রঙেরূপে: অ্যাকাডেমিতে ‘পেট্রিকোর’ নামক দলীয় প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সেন্ট্রাল গ্যালারিতে হয়ে গেল একটি দলীয় শিল্প প্রদর্শনী। নাম ‘পেট্রিকোর’। গ্রিকে এই শব্দের মানে সোঁদা মাটির গন্ধ। যে শিল্পীরা যোগদান করেছিলেন প্রদর্শনীতে, তাঁরা আগেও একসঙ্গে কাজ করেছেন, করোনাকালের আগে। কিন্তু অতিমারির পরে গৃহবন্দি অবস্থায় যেন তাঁরা সকলেই নিজেদের অন্তর্মহলে কাজ করছিলেন। খরাগ্রস্ত জমির মতো অপেক্ষায় ছিল যেন তাঁদের সৃষ্টি। এত দিন পরে একত্রিত হয়ে এই শিল্পীর দল অনুভব করেছেন বহুবাঞ্ছিত বৃষ্টির আগমন। খুব চেনা সেই সোঁদা মাটির গন্ধ তাই তাঁদের প্রদর্শনীতেও যেন ভরপুর। শিল্পীদের দেওয়া ‘পেট্রিকোর’ নামের সার্থকতা এখানেই।
জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, নীতা পোদ্দার, প্রভাত বাগদি, স্বাতী মুখোপাধ্যায়, আত্মদীপ ভট্টাচার্য, চিরঞ্জিৎ অধিকারী, লাল্টু বসু এবং চন্দন কর্মকার অংশগ্রহণ করেছিলেন এই গ্রুপ শোয়ে। এঁদের মধ্যে অনেকেই কলাভবন, রবীন্দ্রভারতী বা সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী।
কাজগুলির মধ্যে উল্লেখ করতেই হয় প্রভাত বাগদির ভাস্কর্য। ব্রোঞ্জের একটি কাজে একজন মানুষ জড়সড় হয়ে বসে আছে। কিছুটা যেন ভীত, সন্ত্রস্ত। সুন্দর ফুটিয়েছেন ভাবটি, কিন্তু এ কাজের কোনও শিরোনাম নেই। শিল্পীর আর একটি ভাস্কর্যের কথাও বলা প্রয়োজন। নাম ‘তিনমাথা’, মাধ্যম কাঠ। একজন মানুষ বসে আছে। তার হাঁটু দুটো মনে হচ্ছে যেন দুটো মাথা। তার সঙ্গে ব্যক্তির নিজের মাথাটা মিলিয়ে মোট তিনটি মাথার ইলিউশন সৃষ্টি করা হয়েছে এই কাজে। কাঠের এই কাজটিতে ওই মানুষের মুখের অভিব্যক্তিটি অসাধারণ।
স্বাতী মুখোপাধ্যায়ের ভাস্কর্যটি খুবই অন্য রকম। একটি পেঁচা উড়তে উদ্যত। তার মুখটি সতর্কতার প্রতীক। ওড়ার ভঙ্গিমাটিও অভিনব। শিল্পী এই কাজের নাম রেখেছেন ‘দ্য রাইট টার্ন’। ফাইবারের নজরকাড়া কাজ। তার উপরে সোনালি রং করা।
প্রদর্শনীর ছবিগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের করা ‘ধর্মরাজার ঘোড়া’ সিরিজ়টি। শিল্পী এই কাজগুলিতে যেন ঘোড়ার সঙ্গে খানিকটা নিজের জীবনকে মেলাতে চান। অথবা ঘোড়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে দেখাতে চান। কারণ ঘোড়া যে রকম ছুটতে চায়, আর রাশ টেনে রাখলে তার গতি ব্যাহত হয়, হয়তো শিল্পীর অবস্থা কোথাও গিয়ে খানিকটা সেই রকম। প্রথমত যে কাগজ উনি ব্যবহার করেছেন, সেটি শিল্পীর নিজেরই তৈরি করে নেওয়া। ফেলে দেওয়া, বিভিন্ন পরিত্যক্ত সামগ্রী থেকে বানানো ঠাসবুনটে তিনি তৈরি করেন এই কাগজ। এ ভাবেই নিজের তৈরি কাগজে বিভিন্ন টেক্সচার আনতে সক্ষম হন তিনি। ওই কাগজ বাজারে সহজলভ্য নয়। এখানে ঘোড়ার নানা রূপ দেখিয়েছেন শিল্পী। সুন্দর অ্যাক্রিলিক রংয়ের ব্যবহার দেখা যায় কাগজে। আঙ্গিকও খুবই উচ্চমানের। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, শিল্পী জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কোনও প্রথাগত শিল্পশিক্ষা নেই! এই শিল্পী ভবিষ্যতে আরও নানা প্রয়োগকৌশল ব্যবহার করে ভাল ছবি দর্শককে উপহার দেবেন, আশা করা যায়।
শিল্পী লাল্টু বসুর চারকোলের ছোট কাজ দেখা গেল প্রদর্শনীতে। কাগজের উপরে করা তাঁর কাজ নজর কাড়ে। ‘আনটোল্ড স্টোরি’ শিরোনামের কাজটিতে কত যে না বলা গল্প ধরা দিয়েছে। রয়েছে মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা শিকড়দের জটিলতার কথা। যেন ওরা ওদের গোপন রহস্যবার্তা জানাতে উদ্যত। সেটাই মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন শিল্পী।
নানা রকম কাজের সম্ভার দিয়ে প্রদর্শনীর ডালি সাজিয়েছিলেন এই তরুণ শিল্পীরা। সকলের মধ্যে তিন-চারজনের কাজ বিশেষ ভাবে চোখে পড়ে, যা প্রদর্শনীটির অন্যতম আকর্ষণও বটে।