শিল্পী সমরেন্দ্রনাথ ঘোষের মডেল অবন ঠাকুর ফাইল ছবি।
গত শতাব্দীর এক শিল্পী, যাঁর জন্ম ১৯১২ সালে এবং মৃত্যু ১৯৯৫ সালে। তাঁর সঙ্গে পাঠক ও দর্শকের পরিচয় হয়তো সামান্যই। সেই শিল্পী সমরেন্দ্রনাথ ঘোষের বেশ কিছু ছবি নিয়ে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন দুই শিল্পী— মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় এবং অরূপরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। সমরেন্দ্রনাথ ঘোষের পুত্রবধূ মঞ্জুশ্রী ঘোষের যত্ন করে রেখে দেওয়া নানা ছবি দিয়ে এই প্রদর্শনীটি সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন এই দুই শিল্পী।
১৯৪০ সালে সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ মুকুল দে-র কথায়, সমরেন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ ছাত্র। বলেছিলেন, সমর যেখানেই শেখান না কেন, সেই প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হবেন তিনি। পরবর্তী কালে মুকুলবাবুর রেখে যাওয়া কাগজপত্রের মধ্যে সমরেন্দ্রনাথের বিভিন্ন মাধ্যমের (যেমন, জলরং, ওয়াশ, টেম্পারা, ড্রাই প্যাস্টেল, তেলরং, এন্টালিয়ো) অরিজিনাল গ্রাফিক প্রিন্ট পাওয়া যায়। এ ছাড়াও দেওয়াল চিত্র, উড এনগ্রেভিং, এচিং, লিথোগ্রাফি, মডেলিং... এই সব জায়গাতেই ছিল সমরেন্দ্রনাথের স্বচ্ছন্দ বিচরণ।
উদাহরণস্বরূপ শিল্পীর ‘ষষ্ঠীপূজা’ নামে ছবিটির উল্লেখ করা যায়। ছবিটি চার ফুট বাই আড়াই ফুটের জমিতে যেমন টেম্পারা পদ্ধতিতে এঁকেছিলেন, আবার ঠিক তেমনই গ্রাফিক্সের মাধ্যমে সেই একই ছবি আঁকেন। এই ছবির জমিতে প্রায় ৯-১০টি নারীমূর্তি ও একজন বালক-সহ বিড়ালের উপস্থিতি গ্রামীণ বাংলার এক অপূর্ব লৌকিক পুজোর দৃশ্যকে ফুটিয়ে তুলেছিল। ছাপাই ছবিটির প্রথম অবস্থায় বিড়াল অনুপস্থিত ছিল। পরে বিড়ালটি যোগ করা হয়েছে, ষষ্ঠীদেবীর বাহন বলে। ফলে পুজোর সময়ে এই প্রাণীটির উপস্থিতি দর্শকের মনে একটি ইলিউশন সৃষ্টি করে। ছবিটির ধীরে ধীরে গড়ে ওঠার ধাপগুলি চোখের সামনে ধরে রেখেছিলেন তাঁর মাস্টারমশাই মুকুল দে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, উপরের ছবিটি এই প্রদর্শনীতে দেখা গেল না।
ছাপাই ছবির প্রসঙ্গে শিল্পী সমরেন্দ্রের আঁকা আর একটি ছবির কথা তাঁর পরিবারের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। এটিতে আছে, একটি মাটির কুটিরে বসে কোনও এক মা তার সন্তানকে স্তন্যপান করাচ্ছে। মায়ের দারিদ্রক্লিষ্ট শরীর, বুকের দুধ শুকিয়ে এসেছে, তবু যতটুকু আছে, তা তিনি শিশুর মুখে তুলে দিচ্ছেন। দুঃখের বিষয়, এই ছবিটিও প্রদর্শনীতে দেখা গেল না।
প্রদর্শনীতে এসে প্রবীণ শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, দুর্গাপ্রতিমার পিছনে যে চালচিত্র থাকে, তাতে মায়ের পট চিত্রিত দেখি। প্রাচীন গুহাচিত্র থেকে সে সময়ের বার্তা পেয়ে থাকি। সেই ধারাবাহিকতা আজও বহমান। শিল্পী সমরেন্দ্রনাথের সৃষ্টিমালার ভিতর দিয়ে হাঁটলে সেই সত্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর সেটিই তাঁর চিত্রের আদি বোধ।
এক সময়ে তাঁকে কিংবদন্তি শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতি পশ্চিমি স্টাইলে আঁকতে বলেছিলেন সমরেন্দ্রনাথের গুরু। সংরক্ষিত সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, অবন ঠাকুর মডেল হিসেবে বসে, ক্যানভাসে আঁচড় টানছেন শিল্পী সমরেন্দ্রনাথ। এই ছবি সব শিল্পরসিকের কাছেই অতি আদৃত এক সম্পদ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নালক এবং ক্ষীরের পুতুলের আসল ড্রয়িং সমরেন্দ্রনাথই করেছিলেন।
এই প্রদর্শনীতে সমরেন্দ্রনাথের আঁকা কৃষ্ণের জন্ম থেকে শুরু করে ছোটবেলার পাঁচ-ছ’টি ছবি দেখা গেল। তার মধ্যে একটিতে আছে, বাসুদেবের হাতে দেবকী ছোট্ট কৃষ্ণকে লুকিয়ে তুলে দিচ্ছেন, তাকে সরিয়ে ফেলার জন্য। হৃদয়বিদারক এক দৃশ্য। আসন্ন বিপদ থেকে সন্তানকে রক্ষা করার জন্য পিতা-মাতার আপ্রাণ চেষ্টা।
আর একটি ছবিতে বাসুদেব শিশু কৃষ্ণকে বুকে জড়িয়ে ধরে যমুনা পার হওয়ার চেষ্টা করছেন দুর্যোগের রাতে। ঝড় এবং বৃষ্টিতে নদী-আকাশ-ডাঙা সব মিলেমিশে একাকার। ঝড়েররং এবং মেজাজটা সুন্দর ভাবে ধরেছেন শিল্পী।
কৃষ্ণ সিরিজ়ের আর একটি ছবিতে বৃন্দাবনে গরু চরাচ্ছে কিশোর কৃষ্ণ। তার মোহন বাঁশির সুরে সম্মোহিত করে গরুর পাল-কে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। ভারী সুন্দর এই ছবিটিতে যেমন উজ্জ্বল রং ব্যবহার করেছেন, তার সঙ্গে সঙ্গে অসামান্য ড্রয়িং। প্রায়-বিস্মৃত শিল্পী সমরেন্দ্রনাথের ড্রয়িং এবং জলরঙের হাত কত ভাল ছিল, শুধু এই ছবিটিই তার প্রমাণহতে পারে।
শিল্পী সমরেন্দ্রনাথ ঘোষের বেশ কিছু ছবি সকলের সামনে নিয়ে আসার জন্য তাঁর পুত্রবধূ মঞ্জুশ্রী ঘোষ এবং পৌত্র অভীক ঘোষের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন দর্শক, শিল্পবোদ্ধারা।
শমিতা বসু