গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
সারা বছর কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে নানা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে তৃণমূল। কিন্তু সংসদের শেষ শীতকালীন অধিবেশনের তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারকে সংসদের দুই কক্ষে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করেছেন বিজেপির সাংসদেরা। দ্বিতীয় স্থানে তৃণমূল। কংগ্রেস-সিপিএম প্রথম এবং দ্বিতীয়ের ধারেকাছে নেই।
তবে একইসঙ্গে এ-ও উল্লেখ্য যে, সাধারণ ভাবে সংসদে লিখিত প্রশ্ন করাকে অনেকেই সাংসদদের ‘রুটিন’ কাজ বলে মনে করেন। অনেকে কাজ দেখাতে ‘নিরাপদ পন্থা’ বলেও অভিহিত করেন। তাঁদের মতে, লিখিত প্রশ্নের জবাবে তেমন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ জবাব পাওয়া যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রীরা ‘রুটিন’ জবাব দেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দফতরের পূর্ণমন্ত্রীরাও জবাব দেন না। বরং বিতর্কে অংশ নিয়ে সেই সুযোগে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করা অনেক বেশি ‘কাজের’ বলে মনে করেন অনেকে। তাঁদের মতে, সংসদে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে ‘সংখ্যা’র চেয়ে প্রশ্ন বা বক্তব্যের ‘মান’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হয়েছিল গত ২৫ নভেম্বর। শেষ হয় ২০ ডিসেম্বর। এর মধ্যে লোকসভা বসেছে ২০ বার। রাজ্যসভা ১৯ বার। সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে পশ্চিবঙ্গের ৫৫ জন সাংসদ রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কারা ক’টি প্রশ্ন করেছেন?
সংসদের তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভা সাংসদদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করেছেন বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য। ৩২টি। দ্বিতীয় স্থানে তৃণমূলের তিন জন। রাজ্যসভার তৃণমূল দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন, সাকেত গোখলে এবং মহম্মদ নাদিমুল হক। তিন জনেই ৩১টি করে প্রশ্ন করেছেন। তৃণমূলের তিন রাজ্যসভা সাংসদ এই অধিবেশনে কোনও প্রশ্ন করেননি। সুব্রত বক্সী, মমতাবালা ঠাকুর এবং ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার রাজ্যসভায় গেলেন ঋতব্রত। এর আগের বার গিয়েছিলেন সিপিএমের টিকিটে। পূর্ণ মেয়াদের জন্য। যদিও শেষ দিকটা তাঁকে ‘দলহীন সাংসদ’ হয়ে থাকতে হয়েছিল। এ বার ঋতব্রত রাজ্যসভায় গিয়েছেন তৃণূলের জহর সরকার মেয়াদ ফুরোনোর আগেই ইস্তফা দেওয়ায়। আগের বার ছ’বছরে ৭২৩টি প্রশ্ন করেছিলেন ঋতব্রত। এ বার তিনি নিজের প্রথম অধিবেশনে একটাও প্রশ্ন করলেন না কেন? ঋতব্রতের জবাব, ‘‘আমি শপথ নিয়েছি ১৬ ডিসেম্বর। ২০ তারিখ অধিবেশন শেষ হয়ে গিয়েছে। পাঁচ দিন অধিবেশনে যোগ দিতে পেরেছি। প্রশ্ন আগাম জমা দেওয়ার তারিখ তার আগেই পেরিয়ে গিয়েছিল। আমার প্রশ্ন করার কোনও সুযোগই ছিল না।’’ যোগ করলেন, ‘‘বাজেট অধিবেশনে ছবিটা এ রকম থাকবে না।’’ প্রসঙ্গত, বিজেপির অনন্ত মহারাজও শীত অধিবেশনে রাজ্যসভায় একটিও প্রশ্ন করেননি।
গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
এ রাজ্য থেকে সংসদে সিপিএমের একমাত্র সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। বছরভর প্রায় সব বিষয়ে বিকাশ বিভিন্ন পরিসরে মুখ খোলেন। কিন্তু গোটা শীতকালীন অধিবেশনে মাত্র চারটি প্রশ্ন তুলেছেন বিকাশ।
লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গের ৪২ জন সাংসদের মধ্যে সুকান্ত মজুমদার এবং শান্তনু ঠাকুর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তাঁদের কাজ প্রশ্ন করা নয়, প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। বসিরহাট থেকে নির্বাচিত তৃণমূল সাংসদ হাজি নুরুল ইসলাম অধিবেশনের আগেই প্রয়াত। এঁদের বাদ দিলে বাংলার বাকি ৩৯ জন সাংসদের মধ্যে প্রশ্ন করায় এক নম্বরে বিজেপির খগেন মুর্মু। তাঁর প্রশ্নের সংখ্যা ২৪। দ্বিতীয় স্থানে দমদমের তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। ২৩টি প্রশ্ন। তাঁর পরেই জলপাইগুড়ির বিজেপি সাংসদ জয়ন্ত রায় এবং বর্ধমান-দুর্গাপুরের তৃণমূল সাংসদ কীর্তি আজাদ। দু’জনেই ২২টি করে প্রশ্ন করেছেন। পঞ্চম স্থানে দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তা। প্রশ্নের সংখ্যা ২১। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন ১০টি প্রশ্ন।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে জিতে বাংলা থেকে সংসদে যাওয়া লোকসভা সদস্যদের মধ্যে ১৭ জন কোনও প্রশ্ন করেননি শীত অধিবেশনে। তাঁদের মধ্যে ১৫ জনই তৃণমূলের। দু’জন বিজেপির। তাঁদের মধ্যে একজন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালীন অভিজিতের প্রশ্নে লাগাতার বিদ্ধ হয়েছে রাজ্য সরকার। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে সেই অভিজিৎই প্রশ্নহীন।
তৃণমূলের লোকসভা সাংসদদের মধ্যে যাঁরা কোনও প্রশ্ন শীত অধিবেশনে করেননি, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কাকলি ঘোষ দস্তিদার। এক জন লোকসভায় দলের নেতা, অন্য জন উপনেতা। বারাসতের সাংসদ কাকলি বলছেন, ‘‘আমি তো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংসদে বলি। পাশাপাশি আমাকে মাঝেমধ্যেই স্পিকারের চেয়ারে বসে অধিবেশনও চালাতে হয়। তাই প্রশ্ন করার অবকাশ সব সময় থাকে না।’’ কাকলির আরও দাবি, ‘‘আমরা নতুনদের একটু বেশি করে সুযোগ দিতে চাইছি। তাই সিনিয়ররা কম প্রশ্ন করছি।’’
সংসদের তথ্য অবশ্য বলছে না যে, নতুন সাংসদেরা প্রশ্ন করার সুযোগ বেশি পাচ্ছেন। বাপি হালদার, শর্মিলা সরকার, জগদীশচন্দ্র বর্মা বসুনিয়া, পার্থ ভৌমিক, মিতালি বাগ, জুন মালিয়া, কালীপদ সরেন, অরূপ চক্রবর্তী— তৃণমূলের আট জন নতুন সাংসদের খাতে কোনও প্রশ্ন নেই। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সবচেয়ে ‘সরব’ হিসেবে পরিচিত দুই সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মহুয়া মৈত্রও পিছনের সারিতে। কল্যাণ শীত অধিবেশনে প্রশ্ন করেছেন মাত্র একটি। মহুয়া একটিও নয়।
পরিস্থিতি দেখে বিজেপির সাংসদ শমীক বলছেন, ‘‘তৃণমূল তথ্য সম্বলিত প্রশ্ন তুলতে অভ্যস্ত নয়। ওরা শুধু কেন্দ্রের বঞ্চনার অভিযোগ তুলে বিবৃতি দিতে অভ্যস্ত। সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্ব তো বিবৃতি দেওয়ার জায়গা নয়। তাই সংসদের বাইরে তাদের মুখে অজস্র কথা শোনা গেলেও সংসদে ঢুকে তৃণমূল পিছিয়ে পড়ে।’’