চিকিৎসকদের মঞ্চে হুঁশিয়ারি মুখ্যমন্ত্রীকেও

রাজ্যের সাম্প্রতিক জ্বর-পরিস্থিতির জেরে আর এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। নজির ভেঙে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের বিরুদ্ধে কার্যত জেহাদ ঘোষণা করলেন সরকারি চিকিৎসকদেরই একাংশ। যাঁদের প্রকাশ্য সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী-সহ স্বাস্থ্যভবনের তাবড় কর্তারা! গত তিন বছরে স্বাস্থ্য দফতর নানা কারণে বিভিন্ন ডাক্তারকে বদলি করেছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৪ ০৩:০৪
Share:

রাজ্যের সাম্প্রতিক জ্বর-পরিস্থিতির জেরে আর এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। নজির ভেঙে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের বিরুদ্ধে কার্যত জেহাদ ঘোষণা করলেন সরকারি চিকিৎসকদেরই একাংশ। যাঁদের প্রকাশ্য সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী-সহ স্বাস্থ্যভবনের তাবড় কর্তারা!

Advertisement

গত তিন বছরে স্বাস্থ্য দফতর নানা কারণে বিভিন্ন ডাক্তারকে বদলি করেছে। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আচমকা হাসপাতাল সফরে গিয়ে ডাক্তারকে সাসপেন্ড করছেন, এমনও দেখা গিয়েছে। তবু সরকারি চিকিৎসকদের তরফে সমবেত প্রতিবাদ কখনও ওঠেনি। কিন্তু এ বার উঠল। উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিস সংক্রমণ জানাজানি হওয়ার পরে যে ভাবে সেখানকার চার স্বাস্থ্য-কর্তাকে নবান্ন তড়িঘড়ি সাসপেন্ড করেছে, তাতে প্রকাশ্য মঞ্চে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সরকারি চিকিৎসকদের এক সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরা। বুধবার কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আয়োজিত সম্মেলনে তাঁরা এ প্রসঙ্গে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। সেখানে আওয়াজ উঠেছে রাজ্যের স্বাস্থ্য-সচিব ও দুই স্বাস্থ্য-অধিকর্তার বিরুদ্ধেও।

বস্তুত মুখ্যমন্ত্রীর যখন-তখন যাঁকে-তাঁকে শাস্তিদানের প্রবণতায় তাঁরা যে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ, বামপন্থী সরকারি চিকিৎসকদের ওই সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হেল্থ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ চক্রবর্তীর কথায় তা স্পষ্ট। সভায় যাঁর ঘোষণা, “দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে আমাদের। সাসপেনশন না-তুললে বৃহত্তর আন্দোলন হবে।” পাশাপাশি সত্যজিৎবাবু এ-ও বলেন, “হয়তো আমাদের কপালে দুঃখ রয়েছে। তা-ও যে সাহস করে অনুপদা (উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের সদ্য সাসপেন্ড হওয়া অধ্যক্ষ অনুপ রায়) ও বাকি সদস্যেরা এসেছেন, সে জন্য ওঁদের কুর্নিশ।” সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে চিকিৎসক-নেতার হুঁশিয়ারি, “মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, আপনি অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। আপনার কাছে কিন্তু চিকিৎসকদের কোনও বিকল্প নেই। এঁদের সম্মান নিয়ে খেলা করবেন না।”

Advertisement

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন

এনসেফ্যালাইটিস সংক্রান্ত তথ্য সময়মতো না-জানানোর অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রী অনুপবাবু-সহ উত্তরবঙ্গের চার স্বাস্থ্য-কর্তাকে সাসপেন্ড করেছেন। এ দিন কিন্তু তথ্য গোপনের দায়ে তাঁর সরকারকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন সত্যজিৎবাবুরা। “সর্বত্র গোপনে সরকারি চিকিৎসকদের মৌখিক নির্দেশ জারি করা হচ্ছে।” বলেছেন তিনি।

কী নির্দেশ, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন “বলা হচ্ছে, কোনও জাপানি এনসেফ্যালাইটিস কেস পেলে চেপে যাবেন। লিখবেন না। কেউ যেন জানতে না পারে। অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম (এইএস) বা জাপানি এনসেফ্যালাইটিস (জেই)-এ কারও মৃত্যু হলে খবর যেন বাইরে না যায়। যেন কোনও লিখিত প্রমাণ না-থাকে!”

এমতাবস্থায় তথ্য গোপনের দায়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য-সচিব, স্বাস্থ্য-অধিকর্তা ও স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তাকে কেন সাসপেন্ড করা হবে না, সভায় সেই প্রশ্ন তোলেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গৌতম মুখোপাধ্যায়। “ধরা যাক, মুখ্যমন্ত্রী প্রচুর ব্যস্ত, তাই খেয়াল করেননি। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য-কর্তারা কী করছিলেন? তাঁদের তো জেলা থেকে অনলাইনে সব রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল!” মন্তব্য গৌতমবাবুর। তাঁর প্রশ্ন, “জেলার কর্তারা সরাসরি মন্ত্রীদের ফোন করতে পারেন না। প্রোটোকলে আটকায়। স্বাস্থ্য-সচিব বা স্বাস্থ্য-অধিকর্তা কেন টেলিফোনে মুখ্যমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীকে জানালেন না? এই গাফিলতির জন্য কেন ওঁরা সাসপেন্ড হবেন না?”

এনআরএসে অ্যসোসিয়েশনের এ দিনের সভায় ভিড় কত হবে, তা নিয়ে গোড়ায় উদ্যোক্তাদের মনে সংশয় ছিল। তবে সভা বসলে দেখা যায়, জনা ষাট-সত্তর সরকারি চিকিৎসক হাজির! সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম ও হেল্থ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মতো সরকারি চিকিৎসকদের অন্যান্য সংগঠনও সামিল হয়েছিল। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)-এর কেন্দ্রীয় শাখার অধীন চিকিৎসকেরা ছিলেন। অনুপবাবু এলেও সাসপেন্ড হওয়া অন্য তিন জন অবশ্য আমন্ত্রণ সত্ত্বেও আসেননি। অনুপবাবু বলেন, “এত দিনে বুঝেছি, আমরা অনলাইনে যা তথ্য স্বাস্থ্যভবনে পাঠাচ্ছিলাম, সে সব নজরদারি করার সেল দীর্ঘ দিন অকোজো হয়ে পড়ে ছিল। আলাদা করে টেলিফোনে যে জানাতে হবে, তা বুঝতে পারিনি।” তাঁর দাবি, “স্বল্প পরিকাঠামোয় উত্তরবঙ্গের ডাক্তারেরা যে ভাবে পরিস্থিতি সামলেছেন, তা দৃষ্টান্তমূলক। আমি গর্বিত।”

এ দিন মঞ্চে সত্যজিৎবাবু বা গৌতমবাবুদের প্রতিটি কথায় পরে করতালিতে সভাগৃহ ফেটে পড়েছে। সমবেত কণ্ঠে উঠেছে ‘শেম, ‘শেম’ ধ্বনি। সরকারি চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই জানিয়েছেন, তদন্ত, শো-কজ ছাড়া, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না-দিয়ে পত্রপাঠ যে ভাবে স্বাস্থ্য-আধিকারিকদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তাতে তাঁরা স্তম্ভিত। তাঁদের আত্মসম্মান, মনোবল গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। আইএমএ-র কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সচিব অমিতাভ ভট্টাচার্যের কথায়, “শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ডাক্তারেরা রয়েছেন। আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রকে জানিয়েছি। স্বাস্থ্যভবনের উচ্চকর্তারা দায় ঝেড়ে ফেলবেন, মন্ত্রীদের উপরেও কোনও দায়িত্ব বর্তাবে না, আর যত দোষ হবে জেলার আধিকারিকদের?”

কিন্তু বাম আমলেও কি বিরোধী মনোভাবাপন্ন চিকিৎসকদের শাস্তিমূলক বদলি হতো না?

সত্যজিৎবাবুর ব্যাখ্যা, “বাম আমলে আমরাও কিছু ক্ষেত্রে পছন্দের লোক বা অনুগামীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছি। তবে এমন বেছে বেছে বিরোধীদের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হইনি, বা তাঁদের কেরিয়ার শেষ করে দিতে চাইনি।” উদাহরণ হিসেবে তাঁরা টেনে আনছেন সার্স, বার্ড ফ্লু এবং ২০০৮-এ এনসেফ্যালাইটিস প্রাদুর্ভাবের প্রসঙ্গ। ওঁদের দাবি, ওই সব কঠিন পরিস্থিতিতেও দফতর পিঠ বাঁচাতে ব্যক্তিবিশেষকে এ ভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি। বরং একযোগে মোকাবিলার চেষ্টা হয়েছিল। “প্রতিহিংসার নীতিতে আখেরে তো রাজ্যের স্বাস্থ্য-পরিষেবাই মার খাচ্ছে!’’ আক্ষেপ এক চিকিৎসকের।

সরকারি চিকিৎসকদের এ হেন সম্মেলনের খবর নবান্ন ও স্বাস্থ্যভবনে যথাসময়ে পৌঁছেছে। দু’দিনের জেলা সফরের পরে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন নবান্নে ছিলেন। স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও ছিলেন। স্বাস্থ্যভবনের কর্তারাও সব শুনেছেন। যদিও তাঁরা কেউ প্রকাশ্যে ব্যাপারটাকে আমল দিতে চাননি। বরং চন্দ্রিমাদেবীর কটাক্ষ, “এ সব রাজনীতি করে বলা হচ্ছে।” রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী মন্তব্য এড়ালেও স্বাস্থ্য-সচিব মলয় দে’র মন্তব্য, “যাঁদের সাসপেন্ড করা হয়েছে, তাঁরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন। তখন নিজেদের বক্তব্য জানাবেন।” স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া অবশ্য বেশ চড়া সুরে বাঁধা। “সরকারি নিয়ম মেনে কাজ করবেন না, আবার ব্যবস্থা নিলে ক্ষোভ উগরে দেবেন? মামার বাড়ি? এ সব আমরা বরদাস্ত করব না। যাঁরা দায়িত্ব পালন করেননি, তাঁদের পক্ষ নিয়ে কথা বলা হচ্ছে! কী সাহস!” বলেন সুশান্তবাবু।

এনআরএসের সভায় উপস্থিত ডাক্তারেরাও অবশ্য বিলক্ষণ জানতেন যে, ওখানে বক্তৃতা দেওয়া, এমনকী নিছক হাজিরার জন্যও শাস্তি হতে পারে। তা হলে এলেন কেন?

এক চিকিৎসকের জবাব, “সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছি। আর কোনও শাস্তিকে পরোয়া করি না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement