ফৈয়াজ খান
হ্যারিসন রোডে সঙ্গীতগুণী শ্যামলাল ক্ষেত্রীর বাড়িতে সে দিন সন্ধ্যায় হঠাৎই হাজির হয়েছিলেন আগ্রেওয়ালি মালকাজান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এক ভদ্রলোক। মাথায় মখমলের লাল জরিদার টুপি, কিছুটা ডান দিকে হেলানো। পরনে ফিকে সবুজ রঙের পাতলা সার্জের লং কোট। সে সময়ে বেশ কিছু সঙ্গীতরসিক নিয়মিত ওই বাড়িতে গান শুনতে হাজির হতেন। নবাগত এই ভদ্রলোকটিকে দেখে উপস্থিত সকলেই অনুমান করেছিলেন, হয়তো দিল্লি কিংবা লখনউর কোনও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ িতনি। এ কথা-সে কথা, হাসিঠাট্টার পরে উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে কেউ একজন অনুমান করলেন এই নবাগত ভদ্রলোক নিশ্চয়ই একজন গায়ক। তাই হাসিমুখে একটা গান ধরতে অনুরোধ করলেন। কিছুক্ষণ পরেই অনুরোধ রাখতে সেই ভদ্রলোকও একটি গজল ধরলেন।
সে দিনের আসরে উপস্থিত অমিয়নাথ সান্যাল সেই গান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তখন মনে হল যেন সুরের আলো জ্বলে উঠেছে। ...ধৈবত আর কোমল নিষাদের চকিত নকশা সেরে নিয়ে ফিরে এসে সমাহিত হলেন পঞ্চমে... ফুলের এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে এসে ভ্রমর বসল ফুলের উপর... ভীমপলশ্রী রাগের যত মধু, সবই বুঝি উজাড় করে ঢেলে দিল ওই পঞ্চমের ধ্বনি...’ গান শেষ হতেই আসরে এলেন শ্যামলাল ক্ষেত্রী। সেই গায়ককে দেখে সানন্দে তিনি বলে উঠলেন, ‘‘আরে! এ যে ফৈয়াজ খান সাহেবকে দেখছি!’’ আর গায়কের পরিচয় জানার পরে উপস্থিত সকলেই একেবারে হতবাক! আসলে ফৈয়াজ খানের নাম শুনলেও, তাঁর গান শোনার সৌভাগ্য তখনও এ শহরের মানুষের বড় একটা হয়নি।
১০১ নম্বর হ্যারিসন রোডের সেই বাড়িটি ছিল সঙ্গীত জগতের এক তীর্থক্ষেত্র। আসতেন দেশের প্রখ্যাত উস্তাদ, বাঈজি আর সঙ্গীতগুণীরা। সে সময়ে শ্যামলাল ক্ষেত্রীর অতিথি হিসেবে কলকাতায় ছিলেন মউজুদ্দিন খান। তবে বড়বাজারে শেলী বাইজির বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকায় তিনি এই আসরে উপস্থিত ছিলেন না। তবু সেই সান্ধ্য আসরের স্মৃতি আজও উঁকি দেয় ইতিহাসের পাতা থেকে। আসলে মালকা চেয়েছিলেন শ্যামলাল ক্ষেত্রীকে ফৈয়াজ খান সাহেবের গান শোনাতে। তাই তিনি ফৈয়াজ খানকে সঙ্গে নিয়েই সেখানে হঠাৎ উপস্থিত হয়েছিলেন।
আসর জমাতে ফৈয়াজ ছিলেন অদ্বিতীয়। মেহফিলে প্রতিটি গানের মধ্যে তিনি রং তৈরি করতেন। আর সেই রং ছড়িয়ে পড়ত মেহফিল এবং শ্রোতার মনে। সে কারণেই তাঁকে বলা হত ‘মেহফিল কা বাদশা’। শুধু খেয়াল বা ধ্রুপদ নয়, তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল ঠুমরি, দাদরা এমনকী হোলির গানেও। তাঁর গানে সুর, লয় ছন্দের অদ্ভুত এক সমন্বয় ও সামঞ্জস্য ছিল, যা শ্রোতাদের সহজেই আকৃষ্ট করত।
ফৈয়াজ খানের জন্ম ১৮৮০-তে (মতান্তরে ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮১) আগ্রার কাছে শিকান্দ্রায়। পিতৃ-মাতৃকুল দু’দিকেই ছিল প্রবাদপ্রতিম সব শিল্পী। ফৈয়াজের জন্মের আগেই তাঁর বাবা সফদর হুসেন খানের মৃত্যু হয়। ফৈয়াজ ছিলেন গুলাম আব্বাস খানের দৌহিত্র। তাঁর কাছেই ফৈয়াজের শিক্ষা শুরু হয়। গুলাম আব্বাসের কাছেই তিনি ধ্রুপদের এবং কাল্লান খানের কাছে ধামারের তালিম পেয়েছিলেন। এ ছাড়াও ফিদা হুসেন খানের কাছে তাঁর পূর্বপুরুষ রমজান খান রঙ্গিলের কিছু বন্দিশ শিখেছিলেন। পরবর্তী কালে ফৈয়াজ তাঁর শ্বশুরমশাই মেহবুব খান (দরস পিয়া) এবং মহম্মদ আলি খানের কাছেও তালিম পেয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি মউজুদ্দিন খানের ঠুমরি গায়কির দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন।
শোনা যায়, ছেলেবেলা থেকেই ফৈয়াজ তাঁর মাতামহ গুলাম আব্বাসের সঙ্গে বিভিন্ন রাজ-দরবারে সঙ্গীতের আসরে যেতেন। এক সময়ে তিনি মহীশূর দরবারের গায়ক নাত্থান খানের সংস্পর্শে আসেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তাঁর গায়কি এতটাই পরিণত ছিল যে তিনি দিল্লি, কলকাতা, গ্বালিয়র, মুম্বই এমন নানা শহরে সঙ্গীত পরিবেশন করে সকলকে অবাক করেছিলেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে এক অনুষ্ঠানে মিঞাজান খানের গান শোনার সুযোগ হয় ফৈয়াজের। সেই অনুষ্ঠানে মিঞাজান খানের গানের পরেই ছিল ফৈয়াজের গান। ফৈয়াজ প্রথমে মিঞাজানের গায়কির নকল করে মুলতানি গেয়েছিলেন। তার পরে নিজস্ব ঘরানার সঙ্গীত পরিবেশন করায় মুগ্ধ মিঞাজান তাঁকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘‘তুমহি উস্তাদ হো।’’ ২৬ বছর বয়সে, ১৯০৮ সালে মহীশূর দরবারে এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় ফৈয়াজ খান ও হাফিজ খানের মধ্যে। সেই প্রতিযোগিতায় দু’জনেই এমন মন মাতানো সঙ্গীত পরিবেশন করেন যে, বিচারকদের পক্ষে কে জয়ী তা নির্ধারণ করাটাই মুশকিল হয়ে উঠেছিল। অবশেষে মহীশূরের রাজা নিজে ফৈয়াজ খানকে ‘আফতাব-এ-মৌসিকী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এর ঠিক পরেই লাহৌরের অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্স তাঁকে ‘সঙ্গীত চূড়ামণি’ উপাধি দিয়েছিল। ১৯১২ সালে বরোদার মহারাজ শিবাজি রাও গায়কোয়াড় তাঁকে সভাগায়ক নিযুক্ত করেন।
১৯২০ সালে বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে এবং বরোদার মহারাজার পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের প্রথম গ্র্যান্ড কনফারেন্সের তৃতীয় দিনের অধিবেশনে ফৈয়াজ খানের গান শুনে আল্লাবন্দে খান মুগ্ধ হয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ফৈয়াজ তো তাঁদেরই পরিবারের একজন।
কলকাতায় এলে ফৈয়াজ বেশির ভাগ সময় ইন্ডিয়ান মিরর স্ট্রিটে আগ্রেওয়ালি মালকাজানের বাড়িতে অতিথি হয়ে উঠতেন। শোনা যায়, আগ্রেওয়ালি মালকাজানকে ছাড়া বেশির ভাগ বাঈজিকে অপছন্দ করতেন ফৈয়াজ খান। তবে মালকার সঙ্গে বরাবরই তাঁর সুসম্পর্ক ছিল।
মাঝে মাঝে আবার অক্রুর দত্ত লেনে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির বাড়িতেও থাকতেন ফৈয়াজ খান। এই প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা রয়েছে। এমনই একদিন কুন্দনলাল সায়গল সেখানে এসে হাজির ফৈয়াজ খানের কাছে গাণ্ডা বাঁধার জন্য। দুই প্রবাদপ্রতিমকে একসঙ্গে পেয়ে সেখানে উপস্থিত মানুষের কৌতূহলের শেষ ছিল না। একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটতে চলেছে ভেবে রেকর্ড কোম্পানির কর্ণধার বিশেষ একটি ঘরে প্রবেশ করতে বারণ করে দিয়েছিলেন সকলকে। এরই মাঝে দুই শিল্পীর মধ্যে কথোপকথন জমে উঠেছিল। সায়গল সাহেব ফৈয়াজ খানকে বললেন, ‘‘উস্তাদ, কিতনা কামাল কা ভৈরবী হ্যায় আপকা, ‘বাবুল মোরা নৈহার’। মেহেরবানি কর আপ মুঝে ওহি শিখাইয়ে।” খান সাহেব বললেন, “আরে সায়গল, তুমনে যো ‘বাবুল মোরা নৈহার’ গায়া, ইসকে মুকাবিলে মে মৈঁ বিলকুল নাচীজ হুঁ।” এই ভাবে বেশ কিছুক্ষণ একে অপরের তারিফ চলতে লাগল। তার পরে হঠাৎ সেই ঘরের ভিতরে সব কিছু একেবারে নিঃস্তব্ধ। সঙ্গীতের কোনও রেশ মাত্র শোনা যাচ্ছে না। এমন সময়ে সাহস করে কয়েক জন সেই বন্ধ ঘরে ঢুকে পড়লেন... ঢোকা মাত্রই তাঁদের নাকে এল অন্য রসের গন্ধ। দেখা গেল উস্তাদ এবং তাঁর শিষ্য দু’জনেই সুরসাধনা ছেড়ে একেবারে অন্য রসে কাত!
তিনি যে শহরেই যেতেন না কেন, তাঁর গুণমুগ্ধ বহু মানুষ আসতেন দেখা করতে। জহরা মেহমুদের একটি লেখা থেকে জানা যায় এক ঘটনার কথা। এমনই একবার এক সন্ন্যাসী প্রায় পাঁচ মাইল পথ পায়ে হেঁটে এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। শীর্ণদেহী সেই সন্ন্যাসীর দৃষ্টিশক্তিও ছিল ক্ষীণ। সেই সময়ে একটি অনুষ্ঠান শেষে ফৈয়াজ তখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তাই সেই সন্ন্যাসীকে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। সেই সময়ে ঝরঝরে ইংরেজিতে তিনি বলেছিলেন যে, ফৈয়াজের গানের জন্য তিনি পাগল! তিনি নিজেও আগে গান করতেন। তবে ফৈয়াজের গান শুনে গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ফৈয়াজের গানই তাঁর জীবনযাত্রাকে বদলে দিয়েছে। ভিক্ষে করে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে তিনি একটি গ্রামোফোন ও ফৈয়াজ খানের গানের সব ক’টি রেকর্ড সংগ্রহ করেন! এতেই তিনি থেমে থাকেননি। বরোদায় গিয়েছিলেন খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে তাঁর দেখা না পেয়ে তাঁর একটি ছবি কিনেছিলেন। সেই সন্ন্যাসীর কথায় ফৈয়াজ সঙ্গীতের দেবতা। আর সেই সঙ্গীতই হল জীবনের চরম সত্য, যা এক কথায় অপার্থিব।
তেমনই একবার এক স্কুল শিক্ষক তাঁর গান শোনার জন্য স্কুলে ছুটির আবেদন করেছিলেন।
স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ছুটি দিতে সম্মত না হওয়ায় তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করার কথা জানান। এমনই গুণমুগ্ধ ছিলেন ফৈয়াজের শ্রোতারা।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর প্রসঙ্গে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ লিখেছিলেন, “ফৈয়াজ খান সাহেবের কণ্ঠের মধ্যে একটা উদাত্ত ওজস্বিতা ছিল। ...ফৈয়াজ খানের গান শুনে এক সময় ভারতের সমস্ত শ্রোতা অভিভূত হ’ত, সম্মানও সবাই করত ওঁর গান শুনে। আপামর জনসাধারণের, বুঝুন বা নাই বুঝুন, ওঁর গান ভাল লাগত। ...বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে, ফৈয়াজ খানের মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুগায়ক এবং শ্রোতাদের আকৃষ্ট করবার মতো বৈচিত্রভরা, ক্ষমতাসম্পন্ন গায়ক, তাঁর সময়ে কেন, তাঁর আগেও বোধহয় কেউ ছিলেন না, যাঁর জন্য উনি অত বিখ্যাত হয়ে আছেন।”
এক বার ফৈয়াজ খান কলেজ স্টিটের অ্যালবার্ট হলে (বর্তমানের কফি হাউস) গায়ে প্রবল জ্বর নিয়ে কেদারা গেয়েছিলেন। গান শুনে সেখানে উপস্থিত রাধিকামোহন মৈত্রের মনে হয়েছিল গানের শেষে আর কোনও ইমপ্রেশন ছিল না। ‘শুধু মনে হচ্ছিল, দরজা জানালা ছাদ ফুঁড়ে কেদারার মধ্যম বের হচ্ছে।’ তেমনই ফৈয়াজ খানের গান সম্পর্কে উস্তাদ হাফিজ আলি খান বলেছিলেন, ‘কী খেয়াল, কী ঠুমরি— এমন বোল বানানোর ক্ষমতা, হায় হায়, হিন্দুস্থানের কোনও গাওয়াইয়ার মধ্যে দেখিনি।’ ফৈয়াজ খানের গানকে আমির খান বলতেন ‘ম্যাজেস্টিক’।
ফৈয়াজ ছিলেন রাশভারী প্রকৃতির মানুষ। লোকমুখে শোনা কোনও কথা সচরাচর গায়ে মাখতেন না। অথচ তিনি ছিলেন অত্যন্ত ছাত্রবৎসল। একবার কিশোর শরাফৎ খানকে নিয়ে তিনি রামপুরের দরবারে গাইতে গিয়েছিলেন। সেই আসরে কখনও কখনও তিনি শরাফৎকে মাইকের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘পোলাও গোস্তের সঙ্গে আচার চাটনিও তো খেতে হয়। শুনুন এই বাচ্চার তান।’ ফৈয়াজ খান এমনই এক শিল্পী— যাঁর গান শ্রোতাদের কখনও কাঁদিয়েছে, কখনও বা অনাবিল আনন্দ দিয়েছে। তাঁর গান শুনে কখনও শ্রোতাদের মনে ‘প্রচুর ফুর্তি আর আহ্লাদ হত। কখনও তারসপ্তকে রামকেলি বা ভৈরবীর কোমল রেখাবের আঘাতে শ্রোতারা চোখের জল ধরে রাখতে পারত না।’ তাঁর গানে ধ্রুপদ এবং খেয়ালের সকল গুণাগুণ প্রতিধ্বনিত হত।
মহিষাদলের কুমার দেবপ্রসাদ গর্গের একটি প্রবন্ধ থেকে ফৈয়াজ খানের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে নানা কথা জানা যায়। তাঁর দিন শুরু হত ভোর চারটের নমাজের সঙ্গেই। বাড়িতেই তিনি নমাজ সেরে নিতেন। তার পরে কয়েক কোয়া রসুন খেতেন। খাটে শুয়ে উদারা সপ্তকে ‘সা’ সাধতেন। স্নানের আগেই মাথায় ও গোঁফে কলপ লাগাতেন। সকাল ছ’টার আগেই স্নান করতে যেতেন। সকাল সাড়ে ছ’টা-সাতটার মধ্যে স্নান সেরে আতর মেখে গান শেখাতে বসতেন। গান শেখানোর সময়ে উনি বাইরের কারও উপস্থিতি পছন্দ করতেন না। তেমন হলে গান শেখানো বন্ধ করে দিতেন। এক আচকান ছাড়া নিজের চোস্ত পাজামা, পাঞ্জাবি বা শার্ট নিজে কেটে সেলাই করতেন। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে চোখে চশমা দিয়ে তিনি নিজের হাতেই সেলাইয়ের কাজ করতেন।
তাঁর খাওয়াদাওয়াও ছিল অন্য ধাঁচের। সকালে কিছু খাওয়ার আগেই একটু হুইস্কি খেতেন! ডায়াবিটিস ছিল বলে খাওয়াদাওয়া নিয়ে নানা হাঙ্গামা ছিল। সকালের নাস্তা সারতেন নুন-সহ দু’টি রুটি দিয়ে। দুপুরে সিদ্ধ দু’টুকরো মাংস, পেঁয়াজ দিয়ে মটর সিদ্ধ আর রুটি। রাতেও চিকেন রোস্ট ও মটর সিদ্ধ। ভাত, বিরিয়ানি তিনি ছুঁতেন না। তবে ভালবাসতেন মাছভাজা।
সঙ্গীত শিক্ষার ব্যাপারে ফৈয়াজ খান প্রথাগত গুরুশিষ্য পরম্পরায় বিশ্বাসী ছিলেন। সঙ্গীত বিদ্যালয়ে বইপত্রের মাধ্যমে সঙ্গীত শিক্ষা তিনি পছন্দ করতেন না। ফৈয়াজ খানের ছাত্র দেবপ্রসাদ গর্গের স্মৃতিচারণে ফুটে উঠেছে শিক্ষক ফৈয়াজ খানের এক ভিন্ন চিত্র। গান শেখানোর সময়ে একটি গান তিনি বহু বার ছাত্রদের দিয়ে গাওয়াতেন। ‘‘প্রতিটি রাগের অন্তত একটি করে ধ্রুপদ ও ধামার শেখার উপরে বিশেষ জোর দিতেন। ...ফৈয়াজ খান সাহেবের কাছে ছোট খেয়াল শেখার সময় উনি ছোট ছোট করে গানের কথা কেটে কেটে ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে দিতেন। ...ফৈয়াজ খান সাহেব নিজে গেয়ে সঙ্গে আমাকে গাইয়ে অনেক হরকত শেখাতেন। দরকার মতো চড়ার দিকে ‘ফুট’ বা গলা ভেঙে নেওয়ার রেওয়াজ কত রকমের পুকার ও নানা অলঙ্কারের পৃথক পৃথক রূপ জানিয়ে দিয়ে সেগুলি গলায় তুলিয়ে দিতেন।’’
ফৈয়াজ খান সাহেব বলতেন, ঠুমরি কেউ কাউকে শেখাতে পারে না, ঠুমরি শুনে শুনে উপলব্ধি করার জিনিস। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে বিলায়েৎ হুসেন খান, আতা হুসেন খান, খাদিম হুসেন খান, লতাফৎ হুসেন খান, শরাফত হুসেন খান, এস রতনঝংকার, দিলীপচন্দ্র বেদী উল্লেখযোগ্য।
জীবনের প্রথম দিকে নিজের গান রেকর্ড করতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না ফৈয়াজ খান। পরবর্তী সময়ে এ দেশে রেকর্ডিং ব্যবস্থা উন্নত হলে তাঁর বেশ কিছু গান হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি ও পরবর্তী কালে গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ড করে। শোনা যায়, তাঁর কণ্ঠ এমনই জোরালো ছিল যে, মাইক্রোফোন থেকে তাঁকে দু’-আড়াই হাত দূরে বসানো হত। তা না হলে তাঁর সঠিক কণ্ঠস্বর রেকর্ডে ধরা পড়ত না। তাঁর প্রথম দিকের গানের রেকর্ডগুলি তিন মিনিটের। তাঁর মধ্যে অন্যতম ‘দরবারি’, ‘ছায়ানট’, ‘পূরবী’, ‘জয়জয়ন্তী’, ‘তোড়ী’, ‘রামকলি’ উল্লেখযোগ্য। তাঁর শেষ জীবনে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর উদ্যোগে বেশ কিছু গান রেকর্ড করা সম্ভব হয়েছিল।
ফৈয়াজ খান ১৯৩৪ সালে প্রথম অল বেঙ্গল মিউজ়িক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন। আর শেষ বার ১৯৪৯ সালে। সে বার শ্রী সিনেমা হলে কনফারেন্স হয়েছিল। সেই স্মৃতি আজও অমলিন প্রবীণ জয়ন্তনাথ ঘোষের। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলছিলেন, ‘‘সে বার কনফারেন্সে তিনটি অধিবেশনে ফৈয়াজ গান গেয়েছিলেন। প্রতি বার কলকাতায় এলে আমাদের বাড়িতে আসতেন আমার বাবা ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ঘোষ এবং দাদা মন্মথনাথ ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে। শেষ বার তিনি আর বাড়ির দোতলায় ওঠেননি। নীচে গেটের কাছে চেয়ারে বসে কথা বলছিলেন। মনে পড়ছে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘গুলাম আলি সাহেব কেয়া আ গ্যয়া?’ শুনেছি, বাবার আমলে এক বার আমাদের বাড়িতে দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে আপন মনে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে তাস খেলছিলেন খানসাহেব। সেটা শুনতে পেয়ে বাবা হঠাৎ চুপচাপ ঘরে এসে পিছনে চেয়ারে বসে গান শুনছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে ফৈয়াজ খান যখন বুঝতে পারলেন, তিনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিলেন, ‘আরে বাবুজি আপ পিছে ব্যয়ঠকে কিঁউ শুন রহে হ্যায়?’ এর উত্তরে বাবা বলেছিলেন, ‘খান সাহেব, আপনার গান তো সবাই সামনে বসে শোনে, তাই পিছনে বসে শুনছিলাম কেমন লাগে’!’’
জীবনের শেষ দিকে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ফৈয়াজ। ওই রোগটিতে তাঁর ভীষণ ভয় ছিল। কেননা তিনি মনে করতেন, সকলে তাঁকে ছেড়ে চলে যাবেন। এক দিন গান শেখাতে গিয়ে তাঁর রক্তবমি হয়। ১৯৫০ সালে অবস্থার আরও অবনতি হয়। ৩০ অক্টোবর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। আর ৫ নভেম্বর বরোদায় তাঁর জীবনাবসান হয়। সেই সঙ্গে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র স্মৃতির অতলে বিলীন হয়েছিল।
ঋণ: গ্রেট মাস্টার্স অব হিন্দুস্থানি মিউজিক: সুশীলা মিশ্র। কুদ্রত্ রঙ্গিবিরঙ্গী: কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আনন্দ। স্মৃতির অতলে: অমিয়নাথ সান্যাল। ‘তহজীব-এ-মৌসিকী’ জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। সঙ্গীত সঙ্গ ও প্রসঙ্গ: কুমার দেবপ্রসাদ গর্গ: ‘দেশ’ বিনোদন ১৯৮১। জিনিয়াস অব ফৈয়াজ খান: মন্মথনাথ ঘোষ। অল বেঙ্গল মিউজ়িক কনফারেন্স: সুভেনির ১৯৫৩