বিধায়ক মৃগেন মাইতির সামনেই মেডিক্যালের শিশু ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিড়াল।
সুষ্ঠ চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানের মাধ্যমে রোগীর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করাই হাসপাতালের কাজ। অথচ রুগণ্ সেই হাসপাতালে স্বাস্থ্যই।
বুধবার আচমকা হাসপাতাল পরির্শনে আসেন রোগী কল্যাণ সমিতির সভাপতি তথা বিধায়ক মৃগেন মাইতি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মেডিক্যালের অধ্যক্ষ তমালকান্তি ঘোষ, হাসপাতাল সুপার যুগল কর প্রমুখ। পরিকাঠামো ও নজরদারির অভাবটাই যে হাসপাতালের আসল ‘অসুখ’, তা মানলেন মেডিক্যালের কর্তারা।
চিত্র: ১ দুপুর তখন সওয়া একটা। পরিদর্শক দলের সদস্যেরা প্রথমে ঢুকলেন অপারেশন থিয়েটার (ওটি)-তে। ওটি থেকে বেরিয়েই থমকে দাঁড়ালেন সকলে। এ কী! রোগীর পরিজনদের বসার জন্য নির্দিষ্ট ঘরের দরজার তালাই যে খোলা হয়নি! অগত্যা, পরিজনদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে সামনের বারান্দায়। অধ্যক্ষ আর বিধায়ক তখন একে অন্যের দিকে তাকিয়ে।
কিছুটা দূরেই ছিলেন হাসপাতালের সহকারী সুপার শ্যামল পট্টনায়েক। অধ্যক্ষের তলব পেয়ে এসে শ্যামলবাবুর সাফাই, “আসলে রাতের বেলায় এই ঘরটার দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয় তো! না- হলে অনেকে নোংরা করে দেয়। সকালে অবশ্য তালা খুলে দেওয়া হয়। আজই খোলা হয়নি! দেখছি কেন এটা হল!” ওটি’র সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শান্তনু দাস নামে এক রোগীর পরিজন অবশ্য বলছিলেন, “শুধু আজ নয়। প্রায় দিনই এই ঘরটার দরজা বন্ধ থাকে!”
চিত্র: ২ ওটি থেকে বেরিয়ে রোগী কল্যাণ সমিতির কর্মকর্তারা গেলেন শিশু ওয়ার্ডে। গায়ে জ্বর নিয়ে অনেকেই ওই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। কর্মকর্তারা যখন ওয়ার্ডে ঢুকলেন, তখনও এদিকে-সেদিকে বিড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাঁরা কথা বললেন চিকিৎসাধীন শিশুদের মায়েদের সঙ্গে। শুনলেন তাঁদের সমস্যার কথা। তারপরেই পরিদর্শকেরা হাসপাতালের সভাগৃহে বৈঠকের জন্য চলে যান।
শিশু ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের একটি গেটের কাছে আসতেই বিধায়ককে ঘিরে ধরলেন রোগীর পরিজনেরা। শেখ আজিম নামে এক যুবক বিধায়কের কাছে গিয়ে বলেন, “গতকাল থেকে আমার এক আত্মীয় ভর্তি আছেন। তাঁর কোনও চিকিৎসাই হচ্ছে না। যাঁর কাছেই যাচ্ছি, তিনি বলছেন আমি নয়, ওই চিকিৎসককের কাছে যাও! কিছু বুঝে উঠতে পারছি না!” তখন বিড়ম্বনার মধ্যে মৃগেনবাবু। একই অবস্থা অধ্যক্ষ- সুপারেরও। এরপর সাহস করে অনেকেই তখন তাঁদের অভাব-অভিযোগের কথা বলতে চাইছেন। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে পা চালালেন সমিতির কর্মকর্তারা। যাওয়ার আগে ওই যুবককে বিধায়কের আশ্বাস, “আপনার ব্যাপারটা দেখছি!” কেন চিকিৎসকদের হদিস পেতে রোগীর পরিজনদের সমস্যায় পড়তে হয়? মেডিক্যালের অধ্যক্ষ তমালকান্তিবাবু বলেন, “মেডিক্যাল কলেজ আর জেলা হাসপাতালের মধ্যে একটা তফাৎ রয়েছে। মেডিক্যালে এক- একটি ইউনিট থাকে। এখানে যেমন রয়েছে।” তাঁর দাবি, “কিছু অভিযোগ আসে। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে পদক্ষেপও করা হয়। অভিযোগ পেয়ে কিছু করব না, তা তো হতে পারে না! আমরা শো- কজও করি।”
দুপুর গড়ালেও তালা খোলেনি অপারেশন থিয়েটারের
সামনে রোগীর পরিজনদের বিশ্রাম কক্ষের।
বুধবার দুপুরে মেদিনীপুর মেডিক্যালে রোগী কল্যাণ সমিতির বৈঠক ছিল। বৈঠকে যোগ দিতে এসেই আচমকা হাসপাতাল পরিদর্শন করেন মেদিনীপুরের বিধায়ক। মৃগেনবাবু মেদিনীপুর মেডিক্যালের পরিচালন সমিতির সভাপতি পদেও রয়েছেন। আচমকা পরিদর্শন বলে দাবি করা হলেও হাসপাতালের পরিবেশ দেখে অনেকেরই মনে হল, সমিতির কর্মকর্তারা যে পরিদর্শনে আসবেন, তা আগে থেকেই জানতেন হাসাতালের চিকিৎসক- নার্স থেকে কর্মীরা সকলেই। কারণ, এদিনের পরিবেশ ছিল আর পাঁচটা দিনের থেকে আলাদা। ততটা অস্বাস্থ্যকর নয়। হাসপাতালে কেউ পরিদর্শনে আসার কথা থাকলেই তড়িঘড়ি পুরো পরিবেশটা বদলে দেওয়া হয়। এটাই এখন দস্তুর। তার অন্যথা হয়নি এ দিনও। এ দিন সকাল থেকেই হাসপাতাল চত্বর সাফসুতরো করার কাজ শুরু হয়।
মেদিনীপুর মেডিক্যালের পরিষেবা নিয়ে প্রায়শই নানা অভিযোগ ওঠে। এবিষয়ে মৃগেনবাবু বলেন, “এখানে প্রচুর রোগী আসেন। এসএসকেএমের মতো পরিকাঠামো আমাদের নেই, এটা ঠিক। কিছু ত্রুটি আছে। এত বড় প্রতিষ্ঠানে কিছু ত্রুটি থাকবেই। তবে আমরা ত্রুটিগুলো সংশোধন করার চেষ্টা করছি।” মেডিক্যালে সিনিয়র চিকিৎসকদের গরহাজিরা নিয়ে অভিযোগও নতুন নয়। এ নিয়ে একাংশ জুনিয়র চিকিৎসকদের মধ্যেও অসন্তোষ রয়েছে। কারণ, সিনিয়ররা না- থাকলে কাজের চাপ এসে পড়ে জুনিয়রদের উপরই। এক্ষেত্রে মৃগেনবাবুর বক্তব্য, “এটা ঘটনা জুনিয়ররা বেশি সময় দেন। তবে সিনিয়ররা সকলেই থাকেন না, এটা ঠিক নয়!”
ঠিক কী আলোচনা হয়েছে এ দিনের বৈঠকে? হাসপাতাল সূত্রে খবর, প্রস্তাবিত ‘মা ও শিশু সুরক্ষা কেন্দ্র’, আই- ওয়ার্ড, ইএনটি ওয়ার্ড, বার্ন ইউনিট প্রভৃতি বিষয় উঠে আসে আলোচনায়। কিছু কাজ সময়ের মধ্যে শেষ না- হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেন মৃগেনবাবু। মেডিক্যালের কর্মকর্তারা অবশ্য তাঁদের মতো করে যুক্তি সাজিয়ে দেন। বৈঠকে বিধায়ক এমনও মন্তব্য করেন, “সিনিয়র ডাক্তারদের হাজিরার বিষয়টি এ বার গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। হাসপাতালে এসে রোগীরা সমস্যায় পড়বেন, তাঁদের পরিজনেরা সমস্যায় পড়বেন, এ হতে পারে না।” পাশাপাশি তিনি জানিয়ে দেন, কাজে ফাঁকি কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। কোনও অভিযোগ এলে দ্রুত তা খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করতে হবে। বৈঠক শেষে মৃগেনবাবু বলেন, “পরিকাঠামোগত কিছু সমস্যা থাকবেই। তারমধ্যেই কাজ করতে হবে। হাসপাতাল নিয়ে আমার কাছেও কিছু অভিযোগ আসে। যা বলার বৈঠকে আলোচনার সময়ই বলেছি।”
বিধায়কের এই ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’ কতটা কাজে এল, তা অবশ্য সময়ই বলবে! মেডিক্যালের এক কর্তা অবশ্য বলেন, “প্রচুর ফাঁকফোঁকর রয়েছে। তার কিছুটা ভরাট
হলেই অনেক!”
ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।