নিসর্গদৃশ্য: সিমা গ্যালারিতে। শিল্পী পরেশ মাইতির চিত্রকর্ম।
শিল্পী পরেশ মাইতির প্রাথমিক পরিচয় ছিল তিনি জলরঙে অসামান্য শিল্পী। খুব বড় কাগজে তিনি আশ্চর্য দক্ষতায় আঁকতেন সেই সব নিসর্গদৃশ্য, যাতে কাগজের সাদাই ছিল তাঁর ছবিতে অনন্ত আলোর উৎস। এখন সিমা গ্যালারিতে তাঁর যে প্রদর্শনী চলছে,তাতে দু’টি ছাড়া আর সব কাজই তেলরঙে। সেই সঙ্গে ছবির বিষয়ও আর নিসর্গদৃশ্য নয়, বিমূর্ত ও অবিমূর্ত ছবিতে তিনি সমান দক্ষতায় কাজ করেছেন।সেই সঙ্গে পরিচয় দিয়েছেন, যা একবার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “জলরঙে দক্ষ হ’লে, তেলরঙে কাজ করার জন্যে আলাদা প্রশিক্ষণ লাগে না।”
প্রদর্শনীতে আছে অ্যাক্রিলিক ও তেলরঙে আঁকা ‘ইম্প্রেশন’ নামে তিরিশটি ছোট মাপের বিমূর্ত ছবি। এই কাজগুলিতে তিনি উজ্জ্বল বিপ্রতীপ রঙের পুরু প্রলেপে এঁকেছেন বিমূর্ত চিত্রকল্প। প্রতিটি স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে শিল্পীর স্বতঃস্ফূর্ত রঙের নির্বাচনে এবং চওড়া তুলিচালনার স্বাচ্ছন্দ্যে। পূর্ব-পরিকল্পনাহীন পটে ধরা দিয়েছে তাৎক্ষণিক অনুভবের আলোড়ন। তুলনায় সমান স্বাচ্ছন্দ্য ও সারল্যে এবং জটিলতায় সমৃদ্ধ তাঁর মূর্ত বা ছোট শহরের ত্রিকোণ ছাদের বাড়ির ঘনবসতির দৃশ্য, যেগুলি মনে করিয়ে দেয় তাঁর ‘বেনারস’ সিরিজ়ের ছবি, যেগুলি আমরা কয়েক বছর আগে সিমাতেই দেখেছিলাম।
আরও পাঁচটি ছোট পরিসরে পরেশ জলরঙে নগরদৃশ্য এঁকেছেন। সেগুলিতে আছে ত্রিকোণ ছাদ আর চতুষ্কোণ বা খাড়া আয়তাকার বাড়ির কম্পোজিশন। সেগুলির নান্দনিক অভিঘাত বিমূর্ত হলেও সেগুলিকে ন্যায্যত নগরদৃশ্যই বলা চলে। তবু যে ব্যতিক্রম নেই, তা নয়। যেমন, শিমলা ২০’, যাতে সমতল নীল, বিশুদ্ধ সাদা ও অন্ধকার বাদামি রঙের সমাবেশে বাড়ি আকাশ, নীল জল আর কয়েকটি নোঙর-করা নৌকো— সব মিলিয়ে একটি বিমূর্ত অভিব্যক্তি সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি বিমূর্ত অভিঘাত ‘ফার্স্ট লাইট’ নামের অ্যক্রিলিক ও তেলরঙে আঁকা বিশাল ক্যানভাসে। এক ঘনবসতির শহরে দিনের প্রথম আলো এসে পড়েছে পটের সামনের বাড়িগুলিতে আর তার পিছনের বাড়িগুলি অন্ধকারে ডুবে আছে। বারাণসী বা কাশী যে শিল্পীর প্রিয় বিষয় তার পরিচয় পাওয়া যাবে কয়েকটি ছোট ও মাঝারি মাপের ছবিতে। কাশীর গঙ্গা, তীরবর্তী বাড়িঘর, মন্দির, গঙ্গার তীরে নোঙর-করা নৌকো, বারাণসীর গঙ্গাতীরের বিখ্যাত ঘাট, এ সব দৃশ্য বারবার উঠে এসেছে বিশুদ্ধ জলরং বা অ্যাক্রিলিক ও তেলরঙের মিশ্রমাধ্যমে। অনেক সময়ে ছবির নামে কাশী বা বারাণসীর নামের উল্লেখ না থাকলেও ছবিতে ধরা দৃশ্য যে বারাণসীর, তা দর্শকের নজর এড়ায় না। যেমন, ‘গ্লোরি অব প্যারাডাইস’ বা ‘ডিভোশন’। এই সব ছবিতে পরেশের কৃতিত্ব ছবির কম্পোজিশনে বাস্তবদৃশ্যের অগোছালো চেহারা অক্ষুণ্ণ রেখেও পটের আয়তক্ষেত্রে একটা সুষ্ঠু সুসংগঠিত চিত্রকল্পসুলভ বিন্যাস আনতে পেরেছেন। যে জলরঙের জন্যে শিল্পী পরেশের খ্যাতি, সেই জলরংও দু’টি আছে প্রদর্শনীতে, একটি ‘স্টোপ’, অপরটি ‘ভেনেসিয়ান মেলোডি’। প্রথমটিতে একটি উত্তুঙ্গ পাহাড়ের সিলুয়েট, তার গায়ে দু’টি ফিতের মতো কুয়াশাস্রোত, পিছনে রক্তিমাভ আকাশ, চূড়ায় ধাপকাটা কাগজের সাদা, দূরে তুষারঢাকা পাহাড়চূড়া ও তার সানুদেশ। যে দক্ষতায় তিনি এক সময়ে বিশাল বিশাল জলরং করতেন, তারই নজরকাড়া নিদর্শন। কাশীর মতোই ভেনিসও পরেশের জলরঙের খুবই পরিচিত বিষয়। ‘ভেনেসিয়ান মেলোডি’ তারই অন্যতম দৃষ্টান্ত। ভেনিস থেকে ফিরে সেখানে-আঁকা যে সব অসাধারণ জলরং সিমাতে দেখিয়েছিলেন, এই ছবি তাদেরই একটি।
ছবি ছাড়াও প্রদর্শনীতে ছিল শিল্পীর ভাস্কর্য ও ড্রয়িং। ‘প্রাইমঅরডিয়াল’, ব্রোঞ্জের একটি সুউচ্চ আবক্ষ নারীমূর্তি প্রদর্শনীর বিশেষ আকর্ষণ। টোটেমের মতো আদিমতার ব্যঞ্জনায় আপ্লুত যা অভিঘাতে আরও অনিবার্য হয়েছে কাজটির আয়তনিক বিশালতা বা মনুমেন্টালিটির জন্যে। আছেব্রোঞ্জের দু’টি চতুষ্কোণ টাওয়ারের মাথায় বসানো কাটা গোলক। এই কাজের পূর্ণাঙ্গ মাপের সংস্করণ রেখেছেন তিনি গ্যালারির প্রবেশপথের প্রাঙ্গণে। কোথাও যেন ভাস্কর্যের সঙ্গে স্থাপত্যের মেলবন্ধন ঘটেছে কাজ দু’টিতে।
প্রদর্শনী কক্ষে ঢুকেই সামনের দেওয়াল জুড়ে আছে কাচের কালো পুঁতির তৈরি একটি বিশাল বৃত্তাকার কাজ, কালো বৃত্তের মাঝখানে লাল পুঁতির জিহ্বা। কাজটির নাম দিয়েছেন শিল্পী ‘মহাকালী’। কিন্তু ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক আবেদন থাকলেও তা ছাপিয়ে ওঠে লাল-কালোর বৈষম্যে কাজটির শৈল্পিক অভিঘাত। পরেশের ড্রয়িংয়ে আছে এক প্রচ্ছন্ন খেয়ালিপনা। তিনি যেন ড্রয়িং করতে বসে মুক্ত মনে,মুক্ত হাতে কাজ করেন। কিন্তু তাঁর রেখায় যতই মুক্ত, স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দ হোক অবয়ব, তাঁর রেখায় ধরা দেবেই। অধিকাংশ ড্রয়িং নামের কাজগুলি এই ধরনের। ব্যতিক্রম যেগুলিতে বিষয় বা দৃশ্য মনে রেখে কাজ করেছেন, যেমন, ‘রিফ্লেকশন’, ‘তালসারি’, ‘তমলুক’, ‘সাবিত্রী টেম্পল’, ‘পুষ্কর’, ‘মেক্সিকো’।
সেরামিকের চারটি কাজে পরেশের শিল্পী মেজাজের সেই দিকটাকে দেখি যাকে বলা যায় “লুজ় সালি অব মাইন্ড”। নারী ও পুরুষের মুখ এঁকেছেন পাত্রের ও মুখের মধ্যে মজার ভারসাম্য রেখে। খুব সরল অথচ প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র অভিব্যক্তি আছে, কোনও কার্টুনসুলভ বিকৃতি নেই। যদিও ‘সেরামিক xii’ ও ‘সেরামিক xiii’, দু’টিতেই একটু বিকৃতি আছে বলে মনে হয়, সেই বিকৃতি দু’টি মুখেই ব্যক্তিত্বের ব্যঞ্জনা এনেছে। ‘সেরামিক xiv’ ত্রিনয়নী দু’টি নারীমুখ। দু’টি মুখেই আছে এক মাধুর্যময় গাম্ভীর্য।
আরও বারোটি ছবিতে—যার অধিকাংশ জলরং বা অ্যাক্রিলিক ও তেলরঙের মিশ্রমাধ্যম—পরেশ এঁকেছেন একটি কি দু’টি,কখনও কখনও তিনটি নারীমুখের প্রোফাইল। এ সব ছবিতে তিনি নারী জীবন, নারী ব্যক্তিত্ব, নারী মাধুর্য এবং নারীসত্তার সব অগোচর রহস্যকে ছবির ভাষায় দৃশ্যময় করতে পেরেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই নারীমুখের পাশে কখনও কখনও পুরুষ মুখও থাকে। প্রত্যেকটি ফ্রেমে তিনি প্রধানত তাঁর নায়িকার চোখ গাঢ় ব্যঞ্জনার অঞ্জন দিয়ে এঁকেছেন। প্রতিটি পটেই এক অনুচ্চ অথচ দুরন্ত নাটক ঘটে। কখনও কোনও তৃতীয় চরিত্রের চোখও দু’টি চোখের মাঝে উঁকি দেয়, যেমন ‘অনলুকার’ নামের তিনটি ছবিতে, তখন ছবির নাটকীয়তা আরও তীব্র হয়।
এমনই আরও ছবি, ‘গসিপ’ নামের দু’টি ছবি, ‘অ্যাডমিরেশন’, ‘লাভার্স’, ‘নিউলি ম্যারেড’, ‘অ্যাপ্রিসিয়েশন’, ‘কাপল’, ‘নিউ ভিশন’। প্রত্যেকটি ছবি - কোনওটি জলরং, কোনওটি অ্যাক্রিলিক ও তেলরঙের মিশ্রমাধ্যম— জীবন-বাস্তবতার ছবি কিন্তু ছবির আঙ্গিকে ও রূপকল্পনায় এক স্নিগ্ধ কাব্যময়তা দৈনন্দিন বাস্তবতাকে এক চিরকালীন সত্যের আলোয় আলোকিত করে। তাতেই প্রদর্শনীর নাম, ‘ইনফাইনাইট লাইট’-এর সার্থকতা।
পরেশের ছবি জীবনসত্যের নিত্য অভিজ্ঞতাকে অনন্তের আলোয় আলোকিত করতে চায় ছবির দৃশ্যভাষায়। তার ফলে তাঁর ছবিতে, সে নারীপুরুষের প্রতিকৃতি হোক বা শহর বা নিসর্গের দৃশ্যই হোক— একটা বিমূর্ত ভাবনার অভিব্যক্তি থাকেই। একটি সাক্ষাৎকারে শিল্পীকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করায় তিনি বলেছিলেন, “আমি পৃ্থিবীটাকেই দেখি নিরাকার। তারপর আমার রূপ আসে। আমি ফিগারেটিভ ছবি শুরুই করি নিরাকার থেকে।”
এ বারের সিমার প্রদর্শনীতে তাঁর নিজের সম্বন্ধে এই উক্তি আরও বেশি প্রত্যক্ষ করা গেল।