মুকুন্দদাস। অঙ্কন: রৌদ্র মিত্র।
কথা শুরু
পার্বত্য চট্টগ্রাম। রাঙ্গামাটি। মায়ায় জড়ানো কর্ণফুলি নদী। নদীতে নৌকার আসা-যাওয়া। বাতাস উতলা হয় মাঝিমাল্লার ভাটিয়ালি সুরে। এখানেই যেন অন্য মায়াডোর তৈরি হল এক দিন। অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন লেখিকা সরলাবালা সরকার—
জনপদের কোনও বাড়িতেই সে দিন সান্ধ্য-উনুন জ্বলেনি। সকালেই দু’বেলার খাবার করে রাখা। সম্পন্ন গেরস্ত, মাঝি, পরিচারক থেকে কোলের শিশুকে নিয়ে মায়েরা, পুরুষেরা— দলে-দলে মানুষ চলেছেন তাঁকে দেখতে। অপেক্ষার পালা শেষ। বেজে উঠল বাদ্য। যাত্রা-মঞ্চে দাঁড়ালেন তিনি। দীর্ঘ, বলিষ্ঠ দেহে গৈরিক আলখাল্লা। গলায় মেডেলের মালা। উল্লসিত জনতা হর্ষধ্বনি দিয়ে ওঠে। অভিবাদন গ্রহণ করলেন তিনি। সবই স্তব্ধ ধীরে-ধীরে। তিনি জলদ-গর্জনের মতো গেয়ে উঠলেন, ‘আয়রে বাঙ্গালী, আয় সবে আয়/ আয় লেগে যাই দেশের কাজে...।’ ‘আয়’, এই আহ্বান যেন হুঙ্কার! সমবেত মহিলাদের দিকে তাকিয়ে জোড়হাতে বলে উঠলেন, ‘মা, তোমরা বীরধাত্রী, তোমাদের সন্তান কি ভীরু কাপুরুষ হবে?’— পালাগানের এমন উদাত্ত আহ্বানে জনপদটিকে ভাসিয়ে দিলেন মানুষটি। তিনি মুকুন্দদাস।
এই মুকুন্দদাসের দলেরই এক ১১-১২ বছরের কিশোর সরলাবালাদের বাড়িতে কড়া নাড়ল এক দিন। তার গানের গলাটি বড় মধুর। সরলাবালা তাকে ঠাকুরঘরে আসতে বললেন। কিশোর ঘরের ভিতরে উঁকি দিয়ে প্রশ্ন করে, ‘শেষে জলের কলসী মারা যাবে না তো?’ সে যে জাতে নমশূদ্র। তবে তারা জাত মানে না। কারণ ‘দাদাঠাকুরের’ (যা মুকুন্দদাসের ‘আদর্শ’ পালার একটি চরিত্রও) কথা, ‘আমরা সবাই একই জাত, আমরা মানুষ।’ কিশোরের ও-সব ‘পাকা’ কথায় কান না দিয়ে সরলাবালা বললেন, ‘...তুমি ঘরে উঠে এসে আমার ঠাকুরকে গান শোনাও দেখি।’ খান তিনেক গান সে শোনাল। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যেন বুঝতে পারি, জাতের নামে বজ্জাতির বিরুদ্ধে তার দল আর সম সময়ের বুকে একটি দ্রোহের বীজ বুনেছেন মুকুন্দদাস।
জাতের নামে বজ্জাতি
দ্রোহের নিশানটি উড়তে শুরু করেছে বর্তমানে মুন্সীগঞ্জের বানারী গ্রামের মাটি থেকে। এখানেই গুরুদয়াল দে ও শ্যামাসুন্দরীর প্রথম সন্তান যজ্ঞেশ্বরের (মুকুন্দদাসের পৈতৃক নাম) জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৮-এ। জন্মের পরে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে মা শ্যামাসুন্দরী স্বামীর কর্মস্থল বরিশালে চলে এলেন।
এই বরিশালের মাটির গন্ধই মুকুন্দের সর্বাঙ্গে। ধর্ম আর জাতের গন্ধ চিনতে শেখা, দ্রোহ ঘোষণা, এই মাটিতেই —
মুকুন্দদাসের তখন দেশ জোড়া নাম। ঠিক করলেন, নিজের বাড়ি তৈরি করবেন। বরিশাল শহরেরই পশ্চিমে কাশীপুর গ্রামে বেশ বড় একটা জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি হল। গ্রামে সম্ভ্রান্ত কায়স্থদের বাস। মুকুন্দদাস ভাবলেন, ওঁদের ‘সমাজভুক্ত’ হতে হবে। সে মতো আবেদন। কিন্তু দু’টি শর্তে মঞ্জুর হবে আবেদন। এক, সমাজের সবাইকে একটা ভোজ দিতে হবে। দুই, সমাজের মাথাদের সেলামি দিয়ে বাড়িতে এনে আপ্যায়ন করতে হবে। দ্বিতীয় শর্তটি মানতে নারাজ মুকুন্দদাস। ফলে, কাশীপুরের কায়স্থ সমাজের বাইরেই থাকলেন তিনি।
কিন্তু চারপাশের এমন সামাজিক পরিবেশকে জবাবও দিতে পারেন তিনি। এক জেঠিমার শ্রাদ্ধের খাওয়াদাওয়া। সেখানে মুচি, মেথর, ডোমের মতো তথাকথিত ‘অস্পৃশ্য’ জনতার ঢল নেমেছে। মুকুন্দ নিজে গিয়ে ওঁদের নিমন্ত্রণ করেছেন। হয়তো এখানেই ব্যক্তি মুকুন্দ আর মঞ্চের মুকুন্দ এক হয়ে বলে ওঠেন, ‘(এই) বাংলা যখন পরের হাতে/ কিসের মান আর কিসের জাত।’
জাতের সঙ্গে ধর্মের বিভেদটিও মুছতে চান মুকুন্দদাস। আর তাই তাঁর ঘরে মুসলিম ছাত্রদের নিত্য যাতায়াত। ইদের সম্মিলনীতে বক্তৃতাও করতে দেখা যায় মুকুন্দকে। এমন ‘সখ্যের’ জন্যই হয়তো বরিশালের শিক্ষা ও রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, কিন্তু কিঞ্চিৎ সাম্প্রদায়িক ভাবনাচিন্তার অধিকারী খান বাহাদুর হেমায়েতউদ্দিন আহম্মদ সভা শেষে জড়িয়ে ধরেন মুকুন্দদাসকে। আসলে মুকুন্দেরই যে বলা সাজে, ‘ত্যাগ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে/ লভিয়া নূতন প্রাণ,/ সমান সূত্রে হইবে মিলিত/ হিন্দু মুসলমান।’
কিন্তু এই মানুষটি সমাজের কঠিন নিয়ম টের পেলেন ছেলে কালীপদর বিয়ের সময়ে। কালীপদর সঙ্গে মেয়ে সুষমারাণীর বিয়ের সম্বন্ধ করেছেন সাব-রেজিস্ট্রার ক্ষিতীশচন্দ্র বসুরায়ের স্ত্রী। আর তা নিয়ে পাত্রীপক্ষে গন্ডগোল। আত্মীয়দের আপত্তি, শেষে কি না ‘ছোট শুদ্দুর’ মুকুন্দদাসের বাড়িতে মেয়ের বিয়ে হবে! মেয়ের মা মুকুন্দকে সমস্যার কথা জানালেন। অবশেষে বিয়েটা হল। মুকুন্দদাস আয়োজনে ত্রুটি রাখলেন না। কিন্তু কনেযাত্রীদের ঘাটে নেমেই গোঁ, ‘আমরা কোনও মৌলিক কায়েতের বাড়িতে হেঁটে যাই না। আমাদের প্রত্যেককে পাল্কি করে তুলে নিয়ে যেতে হবে।’ অথচ নদী ঘাট থেকে মুকুন্দদাসের বাড়ি মাত্র এক মিনিটের হাঁটা-পথ। ফাঁপরে পড়লেন মুকুন্দদাস। শেষে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা হল। কিন্তু ভোজের সময়ে আবার সমস্যা। জাতিগত কারণে কনেযাত্রীরা জানালেন, ভোজে যোগ দেওয়া যাবে না। ‘সিধা’ দিতে হবে। অবশেষে মুকুন্দের প্রস্তাব মতো ভোজে তাঁরা যোগ দিলেন বটে। কিন্তু বিদায়ের সময়, প্রত্যেক কনেযাত্রীকে আট থেকে ৬৪ টাকা প্রণামী দিতে হল মুকুন্দকে।
সেলামি দিয়ে যে মুকুন্দ জাতে উঠতে চাননি, সেই মুকুন্দই কেন ছেলের বিয়েতে প্রণামী দিলেন? এর সহজ উত্তর হতে পারে, পরিবারের প্রতি মুকুন্দের সম্পৃক্ত-বোধ। এই সম্পৃক্ত থাকার ছবিটি প্রকট হয় স্ত্রী, বিক্রমপুরের দিঘিরপাড় গ্রামের মেয়ে শতদলবাসিনীর সঙ্গে সম্পর্কে। দম্পতির দুই সন্তান, এক মেয়ে, সুলভা ও পূর্বে উল্লেখিত ছেলে কালীপদ। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা বোঝা যায় একটি বিষয় থেকে। রাজরোষে তিন বছর দিল্লির জেলে কাটানোর পরে মুক্ত হয়েছেন মুকুন্দদাস। কিন্তু কোথায় যাবেন অপরিচিত মহানগরে! দিল্লির কালীবাড়িতে প্রণাম করতে গেলেন। সেখানে এক সন্ন্যাসিনী দেখছেন মুকুন্দকে। আচমকা তিনি জানতে চাইলেন, ‘তুমি কি মুকুন্দদাস?’ পাল্টা মুকুন্দের প্রশ্ন, ‘আপনি কি বরিশালের সেই ভৈরবী মা?’ সন্ন্যাসিনী ইতিবাচক উত্তর দিতেই বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করলেন মুকুন্দ। জানতে পারলেন, যে স্ত্রীকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ফেলে এসেছিলেন, সেই শতদলবাসিনী আর নেই। যমুনার জলে ডুব দিয়ে কি স্ত্রীর স্মৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন মুকুন্দদাস? বোধহয় তা-ই। অবশিষ্ট জীবনে আবার বিয়ের কথা ভাবলেন না তিনি।
বস্তুত, মকুন্দদাসের পারিবারিক জীবনটি এমনই ছায়া দিয়ে ঘেরা। পরিবারটি শুরু থেকে নিম্নবিত্ত। বাবা গুরুদয়াল বরিশালে ডেপুটির আর্দালি। সংসারে দুটো পয়সা আসে যাতে, সে জন্য অবসরে মুদির দোকান চালান। আর ও-দিকে শিশু যজ্ঞেশ্বরের পড়াশোনা পাঠশালা এবং পরে বরিশালের অবিসংবাদী নেতা অশ্বিনীকুমার দত্তের ব্রজমোহন স্কুলে। কিন্তু অষ্টম শ্রেণিতে উঠে পড়াশোনায় ইতি। আসলে দ্রোহ যাঁর ভবিতব্য, তাঁর জন্য বোধহয় স্কুলের বাইরের পৃথিবীটাই বেশি কাছের। দল পাকিয়ে কখনও যাত্রাদলের শামিয়ানার দড়ি কেটে, গেরস্তের টিনের চালে ইট বর্ষণ বা ঝুলনে হল্লা করে বরিশালের বাসিন্দাদের তিতিবিরক্ত করে তুললেন যজ্ঞেশ্বর। ‘যজ্ঞা গুন্ডা’ আর তাঁর দলকে বাগে আনতে আসরে নামলেন খোদ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিটসানবেল। নানা ফন্দিফিকির করে গুন্ডার দলটি তিনি ভেঙে দিলেন। সে দলের সদস্যেরা কেউ হলেন পুলিশ, কেউ বা কেরানি। কিন্তু যজ্ঞেশ্বর ও-পথ মাড়ালেন না। তিনি আঁকড়ে ধরলেন পৈতৃক মুদি দোকানটিকেই। পরেও বারবার ছেলে ও ভাইয়ের জন্য মুদির দোকান করে দিয়েছেন যজ্ঞেশ্বর।
রাজদ্রোহে-অন্তরালে
বস্তুত, ওই পৈতৃক মুদির দোকানটিকে কেন্দ্র করেই প্রথম যৌবনে যজ্ঞেশ্বরের জীবনের মোড় ঘুরল। মায়ের দেওয়া কবচ বুকে ঝুলিয়ে আধ্যাত্মবোধ তত দিনে অনেকটাই যেন গড়ে উঠেছে। কিন্তু তা-ও যে প্রচলিত খাতে বয় না। এ দিকে, বরিশালকে হরিভক্তিতে মাতিয়ে দিলেন কীর্তনশিল্পী বীরেশ্বর গুপ্ত। সে দলেই ভিড়লেন যজ্ঞেশ্বর। মুদির দোকানকে কেন্দ্র করে বরিশালের আলেকান্দায় তৈরি হল যজ্ঞেশ্বরের কীর্তন দল। তিনিই প্রধান গায়ক, মৃদঙ্গ বাদক। দীক্ষিত হলেন বৈষ্ণব ধর্মে। গুরু, অবধূত রামানন্দ হরিবোলানন্দ। যজ্ঞেশ্বর পরিচিত হলেন মুকুন্দদাস হিসেবে। প্রকাশিত হল তাঁর সঙ্গীত সঙ্কলন ‘সাধনসঙ্গীত’।
কিন্তু বৈষ্ণব হয়েও শ্যামের সঙ্গে শ্যামার প্রতিও যেন অমোঘ টান। অন্তর্দ্বন্দ্ব ফুটে ওঠে আত্মজিজ্ঞাসায়, ‘(আমি) বুঝতে নারি শ্যাম কি শ্যামা’। বরিশালের থানামহল্লার কালীবাড়িতে যাতায়াত শুরু হল। প্রভাব ফেলল কালী-ভক্ত শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্য। পরে, বরিশালের শঙ্কর মঠের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের সহোদরা সরোজিনী দেবীর কাছে শাক্ত-দীক্ষা গ্রহণ। শাক্ত ধর্মে দীক্ষা যেন ধীরে ধীরে হয়ে উঠল স্বাধীনতার মাতৃমন্ত্র।
স্বাধীনতা নামের মহীরুহ আদর্শের বীজটি মুকুন্দদাসের মনে ছোটবেলাতেই বুনে দিয়েছেন অশ্বিনীকুমার দত্ত। অশ্বিনীকুমারের আহ্বান, ‘যজ্ঞা, তোর মধ্যে রয়েছে বিরাট সম্ভাবনা। তোকে দেশের এই জাতীয় সঙ্কটে নিতে হবে চারণের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।’
বরিশালের আকাশেও তখন ইংরেজ শাসননীতির বিষাক্ত নিঃশ্বাস। শাসকের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত, তা প্রতিহত করতে স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ার, বরিশাল যেন ফুটছে। এর মাঝে ১৯০৬-এ এই শহরেই কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন। সেখানে ‘বন্দেমাতরম’ উচ্চারণের জন্য নেমে এল ইংরেজের নির্মম লাঠি। ভেস্তে গেল সম্মেলন। এ সবের নেপথ্যে থাকলেন ছোটলাট ব্যামফিলড ফুলার। চুপ করে রইলেন না মুকুন্দদাসও। শাসকের বিরুদ্ধে দ্রোহ ঘোষণা করলেন। নিয়ে এলেন স্বদেশি যাত্রা ‘মাতৃপূজা’। এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সরকারি চাকরি ত্যাগ করে স্বদেশি হয়ে ওঠা, আখ্যানভাগ এটুকুই।
পালা তৈরি। কিন্তু অভিনয় কারা করবেন। কোনও রকমে কুড়ি জনের দল তৈরি হল। কিন্তু পোশাক? টাকা নেই যে। পুরনো কাপড়ই গেরুয়া, কমলা, লাল রঙে রাঙিয়ে নেওয়া হল। প্রথম অভিনয় বরিশালে, বাশরিপাড়ার নবগ্রামে, ভোলানাথ গুহঠাকুরতা নামে এক জনের পৃষ্ঠপোষকতায়। প্রথমে দর্শকের তেমন নজর পড়ল না এ পালায়। কিন্তু ক্রমে ইদিলপুরে পৌঁছতে শুরু হল পালাটির বঙ্গদেশ জয়।
‘পুণ্যে বিশাল’ ‘বরিশাল ভূমি’। এই ভূমির অন্যতম স্তম্ভ অশ্বিনীকুমারকে পালায় ম্যাজিস্ট্রেট ‘গুলি খোর’ বলে কটাক্ষ করছে। স্বদেশি প্রচারকের ভূমিকায় মুকুন্দদাস যেন তখন দেশের আমজনতার প্রতিনিধি হয়ে গেয়ে উঠছেন, ‘ঘোর কলিকাল বালাই লয়ে মরি তোর/ নইলে ঐ ব্যাটা কি বলতে পারে অশ্বিনীবাবু গুলিখোর?’ জনতার দরবারে মিশে যাচ্ছেন মুকুন্দদাস। পালা নিয়ে চললেন নোয়াখালি। সেখানেও কিছু দিনের মধ্যেই দেখা গেল, পথেঘাটে জনতার মুখে মুকুন্দদাসের গান— ‘বিদেশি (ফুলার) আর কি দেখাও ভয়?/ দেহ তোমার অধীন বটে!/ মন তো তোমার নয়।’ এই পালার গানগুলি নিয়ে বই বার হল। দেখা গেল, মুহূর্তে শেষ পাঁচ হাজার কপি। দাম, চার আনা।
কিন্তু এ সব ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডের ফলে ইংরেজের খাতায় ‘প্রচারক’ মুকুন্দদাস অত্যন্ত বিপজ্জনক এক ব্যক্তি হয়ে উঠলেন। সরকার-বিরোধী পালাগান বন্ধ করতে হবে। সরকার পর পর ১৪৪ ধারা প্রয়োগ করতে থাকল। কিন্তু ‘প্রমিনেন্ট অ্যাজিটেটর’ মুকুন্দদাসকে বাঁধা যে বড়ই কঠিন। এক থানা এলাকায় ইনজাংশন পেলেই মুকুন্দদাস পাড়ি দেন পরের থানা এলাকায়। জুটল ৩৭টি ইনজাংশন! এল জেলা ছাড়ার নির্দেশও।
বরিশালে ১৯০৮-এর জেলা সম্মেলনে গান ধরলেন মুকুন্দদাস, ‘মায়ের নাম নিয়ে ভাসান তরী—।’ ধীরে-ধীরে মুকুন্দদাসকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে জনশ্রুতি: মাদারিপুরে এক বার পালা চলাকালীন না কি তিনি পুলিশকর্মীদের দেখিয়ে দিলেন, মৃণ্ময়ী কালীমূর্তির হাতে থাকা খড়্গ সত্যিই দুলে উঠছে!
ছেলের কর্মকাণ্ডে গর্বিত বাবা গুরুদয়ালও চাকরি ছাড়লেন। কিন্তু শাসকের নাকের ডগার সামনে ক্রমাগত ছোটাছুটি, অশ্বিনীকুমারের সভাপতিত্বে থাকা স্বদেশবান্ধব সমিতি নিষিদ্ধ হওয়া, অশ্বিনীকুমারকে বিনা বিচারে নির্বাসন দেওয়ার মতো ঘটনাগুলি ঘটতে থাকল দ্রুত। মুকুন্দদাস দল ভেঙে দিতে বাধ্য হলেন। বেশি দিন নয়। তিনি যে দীক্ষিত স্বাধীন মাতৃমন্ত্রে। তাই চরম আঘাত আসতে পারে জেনেও ফের দল দাঁড় করালেন। মাতৃপূজা একই ভাবে জনতাকে উদ্বেল করতে থাকল। পালাটির জনপ্রিয়তা একটি ঘটনা থেকে বোঝা যায়—যশোহরের মাগুরায় এক জনের বাড়িতে পালা চলাকালীন পুলিশ তা বন্ধ করে দিল। জনতা প্রতিবাদে পুলিশ বয়কট শুরু করে। পুলিশকে দোকানদার জিনিস দেন না। এমনকি, পুলিশের বাড়িতে পুজো করতে যাওয়াও বন্ধ করলেন পুরোহিত।
শাসকও প্রহর গুনতে থাকে। ১৭ নভেম্বর, ১৯০৮। মেঘনার বুক চিরে মুকুন্দদাস চলেছেন উত্তর শাহবাজপুরে। পুলিশের লঞ্চ মুকুন্দদাসের নৌকা থামাল। শুরু হল তল্লাশি। পুলিশের হাত পড়ল ‘মাতৃপূজা গান’ ও ‘মাতৃপূজা’ পালার পাণ্ডুলিপিতে। গ্রেফতার হলেন মুকুন্দদাস। চারটি গানের উপর ভিত্তি করে মামলা শুরু। কিন্তু উকিল পান না মুকুন্দদাস। কারণ, রাজরোষে পড়ার ভয় আছে। হাতে শিকল পরা মুকুন্দদাস আদালত থেকে জেল হেফাজতে ফেরার সময়ে উকিল লাইব্রেরির সামনে একটু দাঁড়ালেন। তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করলেন উকিলদের। এতে কাজ হল। জন-মনে উকিলদের সম্পর্কে বিতৃষ্ণা জন্মাল। এই পরিস্থিতিতে এগিয়ে এলেন দুই বিশিষ্ট আইনজীবী শরৎচন্দ্র সেন ও নবীনচন্দ্র দাশগুপ্ত। সওয়াল-জবাব শেষে মুকুন্দদাসের তিনশো টাকা জরিমানা-সহ তিন বছর জেল হল। জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছর কারাবাসের নির্দেশ।
কালক্রমে জেল থেকে বেরোলেন মুকুন্দদাস। কিন্তু ব্রিটিশের ভাষায় ‘ডেসপারেট ক্যারেকটার’ মুকুন্দদাসের প্রতি রাজশক্তির কড়া নজর। তবে সে সব জেনেও মুকুন্দদাস ফের দল বাঁধলেন। পর পর মঞ্চস্থ করলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘বলিদান’ অবলম্বনে ‘সমাজ’, হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘দাদাঠাকুর’ অবলম্বনে ‘আদর্শ’। এ ছাড়াও রয়েছে ‘ব্রহ্মচারিণী’, ‘পল্লীসেবা’, ‘কর্মক্ষেত্র’, ‘পথ’। লিখেছেন গদ্যও।
একটা সময় পালাগানের বায়না থেকে মুকুন্দদাসের বছরে দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা মতো আয় হত। হাতে থাকত সাত-আট হাজার টাকা। কিন্তু তার পরেও মৃত্যুর সময়ে দেনা রেখে গেলেন মুকুন্দদাস। কী করে এমনটা হল? আত্মীয়স্বজন, বহু মানুষ নিয়ে সাজানো যে তাঁর সংসার। আর একটা বিষয় হল মুকুন্দদাসের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় মোটেও আস্থা নেই। দল নিয়ে বেরোতেন পাঁচশো টাকা সঙ্গে করে। ফিরতেন তিন-পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে। কিন্তু কাগজের টাকা পছন্দ নয়। কাগজের টাকা পেলে, তা দিয়ে সব রুপোর মুদ্রা করে নেওয়াটা তাঁর ধাত।
মহানগরে ‘ঝাঁকি’
কিন্তু রোজগারের উৎস কী? মুকুন্দদাসের অভিনয়-ক্ষেত্রের প্রধান কেন্দ্র অবশ্যই পূর্ববঙ্গ, বরিশাল। পরে গিয়েছেন ত্রিপুরা থেকে কোচবিহার। এক বন্ধুর পরামর্শ, ‘এ বার কলকাতা চলুন’। শুনেই মুকুন্দদাসের জবাব, ‘একটু সবুর করো, এদিক-ওদিক যামু, একটু ঢিব কইরা বরিশালের ধূলা মাথায় মাখুম, তারপর একদম শিয়ালদা স্টেশনে নাইম্যা কলিকাতাখান ধইরা একটা টান দিয়া ঝাঁকি দিমু, সে ঝাঁকিতে গোটা বাঙ্লাদেশ কাঁইপ্যা উঠবো...।’
সত্যিই কলকাতা কাঁপিয়েছেন মুকুন্দদাস। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অভিনয় দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সখ্য ধীরে-ধীরে নিবিড় হয়েছে। কখনও তাই হাজির হয়েছেন ‘বিচিত্রা’র বৈঠকে। ১৯২১-এর প্রাদেশিক কংগ্রেস অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথেরই গান গেয়েছেন মুকুন্দদাস, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে...’। কখনও আবার পৌষমেলায় শান্তিনিকেতনে পালা নিয়ে গিয়েছেন। মুকুন্দের যাত্রায় ‘খুব ভিড়’ হবে বলে মৈত্রেয়ী দেবীকে সাবধান করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাতে কী। দেখা হল যাত্রা। কিন্তু ভিড়ে একটি মুক্তোর দুল হারিয়ে ফেললেন মৈত্রেয়ীদেবী। একটি সূত্রের দাবি, রবীন্দ্রনাথের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর চরিত্রেও না কি অভিনয় করেন ‘প্রসিদ্ধ গায়ক নট মুকুন্দদাস’।
কলকাতা মহানগরেই মুকুন্দদাসের সঙ্গে দেখা হয়েছে আর এক চারণের— মুকুন্দদাস তাঁর দল নিয়ে তখন বর্তমান বিডন স্ট্রিটে। সেখানে হাজির সেই চারণ। হারমোনিয়াম বাজিয়ে পর পর কয়েকটি গান শোনালেন মুকুন্দদাসকে। নিজের দু’টি বই উপহার দিলেন মুকুন্দদাসকে। তাতে লেখা ‘চারণ-সম্রাট...’। বললেন, ‘যাঁরা গান বা বক্তৃতা দ্বারা দেশের জাগরণ আনতে চেষ্টা করেন তাঁরা সকলেই ‘চারণ’। আপনি, আমি, আমরা সবাই চারণ, তবে আপনি আমাদের সম্রাট, অর্থাৎ চারণ-সম্রাট’।’ মুকুন্দদাসের কাছে আসা চারণটি কাজী নজরুল ইসলাম। বই দু’টি ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘বিষের বাঁশী’।
তবে কলকাতার সঙ্গে মুকুন্দদাসের যোগাযোগের শুরুটা সম্ভবত ১৯১৬-য়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে। অশ্বিনীকুমারকে চিঠি লিখলেন চিত্তরঞ্জন। গুরু অশ্বিনীকুমারের নির্দেশেই মুকুন্দ হাজির হলেন চিত্তরঞ্জনের কাছে। গান শোনানো হল। সে যাত্রায় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে গান শোনাবেন মুকুন্দদাস। কিন্তু কলকাতার আধুনিকাদের চালচলন যেন পছন্দ হল না তাঁর। মা ও ভগিনী সম্বোধনে তিনি তাঁদের অল্পবিস্তর ব্যঙ্গও করলেন।
তবে জনপ্রিয়তায় খামতি হল না। কাঁকুড়গাছি, চুঁচুড়া, দমদম, চন্দননগর-সহ নানা জায়গা মুকুন্দদাস কার্যত জয় করতে থাকলেন। সে যাত্রা হকচকিয়ে দিয়েছে দর্শককে, জানাচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিভা বসু। আসলে মুকুন্দদাসের অভিনয়-শৈলীটিও যে ব্যতিক্রমী, সেখানে যেন যাত্রা-আঙ্গিকের বিরুদ্ধেই দ্রোহ তাঁর। রাজ্যেশ্বর মিত্র জানাচ্ছেন, মঞ্চে মুকুন্দের প্রবেশ নাটকীয় ও যাত্রার ঐতিহ্যের সঙ্গে খাপ খায়। কিন্তু সংলাপ বলতে গিয়ে নির্দিষ্ট অংশের বাইরেও নানা কিছু বলেন। এক-একটা সময় বক্তৃতা করেন নাগাড়ে। আর শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে থাকেন।
শুধু এক জন একটু অন্য রকম ভেবেছেন। এক বার মা-ছেলের কলকাতায় গঙ্গাস্নান করার ইচ্ছে হল। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। এই প্রথম বার ছেলে মুকুন্দদাসের অভিনয় দেখবেন মা শ্যামাসুন্দরী। মহিলাদের মধ্যে বসে রয়েছেন মা। তুমুল হাততালি চার দিকে। অনেক মহিলাই মুকুন্দের মায়ের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী। কিন্তু মুকুন্দের মা তেমন রা কাড়েন না। অবশেষে সমবেত মহিলাদের মুকুন্দের মা রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘দিদি! আপনারা সুখী হইতেছেন, কিন্তু, আমার প্রাণ অস্থির হইতেছে, আমার না দেখাই ভাল ছিল,— আহা! শরীর এমন বাটা বাটা করিয়া, বার বার ঘামে ভিজাইয়া, গায়ের রক্ত জল করিয়া পয়সা রোজগার করে। আমার সহ্য হয় না।’ অদূরেই হয়তো দাঁড়িয়ে মুকুন্দদাস। শুনে মায়ের পায়ে মাথা ঠেকালেন। দীর্ঘ চুলে বিলি কেটে দিতে থাকলেন মা।
আসলে বছর কয়েক ধরেই শরীরটা তেমন ভাল যাচ্ছিল না মুকুন্দদাসের। কিন্তু তাঁর উপরেই যে নির্ভরশীল নিজের, অন্য অনেকের সংসার। ফলে, পালা যে তাঁকে করতেই হবে। ১৯৩৪। ভাড়া নিলেন বাগবাজারে, ১৯ গোপাল নিয়োগী লেনের বাড়ি। কলকাতায় তখন কলেরার কালবেলা। ১৭ মে বেলেঘাটায় বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেন। পরের দিন হরিদাস মজুমদারের গীতা ভবনে যাত্রাগান গাওয়ার বায়না রয়েছে। রাত ১২টায় বাড়ি ফিরলেন। সেবক কালীচরণ নট্ট পা টিপে দিচ্ছেন মুকুন্দের। তাঁকেই বললেন, ‘শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। আমি ঘুমোবার চেষ্টা করি। আমি না ওঠা পর্যন্ত আমাকে ডাকিস না।’ এই বলে, চন্দনের জপমালা হাতে নিলেন। শুরু হল নামজপ। কালীচরণ ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন, ১৮ মে তারিখের ভোর। ভোর গড়িয়ে সকাল, কর্তা বিছানা ছাড়েন না। ও দিকে পালার জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাক চালক হাজির। তাঁর তাগাদাতেই কালীচরণ ডাকতে গেলেন। দেখলেন, পা ঠান্ডা। হাতের জপমালাটি তখনও রয়েছে।
আনন্দবাজার পত্রিকা লিখল, ‘মুকুন্দ দাসের মৃত্যুতে একজন খাঁটি স্বদেশ প্রেমিকের অভাব ঘটিল, এই অভাব অপূরণীয়। দেশবাসী তাঁহার অভাব মর্ম্মে মর্ম্মে অনুভব করিবেন।’— এই অভাব শিরদাঁড়া সোজা করে থাকা এক দ্রোহী মানুষের অভাব।
তথ্যঋণ: ‘শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘দেশ’, ‘চারণকবি মুকুন্দদাস’: জয়গুরু গোস্বামী (রবীন্দ্র লাইব্রেরি), ‘জাগরণের চারণ মুকুন্দদাস ও তাঁর রচনাসমগ্র’: পুলক চন্দ (দে’জ পাবলিশিং), ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশাল’: হীরালাল দাশগুপ্ত (সাহিত্য সংসদ), ‘দ্য স্বদেশি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’: সুমিত সরকার (পিপলস পাবলিশিং হাউস), ‘হিতেশরঞ্জন সান্যাল মেমোরিয়াল আর্কাইভ’।