চরাচর: সালঁ দ্য বেঙ্গল প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
যে কোনও দলীয় প্রদর্শনীর (একক হলেও) ক্ষেত্রে প্রদর্শনী কক্ষে ডিসপ্লের ভূমিকা সেই প্রদর্শনীর মান কিছুটা হলেও নির্ণয় করে। ছবির উপর-নীচে ছবি, যত্রতত্র ভাস্কর্য বসিয়ে দেওয়া, ছবির প্রায় গায়ে-গায়েই ছবি, প্রায় সব কাজই দেখাতে হবে— এই বাহুল্যে প্রদর্শনী মার খায়। একে তো কোন কোন কাজ নির্বাচন করা উচিত সেই বোধের অভাব, আবার কেউ দু’টি-তিনটি, কারও আট-দশ-পনেরোটি কাজও প্রদর্শনীতে দেখা যায়। এ সব ক্ষেত্রে কাজের গুণমান যাচাই করবেন কে? ইচ্ছেমতো কাজ রেখে দিলেই কি মান বাড়ে? এই ভাবনাও কিছু প্রদর্শনীকে ব্যাহত করে। ভাল কিছু কাজের পাশে একটি-দু’টি অতীব খারাপ কাজ দৃষ্টিসুখের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আর বিশেষ দু’টি দিকের একটি হল, ‘আই লেভেল’ বলে যে বিষয়টি শিল্পকর্মের অবস্থান সম্পর্কে প্রয়োজনীয়, তা অনেকে হয় বোঝেন না, না হয় মাথায় রাখেন না। অন্যটি হল, প্রদর্শিত শিল্পবস্তুগুলির ক্ষেত্রে অনেক সময়ে দেখা যায়, ‘আন্ডারওয়ার্ক’, ‘ওভারওয়ার্ক’-এর সমস্যা। এ সমস্ত কিছুই ‘সালঁ দ্য বেঙ্গল’ নামক প্রদর্শনীটি দেখতে দেখতে চোখে পড়ল। কিছু ভাল কাজ এ ভাবেই মার খেয়েছে। তবু তরুণতর দশ জন স্বশিক্ষিত শিল্পীদলের একটি পরিকল্পিত নিষ্ঠাও কিন্তু স্বীকার করতেই হয়। প্রকৃত গাইডলাইনের অভাব থাকা সত্ত্বেও তাঁরা এই ত্রুটিগুলি তাঁদের চতুর্থ প্রদর্শনীতে শুধরে নেবেন, আশা করা যায়। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে প্রদর্শনীটি সম্প্রতি শেষ হল।
প্রায় ৯০টির মতো শিল্পকর্ম ছিল। তাঁদের ধারাবাহিক শিল্পশিক্ষার চর্চা অব্যাহত, চেষ্টা আছে। কিন্তু নিজের কাজ নিয়ে আরও গভীর পর্যবেক্ষণে যেতে হবে। আগ্রহ আছে, চেষ্টারও কসুর করেননি অনেকেই। কয়েক জনের ভাবনার সঙ্গে বোধ ও তার উপস্থাপনার দিকটিও প্রশংসা পাবে। তবে এ সব ক্ষেত্রে মূল রচনায় কতটা সংযম ও চাহিদাই বা কী কী, সে সব তো বুঝতে হবে।
সোমনাথ চোঙদার অ্যাক্রিলিক ও অয়েল প্যাস্টেলে ক্যানভাস ও কাগজে রঙিন ও সাদাকালো ল্যান্ডস্কেপ করেছেন। প্রত্যুষ, প্রদোষকালের সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, চন্দ্রালোকিত এ সব প্রাকৃতিক, প্রায় নির্জনতর দৃশ্যাবলি চোখের আরাম। জল, চাঁদ, সূর্যের প্রতিফলন, জমি, অন্তরীক্ষ, তার ব্যাপ্তি ও আপাত অন্ধকারাচ্ছন্ন নিসর্গ। ক্ষুদ্র একক দূরের মানুষ ও টকটকে লালের এক আলো-আঁধারি দৃশ্যে জলরঙের মতো অ্যাক্রিলিক ব্যবহারও মন্দ নয়।
রিকশা নিয়েই খুব দ্রুত টানটোন ও ব্রাশিংয়ে কিছু ড্রয়িং বেসড কাজ করেছেন স্নিগ্ধা দারি। ইঙ্ক, অ্যাক্রিলিক, মিশ্র মাধ্যমের এই কাজগুলি প্রশংসার দাবি রাখে। আয়রন ওয়্যারে করা চারটি বাতিল হওয়া রিকশার কাঠামোর ভাস্কর্যটিও বেশ। দেখতে হবে, অতি সরলীকরণ যেন সচিত্রকরণের মতো না হয়।
সর্বকনিষ্ঠ সৈকত দে পেপার পাল্প দিয়ে কিছু লোকশিল্প ও প্রত্নভাস্কর্যের আদিবাসী মুখোশের মতো ছোট মুখ গড়েছেন। পেঁচা, দেবীমূর্তি, মুখোশের আদলে মিশ্রিত রূপের বহিঃপ্রকাশ। সরু লম্বা গলা, বড় মুখ।
দীপঙ্কর রানার অ্যাক্রিলিকের মুখগুলিতে বেশি মাত্রায় নৈপুণ্য আনতে গিয়ে কোথাও কাঠিন্য এসে গিয়েছে। ফিনিশিং ভাল, তবে সংযমও দরকার। যেমন রূপবন্ধের ব্যবহার। তাঁর নিমকাঠে করা ভাস্কর্যগুলি প্রকৃত ভাস্কর্যের গুণাগুণ দাবি করে না। অতিরিক্ত ফিনিশিং, বার্নিশময় চমৎকারিত্ব বড্ড বেশি বাণিজ্যিক। পূজা দাসের দন্তবিকশিত, অতিরঞ্জিত এবং লাল-কালোর বাহুল্যে বিস্ফারিত চোখের কালীপ্রতিমা শুধু লাল রঙের জন্যই কোথাও মার খেয়ে যাচ্ছে। কালোর ব্যবহারও তথৈবচ। ঈশিতা মুখোপাধ্যায় এখনও নির্দিষ্ট স্টাইলটি ধরতে পারেননি। পেন্টিং ও সচিত্রকরণকে বুঝতে হবে। অনেকের কাজেই এ সমস্যা ধরা পড়েছে। ঠিক যেমন তিয়াসা পালের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে।
অনেকেই বুঝতে পারেননি কোথায় থামতে হয়। ওভারওয়ার্কে বেশ কিছু কাজ ভারসাম্য হারিয়েছে। কোথায় কোন রূপবন্ধ প্রয়োজন, স্পেসের ব্যবহার ও প্রয়োজনে তার ব্যাপ্তি অনেক কাজে মানাই হয়নি। কৌশিক ভৌমিক শিশুসুলভ ল্যান্ডস্কেপ করেছেন। বিজয় সিংহ, তাপসী বসু প্রমুখের কাজ দুর্বলতার সাক্ষ্য বহন করে। তাপসীর একাধিক আলঙ্কারিক গরুর মুখ বা সরাগুলি আহামরি নয়। সকলকেই প্রায় ছবির রচনা সম্পর্কে ভাবতে হবে। বিশেষত ফর্ম, কনটেন্ট, অ্যারেঞ্জমেন্ট, স্পেস, কালার এগুলো নিয়ে অবশ্যই আরও চর্চা দরকার।