সোপান: মায়া আর্ট স্পেসে শঙ্কর এস-এর প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম।
মায়া আর্ট স্পেসে শঙ্কর এস-এর একটি প্রদর্শনী হয়ে গেল, ‘জাক্সট-এ-স্কেপ্স’। শঙ্কর এটিকে ‘ডিজিটাল ফটো মন্তাজ’ বলতে চেয়েছেন। মায়া আর্ট স্পেসে তাঁর যে শিল্পকর্ম দর্শক দেখতে পেলেন, সেখানে বিভিন্ন আলোকচিত্র পাশাপাশি ডিজিটালি স্থাপন করে একটা অন্য কথা বলা হয়েছে। অন্য এক সত্যের সন্ধান করেছেন শিল্পী। ১৯টি কাজ দিয়ে সাজানো হয়েছে এই প্রদর্শনী।
অন্তত এক শতাব্দী ধরে সমস্ত বিশ্বে ফাইন আর্টস বা ললিতকলা অনেক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে চলেছে এবং তারপর ১৯৮০ সাল থেকে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা প্রযুক্তির আমদানি।
শঙ্কর জীবন শুরু করেছিলেন চিত্রশিল্পী হিসেবে। তারপর আলোকচিত্রের প্রতি আকর্ষণ তাঁকে ফোটোগ্রাফার-এর ভূমিকায় নিয়ে যায়। এর পর গবেষণামূলক অ্যানিমেশন শিল্প নিয়ে পড়াশোনা করে হলেন গ্রাফিক ডিজ়াইনার এবং পরে স্কুলে শিক্ষকতা করেন ফোটোগ্রাফি এবং ভিসুয়াল আর্টসে। এ ছাড়াও অবিচ্ছিন্ন ভাবে নিজের পরীক্ষামূলক কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। প্রায় ১০ বছর পরে শঙ্করের একটি একক প্রদর্শনীর আয়োজন করল মায়া আর্ট স্পেস।
মোটামুটি ১৯৬০ সালে কম্পিউটার আসার পর থেকেই ফোটোশপ ইত্যাদির মাধ্যমে কম্পিউটার আর্ট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল। সত্তরের দশকে সেটি আরও বেশ খানিক উৎসাহ পেল, শক্তি পেল বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার আবিষ্কারের ফলে। আশির দশকে পুরোদমে এই বিষয়টি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। তারপরে এল এ.আই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স)। শিল্পীরা এ.আইকেও নিজের মতো ব্যবহার করতে লাগলেন। এই গত ১০-১৫ বছরে ডিজিটাল আর্টকে একটা বিশেষ আর্টফর্ম বলেই গণ্য করা হচ্ছে। পশ্চিমের দেশগুলিতে তো বটেই, আমাদের দেশেও ডিজিটাল আর্টকে একটা বিশেষ আসন এখন দেওয়া হয়। কারণ এখানে শিল্পীর পারদর্শিতা তো আছেই, তার সঙ্গে যুক্ত হয় সৃজনশীলতা, মনন এবং কিছুটা শিল্পীর জীবন-দর্শন।
প্রদর্শনীর একটি ছবির নাম ‘অ্যাসেন্ড না ডিসেন্ড’! একে বলা যায় সিঁড়ির সমাবেশ। দক্ষতার সঙ্গে সাজিয়েছেন সিঁড়িগুলি, এমন ভাবে যে, কখনও মনে হচ্ছে ধাপে ধাপে উপরে উঠছি, আবার কোনও সিঁড়িটা দিয়ে যেন নেমেও আসতে ইচ্ছে করবে। এখানে যেন কোনও জোড় বা সেলাই নেই। মজার একটা ধাঁধা সৃষ্টি করেছেন শিল্পী।
পরের ছবিটির নাম ‘খেজুর গুড়’। প্রথমে আগুন, পাশে উনুন, হাঁড়িতে রস ফুটছে, উপর থেকে ফেনা উঠিয়ে ফেলা হচ্ছে। এই সমস্তটাই মোনোক্রম বা একবর্ণে সম্পন্ন করেছেন শঙ্কর, কিন্তু মাঝখানে গুড়ের ছবিটি ইয়েলো অকারের নানা টোনে। তাই নাম খেজুর গুড়। আকর্ষক ভাবে সাজিয়েছেন ছবিটি। দর্শকের চোখ চারিদিক ঘুরে সোজা চলে যায় গুড়ের দিকে। আর সেটাই হয়তো শিল্পী চেয়েছেন।
আর একটি ছবির নাম ‘প্যাচড’। দূর থেকে দেখলে যেন নকশি কাঁথার ভাব, কিন্তু কাছ থেকে গল্পটা অন্য রকম। ছবির একেবারেই ডান দিকে প্রাসাদোপম বাড়ির প্রবেশদ্বার। বাড়িটি অবশ্যই কোনও বিত্তশালী মানুষের, কিন্তু এই প্রাসাদের পিছন দিকের শোচনীয় অবস্থাও দেখিয়েছেন শঙ্কর। বাড়ির পিছনে তো চোখ কারও যাবে না, কিন্তু শিল্পীর চোখে সেই দৈন্যদশা ধরা পড়েছে।
এই ছবিটির নাম ‘রাজবাড়ি’। নকশা দেখলে বোঝা যায় যে একটাই রাজবাড়ি, কিন্তু শঙ্কর প্রতিচ্ছবিগুলিকে পাশাপাশি অবস্থান করিয়েছেন এমন ভাবে যে, আমাদের পুরো বাড়িটিই প্রায় দর্শন হয়ে যায়। এমনকি মাঝখানের উঠোনে একটি পরিত্যক্ত দেবীমূর্তিও দেখতে পাই। ভাঙা দেওয়ালের উপর দিয়ে নীল আকাশ, খাঁজে খাঁজে ফাটল থেকে গাছের উঁকিঝুকি, বটের ঝুরি নেমেছে কোথাও কোথাও। অদ্ভুত একটা রোম্যান্টিক স্মৃতিবেদনা জাগায় ছবিটা।
এর পরে আমরা দেখি ‘মেজ অফ লাইফ’। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের উপরের বারান্দা থেকে ক্যামেরায় সোজা নীচের ফুটপাতের ছবি তুলেছেন। ছোট ছোট ৬৪টি ছবি পাশাপাশি সাজিয়ে সত্তরের দশকের প্রথম থেকে শুরু করে প্রায় তিরিশ বছরের ফুটপাতটির চেহারা-পরিবর্তনের ছবি দিয়ে গাঁথা এক গাথা। কালক্রম অনুযায়ী সাজিয়েছেন রাজনৈতিক হাতবদলের হাত ধরে। এই গল্পটি বেশ চিত্তাকর্ষক।
এই সমস্ত ছবি মন্তাজের ভিতরে একটা যেন শূন্যতা, অসহায়তা এবং ভেঙে পড়া সমাজের ছবি পাওয়া যায়। কিন্তু একেবারে শেষে একটি মূকাভিনয়ের ভিতর দিয়ে পুরো গল্পটিকে বেমালুম ঘুরিয়ে একটি চরম উপলব্ধির কথা বলেছেন শঙ্কর।
একটি পুরুষ তার প্রেমিকার কাছ থেকে প্রেমপত্র পেয়ে প্রথমে খুব খুশি হয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বুঝতে পারে যে, আসলে তাকে এই চিঠিতে ত্যাগ করা হয়েছে, বর্জন করা হয়েছে। তখন সেই পুরুষটি নিজের জীবন শেষ করতে উদ্যত হয়। বিষ পান করতে চায় এবং গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সমস্ত কিছুতে বিফল হয়ে শেষে তার উপলব্ধি হল যে, নিজেকে প্রথমে ভালবাসতে হবে। সে তখন নিজেকে আলিঙ্গন করে। এটিই সম্ভবত প্রদর্শনীর শ্রেষ্ঠ কাজ।