নান্দীকার নাট্যমেলা

নিখুঁত ও নির্ভেজাল সব প্রযোজনা

নান্দীকার নাট্যমেলার নাটকগুলি দেখলেন মনসিজ মজুমদারনান্দীকারের বত্রিশতম জাতীয় নাট্যমেলায় শুরুতেই ছিল ব্রেখটের ‘ভালোমানুষ’। এটি সম্পূর্ণ নতুন প্রযোজনা (পরিঃ সোহিনী সেনগুপ্ত)। ‘ভালমানুষের পালা’র স্মৃতি নিয়ে এ নাটক দেখলে জলরঙের হালকা ওয়াশের মতো লাগতে পারে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৬ ০০:০০
Share:

নান্দীকারের বত্রিশতম জাতীয় নাট্যমেলায় শুরুতেই ছিল ব্রেখটের ‘ভালোমানুষ’। এটি সম্পূর্ণ নতুন প্রযোজনা (পরিঃ সোহিনী সেনগুপ্ত)। ‘ভালমানুষের পালা’র স্মৃতি নিয়ে এ নাটক দেখলে জলরঙের হালকা ওয়াশের মতো লাগতে পারে। কুশীলবেরা সকলেই সংশোধনাগারের বাসিন্দা, মঞ্চের অভিজ্ঞতায় অনেকেই নবীন, তাই আগের প্রযোজনার তীব্র শ্লেষের নাটকীয় অভিঘাত প্রত্যাশা করা যায় না। তবু পরিচালনার গুণে মঞ্চায়নের কোনও দুর্বলতা নেই। অভিনয়ে অনেকেই শক্তির পরিচয় দিয়েছেন, বিশেষ করে ভালোমানুষ জানকীর চরিত্রের দ্বৈত ভূমিকায়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার সঙ্গীতাংশ, বিশেষ করে গানগুলির পরিবেশনা।

Advertisement

নাট্যচর্চার সুষ্ঠু ভবিষ্যৎ গড়ে তোলায় দায়বদ্ধ নান্দীকার চিল্ড্রেন অনসম্বল-এর শিশু, কিশোর ও সদ্য তরুণদের নিয়ে তিনটি চমৎকার প্রযোজনা এই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল। কচি-কাঁচাদের ‘জুতা-আবিষ্কার’ (পরিঃ সম্রাট বসু) একটু অধিক সন্ন্যাসীর ভিড় থাকলেও খুবই উপভোগ্য নাট্যপ্রয়াস, সন্দেহ নেই। শিশুদের তরতরে অভিনয়ে মঞ্চে উপচে পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতার নির্মল কৌতুক। রাজা, মন্ত্রী আর মুচির ভূমিকায় মজার অভিনয় করেছে শিশুরা, তবে রাজার শব্দোচ্চারণে আরও স্পষ্টতার দরকার।

সবচেয়ে সুষ্ঠু ও পরিণত প্রযোজনা ‘অ্যাস্ট্রোনটের ঠিকানা’ (রচনা ও পরিঃ দীপান্বিতা রায়)। দুঃস্থ বিধবা মা, তার কল্পনাপ্রবণ মেয়ে ঝিমলি, দয়ালু ধনী পরিবার আর চাঁদের বুড়ি সব নিয়ে ইচ্ছাপূরণের আধুনিক রূপকথা। সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে বড়লোকের বাড়ির রাঁধুনি মায়ের ভূমিকায় সহজ ও সুদক্ষ সংবেদনশীল অভিনয়। ঝিমলি আর চাঁদের বুড়ির চরিত্রে ও অভিনয় ছিল শক্তিশালী, সেই সঙ্গে কিশোর-কিশোরীর কণ্ঠে কোরাস গান—সব মিলিয়ে এই নাটক উৎসবের সেরা প্রযোজনাগুলির সঙ্গে তুলনা করা চলে। অনসম্বলের তৃতীয় নাটক তাসের দেশ (পরিঃ সুশান্ত মণ্ডল) অনেকটাই শৌখিন প্রযোজনার মতো, কিন্তু কুশীলবদের মধ্যে প্রতিভার অভাব নেই। সংক্ষেপ করার ফলে নাট্যগুণের অভাব ঘটেছে অনেকটাই। গান, সঙ্গীত ও মঞ্চচারণার গুণে অবশ্যই নাটক উতরে গেছে। আর অভিনবত্ব ছিল পোশাকে।

Advertisement

উৎসবে আয়োজিত নাট্যমেলায় কলকাতা নাটকগুলির অন্যতম ছিল স্বপ্নসন্ধানীর ‘আন্তিগোনে’। শিশির দাস অনূদিত সোফোক্লিসের মূল নাটক একটি সংহত ঋজু গ্রীক ট্র্যাজেডি। কৌশিক সেনের পরিচালনায় এই ট্র্যাজেডি জাতীয় জীবনে ঘোর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়াবহতার নাটকে রূপান্তরিত হয়েছে। সন্ত্রাসের আবহ প্রেক্ষাগৃহেও উপচে পড়ছে যখন ক্রেয়নের গুপ্তচরেরা মঞ্চ থেকে নেমে এসে দর্শকদের শাসায় যে তারা সকলের ওপর নজর রাখছে। কৌশিক সেনের ক্রেয়ন সাম্প্রতিক কালের কোনও বিরুদ্ধমত-অসহিষ্ণু ডিক্টেটর আর মুখোশ পরা কোরাস যেন শাসকের আশ্রিত বুদ্ধিজীবী। সারা প্রযোজনা জুড়ে থাকে গ্রীক নাটকের এই সমকালীন প্রাসঙ্গিকতার সাড়ম্বর অতি-উচ্চারণ যার আওতায় চাপা পড়ে ‘নিস্ফলতার আর্তনাদ’। মঞ্চসজ্জাতেও প্রকট এই অতিশয়োক্তি। তবু নিঃসন্দেহে একটি শক্তিশালী প্রযোজনা।

উৎসবে মঞ্চস্থ হয়েছিল দুটি ছোট বাংলা নাটক— ‘ওরে বিহঙ্গ মোর এবং ‘আনসেন্ট লেটার্স’। প্রথমটি এসেছিল মার্কিন দেশ থেকে, সিয়াটেল-বাসী বাঙালিদের নাট্যদল বৃশ্চিকের প্রযোজনা (রচনা ও পরি: দেবব্রত দে)। বিবাহিত দম্পতির জীবনে ত্রিকোণ প্রেমের সাধারণ কাহিনি; কিন্তু রচনা, পরিচালনা ও অভিনয়ের কুশলতায় দর্শক মজিয়ে রাখে টানটান নাটকীয় অভিঘাতে। খুব স্মার্ট অভিনয় তিনজনের ভূমিকাতেই, কিন্তু বিবাহিতা নায়িকা ও তার প্রেমিকের চরিত্রাভিনয় বিশেষ উল্লেখযোগ্য। দেবব্রত দের স্বামীর গোপন বেদনা অশ্রুপাতের ভাবাবেগে কিছুটা বাষ্পাচ্ছন্ন।

দ্বিতীয়টি, ‘আনসেন্ট লেটার্স’ নাম ইংরেজি হলেও বাংলা নাটক এবং অনুষ্ঠান মূলত শ্রুতিনাটকের মতো। তিন জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা বিভিন্ন সময়ে পরস্পরকে চিঠি লেখে দারুণ দুঃসময়ে — কলকাতার ছেচল্লিশের দাঙ্গা, সত্তরের নকশাল আন্দোলন এবং গাজায় ইস্রাইল-প্যালেস্তাইনের যুদ্ধের সময়। দাঙ্গা, সশস্ত্র বিপ্লব ও যুদ্ধের হানাহানিতে দুজনের একজন নিহত হয়। সে চিঠি কখনওই উদ্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছয় না।

অভিনব নাট্য পরিকল্পনা, অতি সুলিখিত স্ক্রিপ্ট যাতে দুটি তরুণ-তরুণীর ভালবাসাবাসির মোড়কে থাকে তিনটি সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগের ট্র্যাজিক ব্যঞ্জনা। তিনটি জুটির ভূমিকায় পোশাক বদলে দুই কুশীলব, চিঠির লেখক ও প্রাপক, তাদের লেখা চিঠি পড়ে শোনায় মঞ্চের দুধারে বসে। তাদের কণ্ঠস্বরে ধরা পড়ে নবীন প্রেমের অনুরাগ ছাড়াও দুঃসাহসী তারুণ্যের প্রাণপ্রাচুর্য। মঞ্চে সঙ্গীতের দায়িত্বে-থাকা তৃতীয়জনের ভূমিকাও ছিল খুবই সফল।

ওড়িশা থেকে চেতনা এনেছিল ওড়িয়া নাটক ‘আবু’ (কাহিনি: মনোজ দাস, নাট্যরূপ ও পরিচালনা: সুবোধ পট্টনায়ক)। আবু এক প্রচ্ছন্ন শ্লেষের নাটক। আবুর মাথার একটি অতিকায় আব দেখে ডাক্তাররা আবিষ্কার করেন যে পৃথিবীতে সেটাই সবচেয়ে বড় আব। ফলে, আবু সেলিব্রিটি হয়ে ওঠে মিডিয়ার প্রচারে; বিজ্ঞাপনে মডেলিঙের সুযোগ পেয়ে তার অর্থার্জনও সুগম হয়। আবটাকেই মূলধন করে আবু ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির লোভে রাজনীতি করতে গিয়ে আব-সমেত সর্বস্ব হারায়। তখন চাষবাস করে সুখী জীবনের সন্ধান পায়। এমন একটি নীতিসার গল্প নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গের তামাশা না করে একটি সিরিয়াস নাটক করতে পারেন এক মাত্র সুবোধ পট্টনায়ক। তিনি দর্শককে একটি নান্দনিক নাট্য-অভিজ্ঞতার শেষে নিয়ে যান এক মূল্যবোধের অনুচ্চ বক্তব্যে। বাঁশের তৈরি নূন্যতম মঞ্চসজ্জা, কুশীলবদের দেহনির্মিত প্রপস এবং মঞ্চের পেছনে কোমর সমান পর্দা-ঢাকা আড়াল থেকে চকিতে পোশাক পাল্টে অভিনেতাদের একের পর এক দৃশ্য রচনা করে নিরঙ্কুশ গতিতে নাটক-করা সুবোধ পট্টনায়কের পরিচালনার উৎকর্ষ। এই প্রযোজনায় তার কিছু ঘাটতি ছিল না।

দিল্লির নাট্যদল উর্জা মঞ্চস্থ করেছিল ‘স্ত্রী সুবোধিনী’ (রচনা: মনু ভান্ডারী, পরি: ত্রিপুরারি শর্মা)। এক অবিবাহিতা মেয়ের অফিস-বসের সঙ্গে প্রেম- সম্পর্কে লিপ্ত থাকার কাহিনি। নিজে যে বিবাহিত, সে কথা গোপন রেখে অফিসার বস অধীনস্থ কর্মচারিণীর সঙ্গে নির্দ্ধিধায় প্রেম চালিয়ে যান এবং সেই সম্পর্কে ভাঁটা পড়ে না তাঁর বিয়ের কথা জানাজানি হওয়ার পরেও। এসব নিয়ে যে জটিল সরস পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তারই তীব্র ব্যঙ্গ, শ্লেষ ও কৌতুকে ভরা প্রযোজনা। নির্বোধ মেয়েটির চরিত্র জীবন্ত হয়েছে মুনমুন সিংহের দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত একক অভিনয়ে। অনেক সময় নাটকের গল্পের চেয়ে দর্শকদের টেনে রাখে অভিনয়ের প্রাণপ্রাচুর্য।

বিহার থেকে এসেছিল রাগ নাট্যদল প্রযোজিত ‘নাটমেথিয়া’ (রচনা: পুন্জ্ প্রকাশ, পরি: রণধীর কুমার)। নায়ক ভিখারী ঠাকুর বিশ শতকের সূচনায় বিহারের এক অনগ্রসর সমাজে। এই সমাজে একজন দায়বদ্ধ নাট্যকর্মীর সংগ্রামকে পরিচালক চমৎকার অনাড়ম্বর নাটকীয় সঙ্কটের রূপ দিয়েছেন আর সেই সঙ্গে সমকালীন অনগ্রসরতাকে উপযুক্ত মঞ্চভাষায় এমনভাবে পেশ করেছেন যে তার তাৎপর্য এখনও প্রাসঙ্গিক। কুশীলবদের চমৎকার একক ও দলগত অভিনয়েই তা সম্ভব হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement