প্রাতঃস্মরণীয়: সাত শিল্পীর সৃষ্টি নিয়ে দেবভাষায় আয়োজিত প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম —নিজস্ব চিত্র।
রামধনুর সাতটি রং যেমন নিজ নিজ মহিমায় তাৎপর্যপূর্ণ ও উৎকৃষ্ট, দেবভাষা প্রদর্শশালায় সম্প্রতি আয়োজিত ভারতের সাত জন বিশিষ্ট শিল্পীর ‘সেভেনথ সিম্ফনি’ প্রদর্শনীটিও একই ভাবে আকর্ষক। এই সাত জন শিল্পী হলেন— সোমনাথ হোড়, রেবা হোড়, যোগেন চৌধুরী, গণেশ হালুই, সনৎ কর, লালুপ্রসাদ সাউ ও রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্ষীয়ান এই শিল্পীদের প্রত্যেকেই বিশিষ্ট ও নিজস্ব শৈলী নির্মাণে ঋদ্ধ। ইতিমধ্যেই প্রত্যেকের কাজ বা শিল্পকলা নিয়ে বহু সাক্ষাৎকার, চলচ্চিত্র ও বই প্রকাশিত। এই সাত জন শিল্পীর মধ্যে রেবা হোড় ব্যতিরেকে বাকি প্রত্যেকেই কোনও না কোনও শিল্প শিক্ষায়তনে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, অবসর প্রাপ্তি পর্যন্ত। যেমন শান্তিনিকেতনের কলাভবন কিংবা কলকাতার সরকারি চারুকলা মহাবিদ্যালয় অথবা পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে এঁদের কর্মজীবন কেটেছে। এঁদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আজ তাই বহু শিল্পীই দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে আছেন।
প্রাতঃস্মরণীয়: সাত শিল্পীর সৃষ্টি নিয়ে দেবভাষায় আয়োজিত প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম।
এঁদের মধ্যে সোমনাথ হোড়, রেবা হোড় ও সনৎ কর আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু শিল্পীর পার্থিব মৃত্যু হলেও, তাঁদের শিল্পসম্ভারই কালের অমরত্বের আসনে নিজেদের আসীন রাখেন। সোমনাথ হোড় সেই সত্তরের দশক থেকেই কলাভবনের ছাপাই ছবি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত থেকেছেন। লিথোগ্রাফি, তক্ষণ ও নানাবিধ ছাপাই রীতির সাথে কলাভবনের দেওয়ালে কিছু ভিত্তিচিত্র তাঁর অবদান। রৈখিক বলিষ্ঠতা তাঁর কাজের স্বাক্ষর জোগায়। পরবর্তী সময়ে তিনি ব্রোঞ্জের ছোট আকারের মূর্তিকার হিসেবেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এই প্রদর্শনীতে তাঁর এচিং, লিথোগ্রাফ ও ড্রয়িংয়ের কাজই মূলত দেখা যায়। মানুষ অথবা পশু— সব বিষয়ের মধ্যেই প্রতিটি রেখা যেন জীবনের অসহনীয় যন্ত্রণা ও আর্তনাদের প্রকাশ ঘটায়৷ মানবদেহের গঠন ও আকৃতি যেন স্বল্প, সুনিশ্চিত কিছু রেখার মাধ্যমেই ফুটে ওঠে। পাশাপাশি, শিল্পী রেবা হোড় আজীবন লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে তাঁর শিল্পচর্চা অব্যাহত রেখেছেন। চিরকালের নিশ্চুপ এই শিল্পীর বলিষ্ঠ ড্রয়িংভিত্তিক কাজই এই প্রদর্শনীতে পরিবেশিত হয়েছে। রং-পেন্সিল, ক্রেয়ন, কন্টি, পেন অ্যান্ড ইঙ্ক দ্বারা কৃত কাজগুলির মধ্যে রেখার যে অসংখ্য বুনট নির্মিত হয়েছে, তা শিল্পীর দীর্ঘ শিল্পচর্চার পরিচয় ঘটায়। ছবিগুলির মধ্যে রেবা হোড়ের একান্ত এক আত্মদর্শী মনের আভাস জোগায়।
প্রাতঃস্মরণীয়: সাত শিল্পীর সৃষ্টি নিয়ে দেবভাষায় আয়োজিত প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম।
কলাভবনে শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলেন সনৎ কর, লালুপ্রসাদ সাউ ও পরে যোগেন চৌধুরী। অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত থেকেও এঁরা প্রত্যেকেই প্রতিনিয়ত শিল্পচর্চায় নিযুক্ত থেকেছেন। ফলত, তাঁদের কাজের মধ্যে এসেছে সময় ও বিষয়ের বিবর্তন এবং কখনও কখনও আঙ্গিকগত নতুন নতুন বিশ্লেষণ। সনৎ কর তাঁর ছাপাই ছবি ও ড্রয়িংয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের বিস্ফারিত ও বিস্ময় মাখা চোখের রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। কালো সাদা অথবা রঙিন কাজগুলির মাঝে এক বিদ্রুপাত্মক ইঙ্গিতও কখনও প্রতিফলিত হয়। তেমনই লালুপ্রসাদ সাউ তাঁর ছাপাই ছবির দিনগুলি থেকে কলাভবনে শিক্ষকতায় আসার পর টেম্পেরা ও কন্টি মাধ্যমে মানুষের অবয়বগত সরলীকরণ ও সুডৌল রেখাভিত্তিক কাজের মধ্য দিয়ে এক নতুন রসাস্বাদনে যুক্ত হন। কখনও তা কোনও নারীর পোর্ট্রেট বা কখনও ফুলদানিতে সাজানো ফুল। সব বিষয়ের মধ্যেই সরলীকরণের এক প্রতিফলন। পরবর্তী কালে যোগেন চৌধুরী শুধু মাত্র সাদা কাগজে তাঁর কালো তুলির টানে যে অলঙ্কৃত মূর্ছনা খুঁজে পেলেন, এই প্রদর্শনীতে সে রকম বেশ কিছু কাজ আমরা এই প্রদর্শনীতে দেখতে পাই। ক্ষুদ্রাকারে সৃষ্ট মানুষ ও গাছপালার কাল্পনিক ও বাস্তব রূপগুলি দর্শককে বিশেষ ভাবে আকর্ষিত করে। দৃশ্যকলায় রেখা ও রৈখিকতার যে অগণিত শৈল্পিক ভাষা, গঠন ও অভিব্যক্তি আছে, সেই প্রকরণগুলি এই সব বিশিষ্ট কাজের মধ্যে দর্শিত হয়।
প্রাতঃস্মরণীয়: সাত শিল্পীর সৃষ্টি নিয়ে দেবভাষায় আয়োজিত প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম।
কলকাতার সরকারি চারুকলা মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শিল্পী গণেশ হালুই। গোয়াশ এবং টেম্পেরা মাধ্যমেই তাঁর বেশি কাজ আমরা দেখে থাকি। তবে ভিত্তিচিত্রকার হিসেবেও তাঁর স্থান উল্লেখনীয়। নিসর্গের জাগতিক রূপকে বিমূর্ত ভাবে অলঙ্করণ ও উপস্থাপনই তাঁর ছবির বৈশিষ্ট্য। এই প্রদর্শনীর ছবিগুলিতে সেই রকমই নীল ও সবুজের ভাবময় মেলবন্ধনের যে বিন্যাস, তা দর্শককে আকর্ষিত করে অনায়াসে। অন্য দিকে, নন্দলালের সুযোগ্য শিষ্য শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈল্পিক স্বাক্ষর দেখা যায় তাঁর পেলব রেখার মধ্য দিয়ে। নারী ও পুরুষের অগণিত রূপ ও ভঙ্গিমায় সুসজ্জিত তাঁর চিত্রমালায় এক কমনীয়, মোলায়েম পরশ দর্শককে অভিভূত করে— কখনও তা মোটা চারকোলের আঁচড়ে তো কখনও বা সুনিশ্চিত কালো কালির রেখার টানে। সংক্ষিপ্তসারে রচনার এই শৈলী নেহাতই এই শিল্পীর স্বাক্ষরস্বরূপ বৈশিষ্ট্য।
শিল্পমাত্রেরই নিজস্ব ভাষা ও আঙ্গিক থাকে। এই প্রদর্শনীতে সাত জন প্রোথিতযশা শিল্পীর সেই ভাষার বৈচিত্র দর্শককে বিশেষ ভাবে আলোড়িত করে তাই।