অঙ্কন: কুনাল বর্মণ
‘নৌকা দেখিতে২ ভাটার জোরে বাগবাজারের ঘাটে আসিয়া ভিড়িল। রাত্রি প্রায় সেষ হইয়াছে— কলুরা ঘানি জুড়ে দিয়েছে, বল্দেরা গরু লইয়া চলিয়াছে— ধোবার গাধা থপাস২ করিয়া যাইতেছে— মাছের ও তরকারির বাজরা হু২ করিয়া আসিতেছে— ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কোশা লইয়া স্নান করিতে চলিয়াছেন— মেয়েরা ঘাটে সারি২ হইয়া পরস্পর মনের কথাবার্ত্তা কহিতেছে। কেহ বলিছে পাপ ঠাকুরঝির জ্বালায় প্রাণটা গেল— কেহ বলে আমার শাশুড়ী মাগি বড় বৌকাঁটকি— কেহ বলে দিদি আমার আর বাঁচ্তে সাধ নাই— বৌছুঁড়ি আমাকে দু পা দিয়ে থেত্লায়— বেটা কিছুই বলে না; ছোড়াকে গুণ করে ভেড়া বানিয়েছে— কেহ বলে আহা এমন পোড়া জাও পেয়েছিলাম দিবারাত্রি আমার বুকে বসে ভাত রাঁধে, কেহ বলে আমার কোলের ছেলেটির বয়স দশ বৎসর হইল— কবে মরি কবে বাঁচি এই বেলা তার বিএটি দিয়ে নি।’
‘গার্হস্থাশ্রম ও যোগ আশ্রম পৃথক। যাহারা চরম আশ্রম অবলম্বন করিয়া ব্রহ্মলাভ করিতে চাহে, তাহারা অবশ্যই সর্ব্ব সঙ্গ ত্যাগ করিয়া ঈশ্বরের সঙ্গ করিবে ও ঐ লাভার্থে গৃহ ও সামাজিক বন্ধন হইতে ক্রমশঃ অবশ্য মুক্ত হইবে। স্ত্রীলোক নানা শ্রেণীয় কেহ কেহ কেবল গৃহ ও সমাজ লইয়া রহিয়াছেন ও পরিমিতরূপে ঈশ্বর-উপাসনা ও ধর্ম্ম কর্ম্ম করিতেছেন।... পূর্ব্ব ব্রহ্মবাদিনীরা ছিলেন, তাঁহাদিগের আনন্দ কেবল ধ্যানানন্দ ও ব্রহ্মানন্দ। তাঁহারা পাণিগ্রহণ করিতেন না। জীবনের লক্ষ্য অনুসারে কার্য্য। যে যে আশ্রম অবলম্বন করণে শুদ্ধ আনন্দ পাইবে, সে সেই আশ্রম অবলম্বন করিবে। ঈশ্বর অনন্ত, অসীম, ঈশ্বরের
সহিত মিলিত হইতে গেলে অন্তর যোগ চাই।’
‘ফাল্গুন ও চৈত্র মাসের দশ বারো দিনের মধ্যে জমিতে চাস দিতে হইবেক। লাঙ্গল চারিবারের কম হইবেক না, অধিক দিতে পারিলে ভাল। তাহার পরে খইল, গোবর ও দেওয়াল ভাঙা মাটি জমিতে মিশাইয়া আবার লাঙ্গল দিবে। তাহার পরে মই দিয়া জমি তৈয়ার করিতে হইবে। এইরূপ করিলে মাটি ধূলার ন্যায় হইবে তাহার পরে জমিতে দাঁড়া টানিতে হইবে তাহা হইলে দাঁড়ার মধ্যে২ এক২ জোল হইবে, সেই জোলের মুটম হাত অন্তরে ইক্ষুর বীজ পুঁতিতে হইবে। বীজ পুঁতিবার সময় খইলকে ঢেঁকিতে কুটিয়া মিহিন করিয়া এক২ খাদে এক২ পোয়া দিবে। বীজ পোতা হইলে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত রোজ২ এক২ সের জল এক২ গাছের গোড়ায় দিতে হইবে।...’
এই তিনটে অনুচ্ছেদ একই মানুষের লেখা, বললে বিশ্বাস করবেন? একুশ শতকে বাংলা গদ্য লেখকপ্রবর থেকে ফেসবুকশ্রী সকলের হাতে পড়ে বহুরূপে সম্মুখে; সোশ্যাল মিডিয়ায় লোকে ধর্ম থেকে জিরাফ... নিয়ে লিখছেন, তবু এক লেখক একাধিক কলমে, নানা় আঙ্গিকে লিখছেন, দেখা যায় না বড়। কিন্তু সেই কাণ্ডই কত আগে যে করে গিয়েছেন প্যারীচাঁদ মিত্র! স্কুলে পড়া বইয়ের স্মৃতির দৌলতে সিপাহি বিদ্রোহের সালটা সকলের জানা— ১৮৫৭। পরের বছরেই কলকাতার নিমতলার মিত্তিরমশাই ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ ছদ্মনামে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামের বই বার করে যে হুলস্থুল বাধিয়েছিলেন, তারই ফল ফেবু-টুইটারে জলবৎ তরলং বাংলা ভাষায় ছোটবড় গদ্য-লেখালিখি, বললে বড় ভুল হবে না। সমস্যাটা শুধু বাঙালি প্যারীচাঁদ মিত্রকে চেনে না, লিট-ফেস্টে ওঁর ছবি দেখিয়ে ‘বলুন তো ক্কে?’ শুধোলে মুচ্ছো যাবে, ‘আলালের ঘরের দুলাল পড়েছেন?’ প্রশ্নে ‘হুমম... বলছি’ বলে আড়ালে গুগল করে তথ্য বাগানোর চেষ্টা করবে। বাঙালি সাহিত্য ‘করে’, সাহিত্যের ইতিহাসের শেকড়বাকড়ে তার
কী লাভ?
(বয়ে) যেতে পারি কিন্তু কেন
অথচ ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ ছদ্মনামের আড়ালে লুকিয়ে যে মানুষটা, সেই প্যারীচাঁদ মিত্রের (১৮১৪-১৮৮৩)জীবনটা ‘কাল্টিভেট করলে’ উনিশ শতকীয় বাঙালির শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতি এমনকি ব্যবসাবাণিজ্যের গ্রাফটাও তার উঁচুনিচু সিঁড়ি ভাঙা-সমেত বিলক্ষণ বোঝা যেত। বোঝা যেত, উনিশ শতকের যে ‘বাবু’ কালচারকে আমরা পট থেকে বটতলা বা অতিসরলীকৃত পিরিয়ড ড্রামা-টিভি সিরিয়ালসূত্রে জানি, সে নেহাতই অন্ধের হাতি দেখার মতো। সেখানে ধনী অভিজাত বাবু মাত্রই মদ্যপ, লম্পট, যৌনতাকাতর, শোষক; মেয়েরা হয় সতী সাবিত্রী নয় বাহিরমুখী। গোটা সমাজটাই মূলত সাদা-কালোর বিপ্রতীপে দেখানো, যেন অফ হোয়াইট, ছাই, ধূসর, স্লেট রং বলে কিছু নেই জনজীবনের প্যালেটে। প্যারীচাঁদ মিত্রকে এ কারণেই জানা আর পড়া দরকার। কারণ তাঁর জীবনে ও লেখালিখিতে বাঙালির রেনেসাঁস-প্রদীপ আর তার তলার অন্ধকার, দুটোই স্পষ্ট। ইংরেজশাসিত, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত একটা জাতি সাহিত্য থেকে সমাজসংস্কার, ধর্ম থেকে ব্যবসা, প্রতিটি ক্ষেত্রে একটা পা রাখার জায়গা তৈরি করছে। তাকে পা ফেলতে হচ্ছে ভেবেচিন্তে, কারণ ওল্টানো-পাল্টানো যা কিছু, তাকে করতে হবে ‘সিস্টেম’-এর ভিতরে থেকেই। স্বভাবতই, উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের অনেক মুখেই পড়েছে স্ব-বিরোধের ছায়াও। প্যারীচাঁদও ব্যতিক্রম নন, তবে তাঁর জীবন আর কাজকর্ম এতই সুকৃতির বৈচিত্রে ভরা যে, সেই বিরোধ-বৈষম্যও খানিক দরদি চোখেই দেখতে ইচ্ছে হয়।
ঠাকুরদা গঙ্গাধর মিত্র হুগলি থেকে কলকাতায় এসে, কোম্পানির আমলে দেওয়ানগিরি করে পয়সা করেছিলেন বিস্তর। বিয়ে করেছিলেন হাটখোলার দত্ত পরিবারের মেয়েকে। প্যারীচাঁদের বাবা রামনারায়ণ মিত্রও কোম্পানির কাগজ আর হুন্ডির কারবার করে ফুলেফেঁপে ওঠেন। নিমতলার মিত্রদের পয়সার অভাব ছিল না, তাঁর চেয়ে বছর ছয়েকের ছোট বিদ্যাসাগরের মতো দারিদ্র্যের মুখ কখনও দেখতে হয়নি প্যারীচাঁদকে। বরং সে কালের ধনী বাবুবাড়িতে যা তখন স্বাভাবিক— বখে যাওয়া, তার সুযোগ ছিল। প্যারীচাঁদ তাঁর প্রথম বইয়ের ‘নায়ক’ মতিলালের উচ্ছন্নে যাওয়া এঁকেছেন স্বচ্ছন্দে, কিন্তু নিজের জীবনে উচ্ছৃঙ্খলতার মুখে দোর দিয়ে রেখেছিলেন। এমনকি হিন্দু কলেজে পড়তে গিয়ে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়ো ও ‘ইয়ং বেঙ্গল’দের সঙ্গ করার পরেও তাঁর জীবন অদ্রোহী, সুস্থিত! তিনি ডিরোজ়িয়োর ছাত্র, কিন্তু ‘ডিরোজ়িয়ান’ নন। প্যারীচাঁদ পরে হিন্দু কলেজ তথা সে কালের কলকাতার আর এক অগ্রপুরুষ ডেভিড হেয়ারের ইংরেজি ও বাংলা জীবনচরিত লিখেছিলেন, কিন্তু ডিরোজ়িয়োর জীবনী লেখেননি। সেই বইয়ে ডিরোজ়িয়োর উদার মনন ও ছাত্রদরদের প্রশংসা আছে, কিন্তু বন্ধু ইয়ং বেঙ্গলিদের নিন্দায় ধুয়ে দেওয়া নেই। কলকাতার বাবুরা (তার মধ্যে প্যারীচাঁদের বন্ধুরাও আছেন) যখন মদে গড়াগড়ি, প্যারীচাঁদ তখন মদ্যপাননিবারণী সভার কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী, ‘আলালের...’ পরের বছরেই লিখছেন তাঁর দ্বিতীয় বই, মদ্যপানবিরোধী নীতিমূলক আখ্যান ‘মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’। তার শুরুর লেখাটিতেই মাতালদের নিয়ে রসগল্পের ছড়াছড়ি: ‘মদের অদ্ভুত শক্তি! যে ব্যক্তি পান করে, সে দুধকে জল বলে ও জলকে দুধ বলে। কলিকাতার কোন বুনিয়াদি মাতালের বাটীতে তাঁহার চাকর প্রস্রাব করিতেছিল, মাতালবাবুর মস্তকে পড়িলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, আমার মাথায় কি পড়িল? পরে শুনিলেন— প্রস্রাব। তখন আপনি কহিলেন— তবে ভাল, আমি বোধ করিয়াছিলাম— জল।’
কী লিখছি, কেন লিখছি
‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রথমেই আস্ত বই হয়ে বেরোয়নি। আগে পত্রিকায় মুখ দেখিয়েছে ধারাবাহিক ভাবে। সেই ‘মাসিক পত্রিকা’ও প্যারীচাঁদেরই গড়া, বন্ধু রাধানাথ শিকদারের সঙ্গে মিলে, শুরু ১৮৫৪-র অগস্ট থেকে। পত্রিকার উপরের পাতায় লেখা, ‘এই পত্রিকা সাধারণের বিশেষতঃ স্ত্রীলোকদের জন্যে ছাপা হইতেছে, যে ভাষায় আমাদিগের সচরাচর কথাবার্ত্তা হয়, তাহাতেই প্রস্তাব সকল রচনা হইবেক। বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা পড়িতে চান পড়িবেন, কিন্তু তাঁহাদিগের নিমিত্তে এই পত্রিকা লিখিত হয় নাই।’ স্পষ্ট বলে দেওয়া— কাদের জন্য পত্রিকা, কী হবে তার ভাষার ছিরিছাঁদ। ঠিক যেন উনিশ শতকের গোড়ায় লেখা ‘প্রিফেস টু দ্য লিরিক্যাল ব্যালাডস’-এর মতো, যেখানে নিঃশঙ্ক উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়র্থ ইতিহাসে গেঁথে দিচ্ছেন— কেমন হবে রোম্যান্টিক কবিতার ভাষা, কী হবে তার পাঠকচরিত্র। পরে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বইয়ের ভূমিকাতেও প্যারীচাঁদ সোজাসাপটা। লেখেন এই উপন্যাস ‘the first of its kind’, কেন? কারণ এর বিষয়বস্তু। ‘It chiefly treats of the pernicious effects of allowing children to be improperly brought up, with remarks on the existing system of education on self-formation and religious culture.’ নিজের ব্যবহার করা ভাষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এ ভাবে: ‘The work has been written in a simple style, and to foreigners desirous of acquiring an idiomatic knowledge of the Bengali language and an acquaintance with Hindu domestic life, it will perhaps be useful.’
চট করে এক বার এই লেখার গোড়ার লাইনগুলো ফিরে দেখলে প্যারীচাঁদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হবে। তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ঠিক কী— বাংলার প্রথম উপন্যাস, প্রথম সামাজিক উপন্যাস, প্রথম বাস্তবধর্মী আখ্যান, না কি উপন্যাসের পূর্বসূরি— সে নিয়ে বিস্তর তর্ক ও চর্চা আছে। প্যারীচাঁদ নিজে তাঁর ভূমিকায় ইংরেজিতে ‘নভেল’, বাংলায় ‘উপন্যাস’ ব্যবহার করেছেন। ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকা এই লেখায় খুঁজে পেয়েছিল অলিভার গোল্ডস্মিথের হিউমার, হেনরি ফিল্ডিংয়ের উইট। জেমস লং এমনকি প্যারীচাঁদকে বলেছিলেন ‘বাংলার চার্লস ডিকেন্স’! এই সবই যদি বা বাড়াবাড়ি মনে হয়, আর এক ভদ্রলোকের একটা প্রবন্ধ পড়লেই ধন্দ কেটে যাবে। সেখানে তিনি লিখছেন, তাঁর ছোটবেলায় অধ্যাপকেরা যে ভাষায় কথা বলতেন, তা সংস্কৃত ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ বুঝত না। ‘খয়ের’কে ‘খদির’, ‘চিনি’কে ‘শর্করা’, ‘ঘি’কে ‘আজ্য’, ‘কলা’কে ‘রম্ভা’। ‘‘ফলাহারে বসিয়া ‘দই’ চাহিবার সময় ‘দধি’ বলিয়া চীৎকার করিতে হইবে।’’ মুখের ভাষাই এই, তা হলে লেখার ভাষা না জানি কী! সেই ভাষা বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তের হাতে পড়ে পাল্টাল, তবু রইল সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরেই। আরও এক বিপদ— সাহিত্যের বিষয় ছিল ‘সংস্কৃতের এবং কদাচিৎ ইংরেজির ছায়ামাত্র’। এই দুই সঙ্কট থেকেই বাংলা সাহিত্যকে উদ্ধার করলেন প্যারীচাঁদ। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ লিখলেন সেই ভাষায়, ‘যে ভাষা সকল বাঙ্গালীর বোধগম্য এবং সকল বাঙ্গালী কর্ত্তৃক ব্যবহৃত’। লিখলেন সেই উপাদান দিয়ে, যা কুড়িয়ে নেওয়া ‘স্বভাবের অনন্ত ভাণ্ডার’ থেকে। প্রবন্ধের লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘আলালের...’ ক’বছর পরেই বেরিয়েছিল যাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’।
আশ মেটে প্ল্যানচেটে
বঙ্কিমচন্দ্র ‘আলালী ভাষা’ শব্দবন্ধ প্রয়োগ করেছিলেন প্রশংসায়। কিন্তু সমসময় ‘আলালী ভাষা’কে হেয় ভাষা, নিচু ভাষা বলে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি। বিদ্যাসাগর নাকি এই ভাষা শুনে হাসতেন। মজার কথা এই, পরপর দু’বছরে দু’টি (১৮৫৮-তে ‘আলাল’ এবং ১৮৫৯-এ ‘মদ খাওয়া...’) বই বেরোনোর পরে সে অর্থে প্যারীচাঁদ আর ‘আলালী ভাষা’য় ফেরেননি। ১৮৬০-এ প্রকাশিত বই ‘রামারঞ্জিকা’ থেকেই ভাষা আর বিষয়বস্তুর বাঁকবদল শুরু, পরে পরে ‘যৎকিঞ্চিৎ’, ‘অভেদী’, ‘আধ্যাত্মিকা’র মতো বই পড়ে তাজ্জব বনে যেতে হয়, এরও লেখক প্যারীচাঁদ! ১৮৬০ সালে স্ত্রীর মৃত্যু তাঁর অন্তর্জীবনকে পাল্টে দিয়েছিল। ১৮৮১তে ইংরেজি বই ‘অন দ্য সোল: ইটস নেচার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’-এর ভূমিকায় নিজেই লিখেছেন, ‘In 1860, I lost my wife, which convulsed me much. I took to the study of spiritualism...’ ব্রাহ্মদের খুব কাছাকাছি থাকা প্যারীচাঁদ, ‘গীতাঙ্কুর’-এর মতো ব্রহ্মসঙ্গীত (বা ব্রহ্ম বিষয়ক সঙ্গীত) রচয়িতা প্যারীচাঁদের মন ক্রমে নিবিষ্ট হয় প্ল্যানচেটে, পরলোকচর্চায়। নিজেই লিখেছেন, তাঁকে ‘মিডিয়াম’ হিসেবে ব্যবহার করা হত। প্ল্যানচেটের জমায়েতের সঙ্গীরাও তালেবর— দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা দিগম্বর মিত্র, ‘ইন্ডিয়ান মিরর’-এর সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র প্রতিষ্ঠাতা শিশিরকুমার ঘোষ। আর এক জন যাঁর উপরে প্রেতাবেশ ভাল হত, তিনি নিত্যনিরঞ্জন ঘোষ। সম্পর্কে প্যারীচাঁদের ভাগ্নে, পরবর্তী কালে শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য স্বামী নিরঞ্জনানন্দ। বাড়িতে রোজ সকালে স্নান করে উঠে ঘরের বন্ধ দরজার
ও পাশে প্যারীচাঁদ নাকি মৃত স্ত্রীর সঙ্গে প্ল্যানচেটে কথা বলতেন! এক দিন দেরি দেখে পুত্রবধূ দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে শ্বশুরমশাইয়ের উল্টো দিকে চেয়ারে শাড়ি পরা এক অশরীরী নারীকে বসে থাকতে দেখেছিলেন, এমন ঘটনাও মেলে।
লাইব্রেরি থেকে স্ট্রবেরি
এই তো পাওয়া গিয়েছে উনিশ শতকের নবজাগরণপুঙ্গবের অন্ধকার দিক, ভাবলে বোকা বনতে হবে। প্যারীচাঁদ তুকতাক ঝাড়ফুঁক ভূতপ্রেতের গর্তে ঢুকে যাচ্ছেন না মোটেই, বরং এই সময়ে ক্রমশ বেড়ে চলেছে তাঁর কর্মব্যস্ততা। সেই কবে, হিন্দু কলেজে ছাত্র থাকাকালীনই নিজের বাড়িতে একটা অবৈতনিক স্কুল খুলেছিলেন তিনি। তাঁর ছোট ভাই, সে কালের আর এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কিশোরীচাঁদ মিত্রের লেখায় আছে, এই স্কুলে প্রায়ই ‘ভিজ়িট’-এ আসতেন ডিরোজ়িয়ো আর ডেভিড হেয়ার। ১৮৩৬-এ কলকাতায় খুলে গেল ‘দ্য ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি’। তার উপগ্রন্থাগারিক কে? না, বছর বাইশের ছেলে প্যারীচাঁদ মিত্র! তাঁর সুপারিশপত্রে সাহেব লিখেছিলেন, এই ছেলে ওর বয়সের আর দেশের অধিকাংশ তরুণের চেয়ে পড়াশোনায় এগিয়ে! এসপ্লানেড রো-র ঠিকানা থেকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ হয়ে মেটকাফ হলের দোতলায় লাইব্রেরি উঠে এল ১৮৪৪-এ। স্যর চার্লস মেটকাফের স্মৃতির স্মারক মেটকাফ হল তৈরি হয়েছিল সেই যুগে ১৬,৪০০ টাকায়, যে টাকার প্রধান ‘জোগাড়ে’ প্যারীচাঁদ মিত্র! বছর তিরিশের যুবক সম্পর্কে ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ লিখেছিল, ‘Pyari Chand toiled from morning to eve with laudable zeal and energy in getting subscriptions for the building...’ ১৮৪৮ সালে প্যারীচাঁদই হলেন পাবলিক লাইব্রেরির প্রধান গ্রন্থাগারিক, কিউরেটরও— মাইনে একশো টাকা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখছেন, ‘তিনি এত মিশুক ছিলেন ও তাঁহার পড়াশুনা এত বেশী ছিল যে, কি ইংরাজ, কি বাঙ্গালী, যাঁহার যখন কিছু জানিবার দরকার হইত, মেটকাফ হলে লাইব্রেরিতে গিয়া উপস্থিত হইতেন এবং তিনি তাঁহার সাধ্যমত তাঁহাদের উপকার করিতে চেষ্টা করিতেন। মেটকাফ হল তখন বড় রকম একটী পণ্ডিতের আড্ডা হইয়াছিল।’ ১৮৬৬ সালে বৈতনিক পদ ত্যাগ করার পরেও সুদক্ষ, বিদগ্ধ মানুষটিকে ছাড়েননি কর্তৃপক্ষ। প্যারীচাঁদ এর পরে ছিলেন অবৈতনিক সেক্রেটারি, লাইব্রেরিয়ান ও কিউরেটর, সব পদেই! কালক্রমে সেই লাইব্রেরি ‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি’, স্বাধীনতার পরে ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি’ হয়েছে। আজকের জাতীয় গ্রন্থাগারে পড়তে যাওয়া নবীন-প্রবীণ গবেষক-পাঠকেরা প্যারীচাঁদ মিত্রকে মনে রেখেছেন কি?
তার অনেক আগেই উইলিয়াম কেরির উদ্যোগে বাংলায় তৈরি হয়েছে এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটি। প্যারীচাঁদ শুধু তার সক্রিয় সদস্য ছিলেন বললে কম বলা হবে, সোসাইটি প্রকাশিত কয়েক খণ্ডের ‘এগ্রিকালচারাল মিসলেনি’তে কৃষি নিয়ে তিনি কত লেখা যে লিখেছেন আর তর্জমা করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। সিপাহি বিদ্রোহেরও আগে, ১৮৫৪-৫৫ সালে লিখেছেন ‘ফুলকপি জন্মাইবার প্রণালী’, পরে পরে ‘কলিকাতার বাগানে উত্তর হিন্দুস্থানীয় তর্মুজ ইত্যাদি চাষ করিবার ধারা’, ‘কানপুর অঞ্চলে স্ট্রবেরির চাষ করিবার ধারা’, ‘খেজুর গাছ রোপণ এবং তাহার রস হইতে ইউরোপীয় ধারানুসারে চিনি প্রস্তুতকরণ’ নিয়ে। যে লেখক ১৮৫৮য় বার করছেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’, তিনিই তার তিন বছর পর— যে বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মাচ্ছেন জোড়াসাঁকোয়— সোসাইটির পত্রিকার লেখা একত্র করে প্রকাশ করছেন বই ‘কৃষিপাঠ’। ভূমিকায় লিখছেন, এই বই জমিদার, কৃষক ও বিশেষত গ্রামীণ মানুষের জন্য। এক একটি লেখার শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট প্যারীচাঁদের উদ্দেশ্য: ‘সেগুন গাছ রোপণের প্রণালী’, ‘কুসুম ফুলের চাস এবং বাণিজ্যার্থ বড়ি প্রস্তুত করিবার প্রণালী’, ‘ইক্ষুর চাস’, ‘তুতগাছের ছাল হইতে রেসম ও কাগজ প্রস্তুতকরণ’, ‘তামাকু’, ‘তুলা, ‘খেজুরিয়া গুড়’। যে মানুষটা ইংরেজিতে ডেভিড হেয়ারের জীবনী লেখেন, তিনিই আবার ‘এগ্রিকালচার অব বেঙ্গল’ও লেখেন, ভাবলে তাজ্জব বনতে হয়।
উনিশ শতকের ‘সোশ্যালাইট’
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখছেন, ‘বাঙ্গালী সমাজের কোনও বিপদ সম্পদ্ উপস্থিত হইলে, একটা বড় রকম আন্দোলন উপস্থিত হইলে, প্যারীচাঁদ মিত্র মহাশয় তাহাতে একহাত আছেনই আছেন। কিন্তু কোথাও... প্রধান (অগ্রণী, নেতা) হইবার চেষ্টা করিতেন না। ইংরাজীতে তাঁহার কলম খুব চলিত। সভাসমিতির কাজকর্ম্ম ইংরাজীতেই হইত; সুতরাং প্যারীচাঁদ ভিন্ন চলিত না। তিনিও ইচ্ছা করিয়া ধরা দিতেন এবং খুব খাটিয়া কাজ উদ্ধার করিয়া দিতেন।’ উনিশ শতকের কলকাতায় এমন কোনও সক্রিয় সংস্থা ছিল না, প্যারীচাঁদ যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন না। সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা, বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (পরে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন), বেথুন সোসাইটি, দ্য ক্যালকাটা সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অব ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস (পশুক্লেশনিবারণী সভা), দ্য ডিস্ট্রিক্ট চ্যারিটেবল সোসাইটি, দ্য বেঙ্গল সোশ্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভা, স্কুল বুক সোসাইটি— সবেতেই তিনি আছেন। রাধাকান্ত দেব, প্রসন্নকুমার ঠাকুর বা গিরিশচন্দ্র ঘোষের নামে স্মারক সমিতি গড়া হলে, সেখানেও তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি। ১৮৭৫ সালে সাত সমুদ্দুর পাড়ে নিউইয়র্ক শহরে তৈরি হল ‘থিয়সফিক্যাল সোসাইটি’, দু’বছরের মাথায় তার করেসপন্ডিং ফেলো হিসেবে জ্বলজ্বল করছে প্যারীচাঁদের নাম। অচিরেই বোম্বাই শহরে ভারতবর্ষীয় শাখা প্রতিষ্ঠিত হল এই সোসাইটির, প্রকাশিত হল জার্নাল ‘থিয়সফিস্ট’। সেখানেও প্রথম সংখ্যাতেই প্যারীচাঁদের প্রবন্ধ ‘দি ইনার গড’। ‘সোশ্যালাইট’ শব্দটা নেহাতই অর্বাচীন কালের, তবু উনিশ শতকের কলকাতার সোশ্যালাইট-লিস্টি তৈরি করতে বসলে আর কেউ থাকুন না থাকুন, প্যারীচাঁদ মিত্র থাকবেনই। তিনি বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ সংক্রান্ত অ্যাক্টিভিজ়মেও আছেন (প্রথম বিধবাবিবাহের অনুষ্ঠানেও ছিলেন), মেটকাফ হলের ‘চেস ক্লাব’-এও আছেন। কত কাগজ, পত্রিকায় যে লিখেছেন! ‘ইন্ডিয়ান মিরর’, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’, ‘বেঙ্গল হরকরা’, ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’, ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড’, ‘ক্যালকাটা রিভিউ’, ‘ইংলিশম্যান’... নামগুলো শুনে বিস্ময় জাগে, এত পত্রপত্রিকাও ছিল তখন! বাংলার আইনসভার সদস্য হয়েছেন, কলকাতার অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, জাস্টিস অব দ্য পিস-ও। বাঙালি বাড়ির দরজায় বাবুর নামের পাশে তাঁর কাঁড়ি ডিগ্রি আর খেতাব খোদিত থাকার রেওয়াজ ছিল এই সে দিনও। প্যারীচাঁদের বাড়িতে ও জিনিস করতে গেলে আধখানা দেওয়াল ভরে যাওয়া বিচিত্র ছিল না! তাও তো ব্যবসায়ী প্যারীচাঁদ নিয়ে কিছু বলাই হল না। আমদানি-রফতানির কারবারে তিনি ছিলেন সে কালের দুই খ্যাত ব্যবসায়ী কালাচাঁদ শেঠ আর তারাচাঁদ চক্রবর্তীর পার্টনার। পরে দুই ছেলেকে পার্টনার করে শুরু করেন ‘প্যারীচাঁদ মিত্র অ্যান্ড সন্স’। বাংলা গদ্যের মোড় ফিরিয়ে দেওয়া লেখক গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল কোম্পানির ডিরেক্টর বোর্ডের সদস্যও ছিলেন!
কোন পথে যে চলি
রামমোহন রায় থেকে মহাত্মা গাঁধী— স্ববিরোধ ছাড়ে কাকে? ‘মাসিক পত্রিকা’য় প্যারীচাঁদ লেখেন, ‘শ্রাদ্ধে কোন ফল নাই’। শ্রাদ্ধ করলে যদি লোকে স্বর্গেই যেত, তা হলে বড়লোকেই শুধু স্বর্গে যাবে, গরিব মানুষ নয়। আর ধনী, ‘মদখোর’, ‘বেশ্যাবাজ’ (প্যারীচাঁদেরই ব্যবহৃত শব্দ) লোকেই যদি স্বর্গে যাবে, তবে স্বর্গ সুবিধের জায়গা নয় মোটেই। এই প্যারীচাঁদই কিন্তু পিতৃপুরুষদের বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতেন! উনিশ শতকের কলকাতায় বড় বড় সাহেবসুবোর সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা, কিন্তু সংস্কার যাবে কোথায়? ‘আত্মচরিত’-এ রাজনারায়ণ বসু লিখছেন, ১৮৭৫ সালে ছোটলাটের প্রমোদতরীতে আমন্ত্রিত হয়ে এসে প্যারীচাঁদ রাজনারায়ণকে ইংরেজের নৌকোয় প্রকাশ্যে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করতে নিষেধ করেছিলেন। রাজনারায়ণ লিখছেন, ‘প্যারীচাঁদ মিত্র অপ্রকাশ্যরূপে যবনস্পৃষ্ট দ্রব্য খাইতেন কিন্তু প্রকাশ্যরূপে খাইতে বিহিত বোধ করিতেন না।’ যিনি বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সমর্থক ও সহায়ক, ইংরেজিতে ‘ম্যারেজ অব হিন্দু উইডো’ নামে প্রবন্ধও লেখেন, তিনিই আবার ‘অভেদী’ বইয়ে তাঁর চরিত্রকে দিয়ে বলান, স্ত্রী পতিপরায়ণা হলে পতির মৃত্যুর পর তাঁর পক্ষে অন্য পতি গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এমনকি বিধবাবিবাহে অত পয়সা খরচ না করে বরং ‘ব্রহ্মচর্য্যা অনুষ্ঠানে উৎসাহ প্রদান’ করলে বেশি মঙ্গল।
হাতে রইল কী?
আসলে কথাটা তো এক খামচা এখান থেকে, এক আঁজলা ওখান থেকে তুলে দেখানোর নয়। একটা সমাজ— যে বুঝে গিয়েছে যে এত দিনকার ধাঁচা-খাঁচায় নিজেকে পুরে রাখলে আর চলবে না, সেই সমাজের প্রতিভূ মানুষগুলোর জীবনের আদি-মধ্য-অন্ত একঘেয়ে একমেটে হবে না মোটেই। দীনেশচন্দ্র সেন লিখছেন, ‘প্যারীচাঁদ মিত্র অর্থশালী হইয়াও যেরূপ ছিলেন, অর্থ-শূন্য অবস্থাতেও তদ্রূপ ছিলেন। তাঁহার নীতি ও চরিত্র সাংসারিক আলোক ও ছায়ার সহিত সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত থাকিয়া স্বীয় পুণ্য কর্তব্য পালনে পুষ্টিলাভ করিয়াছিল।’ ব্রাহ্ম প্যারীচাঁদ, প্ল্যানচেটপ্রিয় প্যারীচাঁদ, থিয়সফিস্ট প্যারীচাঁদকে দিয়ে কোনও এক ‘পুণ্য কর্তব্য’ লিখিয়ে নেয় আধ্যাত্মিক গান— ‘এ মন কল্যাণ হইবে কেমন। কেমনে করি আমি এই সাধন।/ কে দারা কে সুত মায়া অঞ্জন। সংসার অসার ভ্রম দরশন।... ললিত স্তবে গলিত হও মন। প্রেম উদয়ে সুখের আগমন।/ মূলতান অকপট আচরণ। গ্রাম সুর মান নাহি প্রয়োজন।’ ভাব-ঢুলুঢুলু প্রাচীনগন্ধী গান বলে উড়িয়ে দিতে পারেন, আবার চকিতে এও নজর করতে পারেন, গীতিকার একটা লাইন বাদে বাদে গোড়ার শব্দে রাগের নামগুলো দিয়েই কেমন pun করছেন! বা ফিরে পড়তে পারেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর শেষটুকুতে যুগপৎ অনুপ্রাস ও pun-এর ব্যবহার— ‘বরদাবাবু বরদাপ্রসাদাৎ বদরগঞ্জে বিষয় কর্মার্থ গমন করিলেন— বেচারামবাবু বিষয় বিভব বিক্রয় করিয়া প্রকৃত বেচারাম হইয়া বারাণসীতে বাস করিলেন— বেণীবাবু কিছু দিন বিনা শিক্ষায় সৌখিন হইয়া আইন ব্যবসাতে মনোযোগ করিলেন...’ তিনি এমন লেখক, যাঁর কলমে ‘ঠকচাচা’ প্রাণ পায়, আবার ‘অন্বেষণচন্দ্র’, ‘আধ্যাত্মিকা’র মতো চরিত্রও। আর এ যুগে, ই-যুগে তাঁর প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন? শুধু এটুকু পড়ুন: ‘একটা দামড়াপেটা আদমরা ঘেও গরু গাঁ গাঁ করিতে২ পলাই২ ডাক ছাড়িতেছে ও একজন তিলকধারী কৃষ্ণবর্ণ পুরুষ তাহার লেজ ধরিয়া টানিতে২ বলিতেছে, ওরে তুই গেলে আমি কাকে নিয়ে থাকব?... তোর জোরেতেই আমার পেট চলে, তুই তো আমার কামধেনু। অন্য একদিক্ থেকে শ্বেতবসনা ও শান্ত বদনা একটী কন্যা স্বর্গ থেকে এক২ বার নামিতেছেন ও বলিতেছেন— জ্ঞান! আমাকে সাহায্য কর, এখানে স্থির হইয়া থাকিতে পারি না। আমি যোড় হাত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম— পিতা এ সকল কি? জ্ঞান উত্তর করিলেন— যে গরুটা পলাই২ ডাক ছাড়্ছে, ইহার নাম জাতি, এ অনেক চোট খাইতেছে আর টিক্তে পারে না। তাহার লেজ ধরে যিনি টান্ছেন উহার নাম হিন্দুগিরি। জাতি গেলে তার গুমর যাইবে এ জন্য টানাটানি করিতেছেন। আর ঐ যে কন্যা এক২ বার নাম্ছেন ও উঠ্ছেন উহার নাম ধর্ম।...’ সোশ্যাল মিডিয়ামুগ্ধ এ যুগে থাকলে নন্দিত ও নিন্দিত, দুই-ই হতেন প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুর।