতেন শিয়ালদহের কাছে শাঁখারিটোলা স্ট্রিটের যৌথ পরিবারে। বাড়ির কাছেই ‘মিত্র ইনস্টিটিউশন’। সেখানেই অসিতবরণের পড়াশোনা।
ছাত্রজীবনে বন্ধুদের মধ্যে গায়ক হিসেবে খ্যাতি ছিল অসিতবরণের। তাঁদের বন্ধুমহলের আড্ডা ছিল সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার পার্কে যা তখন সেন্ট জেমস স্কোয়ার নামে পরিচিত ছিল। এই পার্কের পাশের গলিতে দুর্গাপুজোর পত্তন হয় তাঁর ও তাঁর বন্ধুদের উদ্যোগে, যা আজ শহরের বিখ্যাত এক দুর্গাপুজো। অসিতবরণের বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন এরিয়ান্স ক্লাবের খেলোয়াড় শৈলেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও শম্ভু মুখোপাধ্যায়, মৃৎশিল্পী রমেশ পাল, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাবা চণ্ডী গঙ্গোপাধ্যায়। ঘুড়ি ওড়ানোর নেশা ছিল তাঁর ছোটবেলা থেকেই। গড়ের মাঠে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতায় তিনি নিয়মিত যোগ দিতেন বলে জানিয়েছেন তাঁর ছেলে রজতবরণ। বারাণসী থেকে তিনি ঘুড়ি আনাতেন। এ ছাড়া ছিল মাছ ধরার নেশা, যা সে যুগের কলকাতার যুবকদের অনেকেরই জীবনের অঙ্গ ছিল।
১৩ বছর বয়সে অসিতবরণ তাঁর মাকে হারান। এই মৃত্যুতে বাবা তারাপদ মুখোপাধ্যায় দিশেহারা হয়ে পড়েন। সেই সময় ছেলেমেয়েদের বয়স যথাক্রমে বড় ছেলে ১৫, অসিতবরণ ১৩, ছোট ছেলে ৯ ও মেয়ে ৭। ফলে পরিবারের ভরণপোষণের একটা চাপ এসে পড়ে বাড়ির ছেলেদের উপরে। তাই ম্যাট্রিক পরীক্ষা না দিয়েই অসিতবরণকে রোজগারের চেষ্টা শুরু করতে হয়। বাড়ির কাছে থাকতেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। তাঁর কাছে তবলা শিখতেন। গাইতে পারতেন বলে কলকাতার বিভিন্ন সঙ্গীত জলসায় গানের জন্য ডাক পেতেন। তাঁর গলায় আধুনিক বাংলা গান ও শ্যামা সঙ্গীত জলসার শ্রোতাদের কাছে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বিখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্তর অর্কেস্ট্রাতেও বাজাতেন। অসিতবরণের গান শুনে তিনিই তাঁকে দিয়ে বেসিক আধুনিক গান গাইয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন সংগ্রাহক, গবেষক অভীক চট্টোপাধ্যায়। চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার আগেই তাঁর প্রথম প্রকাশিত রেকর্ড, ‘আমার প্রথম গান তোমারে শোনাব বলে’। পরবর্তী কালে কমলবাবুর ছোটভাই সঙ্গীত পরিচালক সুবল দাশগুপ্তর সুরেও অসিতবরণ বেসিক ও চলচ্চিত্রের জন্য অনেক জনপ্রিয় গান গেয়েছেন।
এই ভাবে চলতে চলতে ১৯৩৮ সালে অসিতবরণ আকাশবাণীতে তবলিয়া হিসেবে চাকরি করতে শুরু করেন। তাঁর বাবা, দাদা কলকাতার টেলিগ্রাফ অফিসে চাকরি করলেও অসিতবরণ কখনও সেখানে চাকরির চেষ্টা করেননি বলে জানিয়েছেন তাঁর বড়দাদা প্রভাতবরণের পুত্রবধূ নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্যর কন্যা বনানী মুখোপাধ্যায়। যদিও এই প্রসঙ্গে অসিতবরণের ছেলে তিমিরবরণের ভাষ্য কিছুটা আলাদা, “সংসারের চাপে পড়ে বাবা দিন পনেরো পিজি হাসপাতালের পিছনে রেসকোর্সের উল্টো দিকে একটা অফিসে কাজ করেছিলেন। ভাল না লাগায় সেটি ছেড়ে বাবা রেডিয়োতে তবলচি হিসেবেই কেরিয়ার শুরু করেন। সেখান থেকে পাহাড়ীজেঠু বাবাকে নিউ থিয়েটার্স নিয়ে যান।”
পাহাড়ী সান্যাল নিউ থিয়েটার্সে অসিতবরণকে নিয়ে যান আনুমানিক ১৯৩৯/৪০ সাল নাগাদ। চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগেই অবশ্য অসিতবরণের সঙ্গে বিয়ে হয় শিরীষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুভাষিণীদেবীর বড় মেয়ে রাধারাণীর। তাঁদের দুই পুত্র তিমিরবরণ ও রজতবরণ। দুই কন্যা রমা আর দীপা। অসিতবরণের নিজস্ব পরিবারের বর্ণনা পাওয়া যায় রজতবরণের কথায়, “আমরা দুই বোন, দুই ভাই। আমাদের সকলের বড় দিদি রমা চট্টোপাধ্যায় ১৯৬২ সালে মোটর দুর্ঘটনায় মারা যান। দিদির একমাত্র সন্তান চন্দ্রনাথ। দিদির পরে দাদা তিমিরবরণ মুখোপাধ্যায়।...আমার বৌদির নাম ইলা মুখোপাধ্যায়। ওঁদের এক ছেলে এক মেয়ে। নাম অনিন্দিতা ও অনিন্দ্য। ছোড়দির এক ছেলে এক মেয়ে সঞ্জীব আর অর্পিতা। সকলের ছোট আমি। আমার স্ত্রী শিখা। আমাদের দুই ছেলে অনির্বাণ আর অভিষেক।”
চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং সাফল্য পাওয়ার পর ১৯৪৬ সালে ২৫ নম্বর প্রতাপাদিত্য প্লেসে নিজের বাড়ি বানিয়ে শাঁখারিটোলা ছেড়ে নতুন বাড়িতে সপরিবার থাকতে শুরু করেন। বনানীর স্মৃতিতে আছে, “সেই বাড়িতে আত্মীয়, অনাত্মীয় সকলের ঠাঁই ছিল। সব সময় গমগম করত বাড়ি। খেতে ও খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন মেজকাকা। আর ভালবাসতেন ভবানীপুরের জগুবাবুর বাজারে গিয়ে বাজার করতে ও লেক মার্কেটের রাধুবাবুর দোকানে চায়ের আড্ডায় মেতে থাকতে। এই অভ্যেস তাঁর সারা ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা হয়ে ওঠার পরেও ছিল।”
তাঁর ছেলেদের স্মৃতিতে আছে, ‘আমি একজন ফিল্মস্টার, তাই একটা গ্ল্যামার জগতের মধ্যেই আমার থাকা উচিত’ এমন মনোভাব ওঁর কখনওই ছিল না। অসিতবরণকে সকলে সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি শার্ট পরে ঘুরতে দেখেছেন। রজতবরণ জানিয়েছেন, “ভোরবেলা জগুবাবুর বাজারে গিয়ে দোকানদারদের ঘুম থেকে তুলে বাজার করতেন।...বাজারের ভিতরে অভিনেতা পার্থ মুখোপাধ্যায়দের একটা পাউরুটি-মাখন আর চায়ের দোকান ছিল। আমাদের দুই ভাইকে ওই দোকানে বসিয়ে বাবা, কমল মিত্র আর পাহাড়ী সান্যাল গল্প করতে করতে বাজার করতেন। এটা বাবার দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে পড়ত।” বাড়ির কাছে সাদার্ন মার্কেটে তাঁকে বাজার করতে দেখেছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
অসিতবরণের ‘ইন্টারভিউ’ নিতে গিয়ে সাংবাদিক রবি বসুরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। প্রতাপাদিত্য প্লেসের বাড়িতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন অসিতবরণ সাদার্ন মার্কেট, লেক মার্কেট, গড়িয়াহাট মার্কেট বা জগুবাবুর বাজার যে কোনও একটিতে থাকতে পারেন। অতএব সকালে তাঁকে পেতে হলে এই বাজারগুলো খুঁজে দেখা ছাড়া উপায় নেই। রবি বসু বাধ্য হয়ে তাই করেছিলেন এবং শেষকালে গড়িয়াহাট বাজারে অসিতবরণের দেখা পান। “অসিতবরণ তখন অতি সতর্ক গৃহস্থের মতো মাছের কানকো তুলে পরীক্ষা করছেন আর ধস্তাধস্তি করে দরদস্তুর করছেন।” এ ঘটনা অসিত সেন পরিচালিত ‘চলাচল’ মুক্তি পাওয়ার সময়ের। এর থেকে তৎকালীন জনপ্রিয় নায়কদের একটা ছবি যেমন ফুটে ওঠে, তেমনই মানুষ অসিতবরণও এক অন্য চেহারায় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান। সে দিনের সেই বাজারে এক যুবক অসিতবরণকে দেখে বলেছিল, “কাল বসুশ্রীতে ‘চলাচল’ দেখলাম। টেরিফিক অ্যাক্টিং করেছেন আপনি।” এর প্রতিক্রিয়ায় অসিতবরণের জবাব ছিল, “তোমার ভাল লেগেছে ভাই?” ছেলেটির উত্তর “দারুণ লেগেছে।” অসিতবরণ, “তা হলে আর একবার দ্যাখো, তোমার বন্ধুবান্ধবদেরও দেখতে বোলো। প্রোডিউসার দুটো পয়সা পাবে।”
বনানীর মনে আছে, সিনেমায় কাজ করাটা অসিতবরণের কাছে চাকরি করার মতোই ছিল। “তিনি অবশ্যই নিউ থিয়েটার্সের মাইনে করা অভিনেতা ছিলেন, তবু পেশা ও ব্যক্তিজীবনকে আলাদা রেখেছিলেন আজীবন। বাড়িতে কখনও সিনেমার আলোচনা হত না। এমনকি মহরত বা শুটিংয়েও বাড়ির কাউকে কখনও নিয়ে যেতেন না।”
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে আছে, “ছোটবেলায় আমরা তিন ভাইবোন ওঁর সঙ্গে একটা ছবিতে অভিনয় করেছিলাম। ছবিটার নাম ‘অর্ধাঙ্গিনী’। সেখানে আমি অসিতবরণ ও মঞ্জু দে-র ছেলে হয়েছিলাম। বাবার সঙ্গে ওঁর ভাই-দাদার সম্পর্ক ছিল। নানা অনুষ্ঠানে ওঁকে আমি গাইতে শুনেছি। এমনকি রবীন মজুমদারের হিট গানও উনি ফাংশনে গাইতেন।”
অসিতবরণের ‘রসরঙ্গ’ নামে একটি দল ছিল। এই দলের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ও সারদা মাকে নিয়ে একটা আলেখ্য করেছিলেন, যেখানে প্রভাতবরণ স্তোত্রপাঠ করতেন আর বিবেকানন্দর গান গাইতেন অসিতবরণ। অনেক জায়গায় এর শো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বনানী।
রঙ্গমঞ্চ বা কমার্শিয়াল থিয়েটারে অসিতবরণ নিয়মিত অভিনয় করতেন। তাঁর অভিনীত নাটকগুলির একটি তালিকার সন্ধান দিয়েছেন অসিতবরণের নাতি অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়। ‘সেতু’, ‘বিবর’, ‘ক্ষুধা’, ‘লগ্ন’, ‘জাগো’, ‘রাধা’, ‘দ্বিধা’, ‘অ্যান্টনি কবিয়াল’, ‘পরিণীতা’। এ ছাড়াও আরও নাটক আছে, যা নথিভুক্ত হয়নি। তবে ২৭ নভেম্বর ১৯৮৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত এক ইংরেজি দৈনিকের তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৭ সালে প্রথম কমার্শিয়াল থিয়েটারে কাজ শুরু করেন তিনি ‘মহানগর’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। প্রায় এক ডজন নাটকে অভিনয় করেছিলেন বলে জানা যায়।
সালকিয়ার শিসমহল মঞ্চে অসিতবরণের সঙ্গে প্রথম অভিনয় করার সুযোগ হয়েছিল বনানী মুখোপাধ্যায়ের ‘দ্বিধা’ নাটকে। তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন নাটক অভিনয়কে কেমন আড্ডায় ও আনন্দে ভরিয়ে রাখতেন অসিতবরণ। মজার আর একটা ঘটনার কথাও জানালেন তিনি, “১৯৫৯ সাল। ‘সেতু’ নাটকে অভিনয় করছেন তৃপ্তি মিত্র। নাটকে তাঁর সহ-অভিনেতা অসিতবরণ, তরুণকুমার প্রমুখ। এই নাটক দিয়েই ‘বহুরূপী’ নাট্যদলের অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রর পেশাদার নাট্যজগতে অভিনয়ের শুরু। বাংলার পেশাদার নাট্যজগৎ যে ঠিক কী রকম, সে সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণা না থাকারই কথা। কিন্তু অসিতবরণের সঙ্গে এই নাটকে অভিনয় করতে এসে তিনি অসিতবরণকে চিনেছিলেন অন্য ভাবে। সে দিন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলায় মোহনবাগান জিতেছিল। অসিতবরণ, তরুণকুমার ছিলেন কট্টর মোহনবাগানের সমর্থক। দু’জনেই খুবই খুশি ও উত্তেজিত। ঠিক করলেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থক তৃপ্তি মিত্রকে হতচকিত করবেন। শো শুরু হয়েছে, তৃপ্তিদি মঞ্চে। এ বার প্রবেশ অসিতবরণ এবং তরুণকুমারের। তৃপ্তিদি দেখলেন দু’জনে মঞ্চে এসেই নাটকের সংলাপের বদলে মোহনবাগান- ইস্টবেঙ্গলের খেলাকে কেন্দ্র করে অন্য সংলাপ বলে চলেছেন। পেশাদার মঞ্চে নবাগতা তৃপ্তিদি কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। রীতিমতো হতভম্ব হয়ে নিঃশব্দে মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। এ দিকে অসিতবরণ ও তরুণকুমার বুঝলেন, ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। দর্শকরা তখনও অবধি কিছু বুঝতে না পারলেও অচিরেই পারবেন। অসিতবরণ সংলাপ বানিয়ে তরুণকুমারকে অপেক্ষা করতে বলে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে ছুটলেন মেকআপ রুমের দিকে। গিয়ে দেখেন গম্ভীর মুখে তৃপ্তিদি বসে আছেন। তিনি অসিতবরণকে প্রশ্ন করলেন, তাঁরা যা সংলাপ বলছেন তা তো নাটকে নেই! অসিতবরণ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জানালেন, সবটাই মজা করার জন্য করা। তৃপ্তি মিত্র যেন কিছু মনে না করেন। ‘বহুরূপী’র শৃঙ্খলায় গড়ে ওঠা তৃপ্তি হতবাক। এমন করেই কি নাটক হয় পেশাদার মঞ্চে! অসিতবরণ জানালেন সবটাই তাঁর ও তরুণকুমারের পরিকল্পনা। ইস্টবেঙ্গল সমর্থক তৃপ্তির সঙ্গে মজা করার জন্যই।”
এই ছিলেন অসিতবরণ, যাঁর কাছে অভিনয় হল জীবনের আনন্দের অংশ। হাসতে-হাসতে তিনি তাঁর অভিনয় জীবন কাটিয়ে গিয়েছেন আর খ্যাতির শীর্ষ ছুঁয়েছেন। ষাটের গোড়ায় বিশ্বরূপায় ‘সেতু’ নাটকটি অনেক রজনী পার করেছিল, যা সম্ভবত আজও রেকর্ড। অসিতবরণের পুত্র জানিয়েছেন, “‘সেতু’র একটা দৃশ্যে নায়িকা তৃপ্তি মিত্রকে ট্রেনে কাটা পড়া থেকে বাঁচাতে গিয়ে উইংসের একটা খোলা ক্ল্যাম্পে লেগে বাবার পায়ের মাংস উঠে গিয়ে হাড় বেরিয়ে গিয়েছিল। তখন অন্য এক অভিনেতাকে দিয়ে ওই চরিত্রে অভিনয় করানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু দর্শকদের পছন্দ না হওয়ায় রাসবিহারী সরকার (‘বিশ্বরূপা’র মালিক) কিছু দিন নাটক বন্ধ রাখতে বাধ্য হন।” এছাড়া কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে ‘ভোলা ময়রা’ নাটকে ভোলা ময়রার চরিত্রে অসিতবরণের অভিনয় দেখতে ইন্দিরা গাঁধী এসেছিলেন বলে জানিয়েছেন রজতবরণ।
অসিতবরণের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৪১ সালে বাংলায় ‘প্রতিশ্রুতি’ ও ১৯৪২ সালে হিন্দি ‘সৌগন্ধ’ ছবির সাফল্যের মধ্য দিয়ে। আকাশবাণীর নিতান্ত এক তবলিয়া রাতারাতি বদলে গিয়েছিলেন ভারতজোড়া জনপ্রিয় এক গায়ক-নায়কে। পরিচালক হেমচন্দ্র চন্দ্র অবশ্যই অসিতবরণকে তৈরি করেছিলেন তাঁর ওই ছবি দু’টির মধ্য দিয়ে। এর পর ক্রমশ অন্যান্য পরিচালকরাও অসিতবরণকে নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। নিউ থিয়েটার্সের অভিনেতা হওয়ায় বাংলা চলচ্চিত্র দুনিয়ায় অসিতবরণের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে গিয়েছিল। তখনকার প্রায় সব বড় বড় পরিচালক অসিতবরণের উপর নির্ভর করতেন। মোট ৩২জন পরিচালকের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। হেমচন্দ্র চন্দ্র, অগ্রদূত, অগ্রগামী, যাত্রিক, বিজয় বসু, চিত্ত বসু, নীতিন বসু, বিমল রায়, সলিল দত্ত, অজয় কর, তরুণ মজুমদার, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, ভি শান্তারাম, সুবোধ মিত্র এমনকি উত্তমকুমারের পরিচালনায় ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ ছবিতেও কাজ করেছেন।
সত্যজিৎ রায়ের কোনও ছবিতে অসিতবরণ কাজ করেননি কেন, সাংবাদিক রবি বসুর এই প্রশ্নের উত্তরের অসিতবরণ জানিয়েছিলেন “ওরে বাবা, উনি হলেন গ্রেট মাস্টার। প্রয়োজন হলে নিশ্চয়ই ডাকবেন একদিন। এই শহরে আমরা তো দু’জনেই আছি। নিশ্চয়ই একদিন ডাক আসবে।” দুঃখের বিষয়, ডাক কোনও দিনই আসেনি। কিন্তু দু’জনের পরিচয় যে ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সুশীল ঘোষের ‘সিঁদুরে মেঘ’ ছবির ক্ল্যাপস্টিক দিতে আসা অসিত সেন ও সত্যজিৎ রায়ের উপস্থিতির একটি স্টিল ছবিতে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ক্ল্যাপস্টিক শটটি দিচ্ছেন মাধবী মুখোপাধ্যায় ও অসিতবরণ। ছবিটি ১৯৬৪ সালে ‘চারুলতা’র সঙ্গে ওই একই বছরে মুক্তি পায়।
প্রসঙ্গত, প্রায় একই সময়ে আরও একজন গায়ক-নায়ক বাংলা সিনেমায় প্রবেশ করেছেন প্রমথেশ বড়ুয়ার হাত ধরে। তিনি স্বনামধন্য রবীন মজুমদার। সমসাময়িক এই দুই গায়ক-নায়কের উপর ভরসা করে সেই পর্বের বাংলা চলচ্চিত্র এগিয়েছিল আরও প্রায় ১৫ বছর, যতক্ষণ পযন্ত না সে প্রথম দেখা পেয়েছিল তার ইতিহাসের প্রথম ‘স্টার’ উত্তমকুমারের। শুরু হয়েছিল বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের। তাই উত্তম পূর্ববর্তী বাংলা সিনেমায় রবীন মজুমদার, অসিতবরণ জনপ্রিয় নায়কদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেও স্টার বলতে যা বোঝায় এঁরা তা ছিলেন না। এঁদের যোগ্যতার একটা বড় শর্ত ছিল, অভিনয়ের পাশাপাশি গান গাইতে পারা। তাই নায়কোচিত চেহারা না থাকলেও গানের গলার মিষ্টতা দর্শকদের কাছে তাঁদের জনপ্রিয় হয়ে উঠতে সাহায্য করত।
অসিতবরণ তাঁর ৪৬ বছরের অভিনয় জীবনে ঠিক কত ছবিতে অভিনয় করেছেন, তা বলা মুশকিল। সাংবাদিক রবি বসুর দাবি ‘দুশোর বেশি’। মতান্তরে ‘আড়াইশো’। ‘ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেস’ মোট ৬৪টি ছবির তালিকা দিলেও তা নির্ভুল নয়। ‘ইন্ডিয়ানসিনে.মা’ ৪৬টি ছবির তালিকা দিয়েছে। তবে এর মধ্যে গায়ক-নায়ক হিসেবে সাতটি ছবির নাম রয়েছে। ১৯৪১ ‘প্রতিশ্রুতি’ (বাংলা, পরিচালনা: হেমচন্দ্র চন্দ্র) ও ১৯৪২ ‘সৌগন্ধ’ (হিন্দি, পরিচালনা: হেমচন্দ্র চন্দ্র), ১৯৪৩ ‘কাশীনাথ’ (বাংলা ও হিন্দি, পরিচালনা: নীতিন বসু), ১৯৪৮ ‘ওয়াপস’ (হিন্দি, পরিচালনা: হেমচন্দ্র চন্দ্র) ১৯৪৯ ‘মঞ্জুর’ (হিন্দি, পরিচালনা: হেমচন্দ্র চন্দ্র), ১৯৫৪ ‘জয়দেব’ (বাংলা, পরিচালনা: ফণী বর্মা), ‘নিষিদ্ধ ফল’ (বাংলা, পরিচালনা: পশুপতি চট্টোপাধ্যায়)।
তবে এই তালিকাও নির্ভুল এমন বলা মুশকিল। কারণ ১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে অসিতবরণ দু’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন। সংগ্রাহক ও গায়ক দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন গান দু’টি হল, ‘আমরা দুজনা স্বর্গ খেলনা গড়িব না ধরণীতে’ ও ‘সে কোন বনের হরিণ ছিল আমার মনে’ (সুপ্রীতি ঘোষের সঙ্গে)। অসিতবরণ পরবর্তীকালে আরও অনেক ছবিতেই গান গেয়েছেন। তবে সে সব গান যেহেতু প্লেব্যাক পদ্ধতিতে গাওয়া, তাই হয়তো এমন ছবিগুলিকে তালিকার বাইরে রাখা আছে। তবে ‘প্রতিশ্রুতি’ ছবিতে তাঁর স্বকণ্ঠে গাওয়া গান দু’টি হল, ‘রাজার মেয়ে কাহার লাগি গাঁথছ মণিহার’ ও ‘আমার ভুবনে এলো বসন্ত’, যার হদিস দিয়েছেন দেবজিত।
এ ছাড়া যে সব হিন্দি গান সারা ভারতে জনপ্রিয় হয়েছিল, ‘তুমনে মুঝসে প্রেম জতা কর’ (ওয়াপস), ভারতীদেবীর সঙ্গে গাওয়া ‘ম্যায় ফুল নেহি সামায়ে’ (ওয়াসিতনামা), ‘হম চলে ওয়তন কে ওর’ (কাশীনাথ), ‘হম কোচওয়ান’ (ছবি ওয়াপস) ইত্যাদি। এ ছাড়াও হিন্দিতে আরও খানকুড়ি গানের হদিস পাওয়া যায়। কিন্তু সংক্ষণের অভাবে এই সব গান সাধারণের কাছে আজ আর সহজলভ্য নয়। অসিতবরণের ভারতজোড়া খ্যাতির আর একটি প্রমাণ হল ১৯৫৩ সালে বিমল রায়ের ‘পরিণীতা’ ছবিটি। যেখানে প্রধান চরিত্রদের মধ্যে ছিলেন অশোককুমার, মীনাকুমারী ও অসিতবরণ। এই ছবিতে তাঁর কন্ঠে গাওয়া ‘টুটা হ্যায় নাতা প্রীত কা’ খুবই জনপ্রিয় গান।
১৯৪১ থেকে ১৯৫৩ অসিতবরণ জনপ্রিয় গায়ক-নায়ক হিসেবে চুটিয়ে অভিনয় করে গিয়েছেন। এরই মধ্যে ১৯৪৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দৃষ্টিদান’ ছবিটি উত্তমকুমারের প্রথম ছবি হিসেবে চিহ্নিত। এই ছবির নায়ক ছিলেন অসিতবরণ। এর পর ১৯৫৪ সালে ‘মন্ত্রশক্তি’ ছবিতে আবার অসিতবরণ ও উত্তমকুমার একসঙ্গে অভিনয় করেন। তবে ইতিমধ্যে দর্শক রুচির বদল ঘটতে শুরু করেছে। ‘ফ্লপমাস্টার’ বলে পরিচিত উত্তমকুমার ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪-এর মধ্যে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে বাংলা সিনেমার গতিপথ বদলে দিয়েছিলেন। নবীন অভিনেতাকে পথ ছেড়ে দিতে হয়েছিল প্রবীণ অসিতবরণকে। বাংলা সিনেমার প্রথম ‘স্টার জুটি’ হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন উত্তম-সুচিত্রা। এই পট পরিবর্তনের নানা সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা চলচ্চিত্র গবেষকরা করতেই পারেন। তবে অসিতবরণ, রবীন মজুমদারদের মতো গায়ক-নায়করা চলচ্চিত্র ইতিহাসের এক বিশেষ কালপর্বের উজ্জ্বল প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।
প্রথম ছবি ‘প্রতিশ্রুতি’তে পাহাড়ী সান্যাল,অসিতবরণ এবং অপর্ণা দেবী ।
এখনও অবধি পাওয়া তথ্য অনুযায়ী অসিতবরণের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘লালন ফকির’। যে ছবিতে তিনি লালন সাঁইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ছবিটি তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৮৭ সালে মুক্তি পায়। ১৯৮১ সালের ৯ অগস্ট অসিতবরণের স্ত্রী রাধারাণী মারা যান। আর নিজের একাত্তর বছরের জন্মদিনের আট দিন পর অসিতবরণ ১৯৮৪ সালের ২৭ নভেম্বর প্রথমে ইউরেমিয়া ও পরে কিডনির অসুখে ভুগে আমাদের ছেড়ে চলে যান। খবর পেয়ে তাঁর বাড়িতে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়। সুচিত্রা সেন শোক প্রকাশ করতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “মিষ্টি স্বভাবের মানুষটি চিরতরে চলে গেলেন।” মাধবী মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “চলচ্চিত্র জগৎ একজন সংবেদনশীল অভিনেতা ও হৃদয়বান মানুষকে হারাল।” অসিতবরণের মরদেহ নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়ো হয়ে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়।
ছবি সৌজন্য: অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়