আনাজপাতি বা দুধ-মাংস-ডিমে বাসা বাঁধা আর্সেনিক তাড়ানোর দাওয়াই এখনও সে ভাবে মেলেনি। তবে বিপদমুক্তির কিছুটা দিশা দেখা দিয়েছে। দেখাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গেরই কিছু বিজ্ঞানী।
আর এই কাজে তাঁদের হাতে হাতিয়ার জুগিয়েছে প্রাচীন ভারতেরই এক চিকিৎসাশাস্ত্র আয়ুর্বেদ।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (আইসিএআর)-এর প্রকল্পে খাদ্য-শৃঙ্খলের আর্সেনিক দূরীকরণ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন রাজ্যের পাঁচ বিজ্ঞানী। প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের জান্তমণি হাজরিকা-তপনকুমার মণ্ডল-সমর সরকার, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের অবিচল চট্টোপাধ্যায়, এবং জেবি রায় আয়ুর্বেদিক কলেজের প্রশান্ত সরকার। গবেষণার শেষে তাঁদের দাবি: হলুদ, কেশুত ও কাঁটানটের মতো সহজলভ্য উপাদানের সাহায্যে আর্সেনিক-আক্রান্তের চিকিৎসা সম্ভব। প্রাথমিক ভাবে গরুর উপরে ওষুধ প্রয়োগ করে ফল মিলেছে। প্রশান্তবাবু জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে মানুষের উপরেও তাঁরা পরীক্ষা চালাবেন।
কী ভাবে চলেছে তাঁদের গবেষণা?
কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, নদিয়া জেলার আর্সেনিক কবলিত ১৭টি ব্লক থেকে তিরিশটি গরুকে বেছে নিয়েছিলেন পাঁচ গবেষক। গরুগুলির লোমে, দুধে, মল-মূত্রে প্রচুর পরিমাণ আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছিল। তাদের তিনটে ভাগে ভাগ করে পরীক্ষা চলে। একটি দলকে শুধু হলুদ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দলকে হলুদ ও কাঁটানটে। তৃতীয় দলের উপরে হলুদ ও কেশুত প্রয়োগ করা হয়।
পাঁচ গবেষকের গবেষণাপত্রের দাবি: ৬০ দিন পরে দেখা যায়, সব ক’টি গরুর মল-মূত্রে আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়েছে। অন্য দিকে লোমে ও দুধে কমেছে আর্সেনিকের মাত্রা। গবেষকদের মতে, হলুদ-কেশুত-কাঁটানটে আর্সেনিকের কুপ্রভাব থেকে ডিএনএ-কে রক্ষা করেছে। আর্সেনিকের কুপ্রভাব প্রতিরোধে হলুদ ও কেশুত সবচেয়ে উপযোগী বলে তাঁরা মনে করছেন।
আর্সেনিকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই সব ভেষজ যে কার্যকরী হতে পারে, সে আন্দাজ ওঁরা পেলেন কোথায়?
প্রশান্তবাবুর ব্যাখ্যা: আয়ুর্বেদশাস্ত্রের বেশ কিছু জায়গায় রোগমুক্তির জন্য আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত উপাদান ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। আর সেখানেই বলা হয়েছে, ওই উপাদানের কুপ্রভাব কাটাতে হলুদ, কেশুত, কাঁটানটে প্রয়োগ করতে হবে। তা থেকেই ব্যাপারটা ওঁদের মাথায় আসে। বস্তুত আর্সেনিক গবেষকদের অনেকে বলছেন, খাদ্য-শৃঙ্খল মারফত গবাদি পশুর দেহে আর্সেনিক ঢুকে পড়াটা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। এর ফলে পশু-মাংস যেমন আর্সেনিক দূষণে জর্জরিত হয়, তেমন পশুর দুধ বিষাক্ত হয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায় রাজ্যের পাঁচ গবেষকের প্রচেষ্টা সফল হলে পশু-চিকিৎসার ক্ষেত্রে নতুন দিশা মিলবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এ-ও সত্যি, শুধু পশু-চিকিৎসার মাধ্যমে খাদ্য-শৃঙ্খলের আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। চাষের মাঠে আর্সেনিকের থাবা ঠেকাতেও নতুন ভাবনা জরুরি। খাদ্য-শৃঙ্খলে আর্সেনিকের দাপট রুখতে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপ্রদীপ সরকার ও তাঁর গবেষকদল কয়েকটি নিদান দিয়েছেন। কী রকম?
আইসিএআরের জন্য তৈরি সমীক্ষা-রিপোর্টে তাঁদের সুপারিশ: সব সময় নতুন জলে চাষ করতে হবে। এবং যতটা সম্ভব কম জলে। আর্সেনিকের মাত্রা কম হয়, এমন বিশেষ ধরনের ধানের চাষ করা ভাল। বিশেষত বোরো ধানের বদলে পেঁয়াজ, গম, ভুট্টা, ধনে কিংবা মুসুর ডাল চাষে উৎসাহ দিলে সঙ্কট অনেকটা প্রতিহত করা যেতে পারে। উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমিতে বোরো চাষ বন্ধ করার উপরেও জোর দেওয়া হয়েছে।
আর্সেনিকের বিপদ সম্পর্কে রাজ্য সরকারের কী বক্তব্য?
রাজ্যের আর্সেনিক টাস্ক ফোর্সের সদস্য তথা গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট দেবেন্দ্রনাথ গুহ মজুমদার বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে এখন ভূস্তরের উপরের জল শোধন করে সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু শুধু পানের জলকে আর্সেনিক-মুক্ত করে বিষের গ্রাস এড়ানো সম্ভব নয়। খাদ্যকে নিরাপদ করাও সমান প্রয়োজন। “ফসল ফলানো, মাছ চাষ ইত্যাদিতে ভূগর্ভের জল ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করা একান্ত জরুরি।” মন্তব্য দেবেন্দ্রনাথবাবুরও।
অর্থাৎ মূল সমস্যা লুকিয়ে আছে এক জায়গাতেই নির্বিচারে ভূগর্ভের জল তোলা। তাতে কবে দাঁড়ি পড়বে, সেটাই আসল প্রশ্ন।
যার কোনও জবাব আপাতত মজুত নেই কোনও মহলে।
(শেষ)