দেবী: দেবভাষা আয়োজিত পার্থপ্রতিম গায়েনের প্রদর্শনী
দেবী দুর্গার বহুল-প্রচলিত যে রূপটি দুনিয়ার মানুষের কাছে পরিচিত, সেখানে দশটি বাহুরই প্রাধান্য। দেবীর বহু নামের মধ্যে একটি নাম তাই ‘দশভুজা’। দেবভাষা কর্তৃপক্ষ ‘দশভুজা’ নামে ভাস্কর্যের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। সবই ব্রোঞ্জ। রূপায়ণ করেছেন পার্থপ্রতিম গায়েন। আশ্চর্যের এটাই, যে-নামে প্রদর্শনী, দু’টি ছাড়া অন্য ভাস্কর্যগুলির সঙ্গে তার কোনও সাদৃশ্য নেই। দশটি ছোট কাজের মধ্যে সাতটি ক্ষেত্রেই দেবীর দু’টি মাত্র হাত নির্মিত। প্রায় রিলিফ ভাস্কর্য থেকে পৌত্তলিক রূপ, জমাট ও অপেক্ষাকৃত ভারী আয়তনেরও দু’টি কাজ ছিল। কাজগুলি তুলনামূলক ভাবে একটু অন্য রকম। যে সব গুণে একটি সম্পূর্ণ ভাস্কর্যের নির্মিতি, এখানে তা থেকে সরে এসে তিনি পরিবর্তিত কিছু রূপকে আশ্রয় করেছেন। এই বিবর্তনের পথ তাঁকে কয়েকটি প্রান্তের সীমায় পৌঁছে দিয়েছে। পার্থর দ্বিভুজা দুর্গার আটটি রূপ। এই প্রান্তসীমার কয়েকটি প্রচ্ছন্ন ও আপাত-অতীন্দ্রিয় দিক কিন্তু তাঁর ভাস্কর্যগুলিকে চিনে নিতে সাহায্য করে। প্রধানত প্রত্নভাস্কর্য, বাংলার মন্দিরের ভিত্তি-ভাস্কর্যের রিলিফ, পৌরাণিক মূর্তিতত্ত্বের শৈল্পিক গঠন ও রূপ, গ্রামীণ ও লোকায়ত সরল এক পৌত্তলিকতা, অতি সরলীকরণ প্রক্রিয়ায় মিশে যাওয়া লোকজ আঙ্গিক ও প্রত্ন-পৌত্তলিক মোটিফ— সবই যেন কোথায় দ্রবীভূত হয়ে যায়। এর সব ক’টি ফর্মের অভ্যন্তরীণ রস তিনি গ্রহণ করে, নিজস্ব স্টাইলাইজ়েশনে কাজগুলি করেছেন। কাজগুলি যে সর্বক্ষেত্রে যথার্থ, তা নয়।
যে আত্তীকরণ তাঁকে অনুভব করিয়েছিল দ্বিভুজার রূপগুলিকে, সেখানে কিছু ক্ষেত্রে এক ধরনের মোনোটোনি প্রশ্রয় পেয়েছে। রিলিফ ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে টোটাল স্কাল্পচারের ব্যাখ্যা খাটে না। পরিসর ও পাশাপাশি মূর্তি-মানবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গড়ন ও ব্যবহার একরকম। ত্রিমাত্রিকতার চিহ্ন অনুপস্থিত। যখনই একক ভাবে দেবদেবীকে সেই আঙ্গিকে রূপ দিতে হয়— সেখানে স্পেস, অনুষঙ্গ, অ্যারেঞ্জমেন্ট, রূপকল্পের ব্যবহারের প্রসঙ্গ এসে যায়। শিল্পী সে ভাবেই তাকে রূপ দেন। এখানেও সে সব ক্ষেত্রে তখন তাঁকে আশ্রয় নিতে হয়েছে বিভিন্ন মোটিফ, বিভূষণ, নকশা ইত্যাদির।
পেডেস্টাল ছাড়া প্রায় সব ভাস্কর্যই দৈর্ঘে এক ফুট বা সামান্য বেশি। চওড়া ওরই কিছু কম বা কাছাকাছি। একটি বিষয় নিঃসন্দেহ যে, প্রাচীন মূর্তিতত্ত্ব, তার শৈলী, মথুরা থেকে পাওয়া দেবী দুর্গার টেরাকোটা বা প্রস্তরমূর্তির রূপ ও আদল— ঐতিহাসিক মূর্তিশিল্পের এমন অধিকাংশ আবহই কিন্তু পার্থপ্রতিমের প্রতিমা-কল্পনাকে চিহ্নিত করে। হয়তো কাজ করতে করতে এমন সব রেফারেন্সকে তিনি অগ্রাহ্য করতে পারেননি। প্রতীকধর্মিতাও সে ক্ষেত্রে লক্ষ করা গিয়েছে।
কাজগুলিতে পাতিনার ব্যবহারও বেশ। ডার্ক, রেডিশ ব্রাউন, স্ট্র-ইয়েলো থেকে ব্লু ও অ্যান্টিক গ্রিনের পাতিনার ফলে অনুজ্জ্বলতার মধ্যেও আশ্চর্য কিছু দ্যুতি ও ঔজ্জ্বল্যের সাক্ষ্য আছে। দণ্ডায়মান, কিছুটা কৃশশরীরী প্রতিমাকল্পে ‘কল্যাণী’র শান্ত সমাহিত রূপ, পায়ের সামনে বেশ আয়ত ও স্থূল ত্রিশূলের ফলা। উল্লম্ব কাজটিতে চমৎকার ব্লু-গ্রিন পাতিনা দৃষ্টিনন্দন। রেডিশ ব্রাউনের ‘শ্রীদুর্গা’র প্রত্নভাস্কর্যের অলঙ্কার ও মোটিফ বিদ্যমান। প্রায় অনুরূপ ‘শান্তিরূপা’র লম্বা খাড়া ত্রিশূলের দণ্ডের পিছনে ত্রিকোণ, দু’পাশে সামান্য নকশায়িত তরঙ্গের মতো রেখাঙ্কন। এটিও প্রাচীন মূর্তির ত্রিনয়নী প্রত্নরূপ। ‘মহাবিদ্যা’র পৌত্তলিক দশভুজা রূপটিতে সম্পূর্ণ ভাবে এক লৌকিক গ্রাম্য আদলের সঙ্গে প্রত্নতত্ত্বের আবহ মিলেমিশে আছে।
দু’রকম গ্রিন পাতিনা সমৃদ্ধ ‘দেবী’র ফর্ম সম্পূর্ণ লৌকিক গ্রাম্যশিল্পের পৌত্তলিক রূপ। আপাতবিমূর্ত হয়েও আদিম বিগ্রহের সঙ্গে লোকশিল্প মিলেমিশে আছে। কয়েকটি লাইনের ঘনত্বে দশটি হাতকে মাথার উপরে দেখিয়েছেন। দুরূহ মুখ, মুকুট ও স্তনের উচ্চাবচ ঔজ্জ্বল্য এর অন্যতম আকর্ষক দিক, রূপান্তরের ক্ষেত্রেও। ‘গণেশজননী’ টোটাল স্কাল্পচার। যেন ক্ষয়িষ্ণু, পৃথুলা আধশোয়া জননীর ক্রোড়ে বৃহৎ মাথার গণেশ। ভারী ও আয়তাকার ‘জগজ্জননী’ রূপহীন বিগ্রহের মতো। পিছন থেকে হঠাৎ সামনে আসা দু’টি হাত আধাবর্তুল এক ফর্মেশনকে আগলে রেখেছে। মাঝে সেই হস্তী— যার শুঁড়-উত্থিত, বঙ্কিম, উত্তোলিত মৃণালের আগায় প্রস্ফুটিত পদ্ম। একেবারে উপরে জমাট তরুবরের বিচিত্র বিন্যাস। প্রদর্শনীতে তাঁর ‘অসুরদলনী’ অলক্ষিত। ‘দুর্গা মহামায়া’র শান্ত দণ্ডায়মান রূপ, বিশেষত দু’পাশের কলকাময় পদ্মপুষ্পের শোভা অনবদ্য। অসি-উত্তোলিত হস্তের ‘শক্তিরূপিণী’ চমৎকার। পুষ্পনকশা শোভিত ‘মহাদেবী’ কেন বাহুহীন? দু’পাশের আলাদা সাপোর্টে হঠাৎ দশটি তালুর সংযোজন? এ কোন সঙ্কেত?