করোনা এমন কিছু বিধিনিষেধ, নিয়ন্ত্রণ, পরিবর্তন নিয়ে এল, যার কথা কেউ কখনও ভাবেনি আগে।
‘তালিয়াঁ বাজা কে, থালিয়া বাজা কে, ঘণ্টিয়া বাজা কে’ আমরা যেন আরেকটা জীবনে ঢুকে পড়েছিলাম, যা আমাদের নিজস্ব নয়। করোনা এমন কিছু বিধিনিষেধ, নিয়ন্ত্রণ, পরিবর্তন নিয়ে এল, যার কথা কখনও ভাবিনি আগে। এমন একটা জীবনের স্বপ্ন কেউ দেখে না, যেখানে নিজের ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় স্বাধীনতাটাই চুরি হয়ে যায়। কী রাষ্ট্রীয় জীবন, কী সামাজিক জীবন, কী ব্যক্তিজীবন— সর্বত্রই ইতিউতি আঁচড় বসিয়েছে করোনা। সেই আঁচড়ে আমূল বদলে গেল আমাদের যাপন।
বন্ধ হল বিমান চলাচল। বাস-ট্রাম-ট্রেনের চাকা থামল। চিকিৎসক, বিজ্ঞানীরা বললেন ‘তফাৎ যাও’! অন্তত দু’গজ। রাষ্ট্র বলল, সব বন্ধ। সভ্যতার মুখে মুখোশ পরিয়ে, অর্থনীতির পায়ে বেড়ি এঁটে ঘরে ঢুকে পড়ল গোটা বিশ্ব। আর আমাদের অভিধানে উজ্জ্বল হয়ে উঠল লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং, কন্টেনমেন্ট জোন, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, অনলাইন ক্লাস, মাস্ক, অক্সিমিটার, স্যানিটাইজারের মতো শব্দগুলো।
করোনার থাবা যেন সেই ইমার্জেন্সি ব্রেক। সভ্যতার দিকে ট্রাফিক পুলিশের মতো হাত তুলে বলল ‘থামো’! আর আচমকা সেই দৌড়বিরতি আমাদের যেন ভাববার একটা অবকাশ দিল। সেই অপ্রত্যাশিত পরিসরে নিজেদের দিকে তাকাবার ফুরসত পেলাম। অনুভব করলাম, সভ্যতাকে বাহুল্যে পরিণত করেছি। আদায় করে ফেলেছি প্রয়োজনের বেশি। চারপাশে আরাম, আয়েশ, স্বাচ্ছন্দ্যের নামে একটু একটু করে যে বিপুল আয়োজন আমরা করেছি, তার অনেকটাই অতিরিক্ত। হয়তো অধিকাংশই।
আগুনের আবিষ্কার সভ্যতাকে যদি প্রথম আলো দেখিয়ে থাকে, তবে চাকা দিয়েছিল গতি। অরণ্যচারী মানুষ দৌড়তে শুরু করেছিল। সেই দৌড়ই তফাত গড়েছিল অন্য সব প্রাণীর থেকে। তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিল। কিন্তু করোনা দেখিয়ে দিল, যতির আয়েশ ভুলে সেই দৌড় কোনও কোনও ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে আত্মঘাতী।
আর এই বিপুল আত্মোপলব্ধির অবকাশ দিল কোভিড-১৯ নামের এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস।
স্যান্ডো-বারমুডা-চাকি বেলনের সঙ্গে খোলা ল্যাপটপের দৃশ্য এখন অনেক বেশি ‘ইন থিং’।
বদলে যাওয়া যাপনের পরতে-পরতে সেই উপলব্ধিগুলো এখনও মুক্তোদানার মতো ছড়ানো। হাইরাইজের কার্পেট-মোড়া দামি ড্রইংরুম থেকে ঝোপড় পট্টির অপরিসর শ্বাসপ্রশ্বাসে। লকডাউন পর্বে দেখলাম, বাড়িতেও বহুবিধ সুস্বাদু খাবারদাবার বানানো সম্ভব। রেস্তরাঁর দ্বারস্থ না হলেও চলে। আর সেগুলো খুব সাধারণ উপাদানেই তৈরি করা সম্ভব। শুধু তা-ই নয়, বাড়ির সকলে মিলে তা বানানোয় যে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া যায়, অনেক নামীদামি খাবারেও সেই পরিতৃপ্তি পাওয়া বিরল। এই কয়েকটা মাস কি আমাদের ঘাড় ধরে শিখিয়ে দিয়ে গেল না, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন খুব বেশি নয়?
নিজের মতো করে বদলে যাওয়া যাপনটুকু সকলেই বোঝার চেষ্টা করেছেন। আট থেকে আশির অভিজ্ঞতাও আলাদা। এমনকি, পুরুষ-মহিলার অভিজ্ঞতাও ভিন্ন। অবশ্য স্বাভাবিক সময়ে সব বয়সের জীবনগুলো তো একরকম নয়। কিন্তু করোনা-কালে বদলটা হল চোখে পড়ার মতো। কাজকম্মের ধারা বদলে গেল। এল ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। এই সংস্কৃতিতে ঘরোয়া পরিবেশে কাজকর্মের ভাল দিক হল, পারিবারিক আবহের উষ্ণতাটুকু রেখেই কাজ করা যায়। বাসে-ট্রামে যাতায়াতের ঝক্কি নিতে হয় না। প্রতিষ্ঠানেরও খরচ বাঁচে। ইতিমধ্যে যে প্রতিষ্ঠানগুলির সুযোগ রয়েছে, করোনা পরবর্তী সময়ে তাদের অনেকেই ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে পুরোপুরি ভাবে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ ব্যবস্থায় চলে যাওয়ার। অর্থাৎ, চাকরি করা বলতে স্যুট-বুট-ব্রিফকেসের বা ফর্ম্যাল-স্নিকার-ব্যাকপ্যাক-এর পরিচিত দৃশ্যটাও বদলে গিয়েছে এই নিউ নর্মালে। স্যান্ডো-বারমুডা-চাকি বেলনের সঙ্গে খোলা ল্যাপটপের দৃশ্য এখন অনেক বেশি ‘ইন থিং’।
কিন্তু সে তো হোয়াইট কলার জবের। লকডাউন পর্বের সেই দৃশ্যটা মনে করুন। পরিযায়ী শ্রমিকরা দলে দলে মাইলের পর মাইল হাঁটছেন, মাথায় পুঁটলি। কিংবা রেললাইনে পড়ে থাকা কয়েকটা রুটি। করোনা তাঁদের থেকে চড়া মাসুল আদায় করেছে। তারপর বাড়ি ফিরে কর্মহীন অসহ্য যাপন। এ-ও তো এক পরিবর্তনই। কিন্তু কী নির্মম!
আরও পড়ুন: দিন যায়, রাত আসে, ডায়েরির পাতা ওল্টায় করোনা
পরিচিত বন্ধু সেদিন প্রশ্ন তুলছিলেন, অল্পবয়সিদের মধ্যে তাহলে কি ‘লভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ ব্যাপারটা উঠে গেল? কেননা মাস্ক পরে আর যাই হোক, প্রথম দর্শনে ভাল লেগে যাওয়ার যো নেই। শুধু তো তাই-ই নয়, পরকীয়ার পাটও উঠল বলে! বেপরোয়ারা কোনওক্রমে ভার্চুয়াল মোডে ব্যাপারটা টিকিয়ে রেখেছেন বটে। তবে সে তো ফুলস্ক্রিনের পরিবর্তে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সিনেমার টিকে থাকার মতো। মাঝখান থেকে হোয়্যাটসঅ্যাপে মস্করা গ্রুপে গ্রুপে ফরোয়ার্ড করা হচ্ছে। কারা যেন সব ১০ বছর, ২০ বছর আগে বিয়ে করা বউয়ের প্রেমে পড়েছেন। হনিমুনের পর এমন নিরবচ্ছিন্ন স্ত্রী সান্নিধ্য কবেই বা মিলেছে মধ্যবিত্তের! স্বাভাবিক ভাবেই বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি কিঞ্চিত ত্বরান্বিত হয়েছে। অন্তত পরিসংখ্যান তাই বলছে। সে প্রসঙ্গে অবশ্য ভিন্ন।
পুরোপুরি গৃহবন্দি দশা প্রবীণ প্রজন্মকে আরও নিঃসঙ্গ করেছে।
অনেককে হোম মেকারের কষ্ট নতুন করে চিনতেও শিখিয়েছে লকডাউন। সেটাই বা কম পাওয়া বলি কী করে! লকডাউনে অফিস-গোয়াররা রান্না শিখেছেন, ঘর গুছিয়েছেন মন দিয়ে। সংসারের কাজ ভাগাভাগি করে নেওয়া অন্যধরনের কমরেডশিপের জন্ম দেয়। ‘সহযোদ্ধা’ শব্দের মর্মোদ্ধার অনেক সহজ হয়ে যায় তখন। তবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এত ‘কোয়ালিটি টাইম’ অনেকের বদহজমও হয়েছে। আনলক পর্বে কড়াকড়ি কমতেই অনেকে বেরিয়ে পড়েছেন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে।
করোনাকালে কচিকাঁচাদের অভিজ্ঞতাটা একদম অন্যরকম। অনেকের সঙ্গে মিলেমিশে বেড়ে ওঠার মজাটাই বিলকুল সাফ। স্কুলের মাঠে দাপাদাপি নেই। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা নেই। মায়, পুলকারে খুনসুটি নেই। টিফিন ভাগ করে খাওয়া বন্ধ, শিক্ষিকার চোখ ফাঁকি দিয়ে বুকক্রিকেট খেলা বন্ধ। বদলে ঘরবন্দি শৈশব এখন গুগল মিট, জুম, মাইক্রোসফ্ট টিমের মতো প্রযুক্তি নির্ভর অনলাইন ক্লাস, অ্যাসেসমেন্টে অভ্যস্ত। তবে শিশু-কিশোরদের প্রাণপ্রাচুর্য সেই নিগড়েও ফাঁকফোকর খুঁজে নিয়েছে অতি দ্রুত। তা সে অনলাইনের ভিডিয়ো অফ করে ঘুমিয়ে পড়াই হোক বা সমান্তরাল অন্যও গ্যাজেটে বন্ধুদের সঙ্গে অনলাইন গেমে মত্ত হওয়া। কিন্তু এ সব আবারও স্বচ্ছলদের গল্প। স্কুল বন্ধ হওয়া ইস্তক দেশের কতগুলো স্কুলের পড়ুয়া এই ব্যবস্থার আওতায় এসেছে? বহু সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রী মোবাইলের অভাবে পিছিয়ে পড়েছে। অনেক স্কুলে এই ব্যবস্থা চালুই করা যায়নি।
তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে প্রবীণ প্রজন্ম। বিবিধ কো-মর্বিডিটি নিয়ে করোনা আবহে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যাপন তাঁদেরই। পুরোপুরি গৃহবন্দি দশা তাঁদের আরও নিঃসঙ্গ করেছে। এমনকি, নিয়মিত চেক-আপের জন্য যাবার আগেও দশবার ভাবতে হচ্ছে। তবু অনেকে মনে করছেন এই ভয়টা ভাল। করোনা আবহে গব্বর সিংহের ডায়লগটা বোধহয় নতুন করে লিখতে হবে— ‘যো ডর গয়া, সমঝো বচ গয়া’। তাকিয়ে দেখুন দক্ষিণ কোরিয়া আর আমেরিকার দিকে। দক্ষিণ কোরিয়া ভাইরাসটাকে সমীহ করেছিল বলেই কড়া নিয়মের মধ্যে তার নাগরিকদের প্রাণরক্ষা করতে পেরেছে। অন্যদিকে আমেরিকা আর তার প্রেসিডেন্টের বেপরোয়া আচরণের ফল ভুগতে হচ্ছে দেশবাসীকে। অর্থ, প্রাচুর্য, প্রযুক্তি— কোনওকিছুই শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। করোনা যেন প্রথমবিশ্বের কান মলে শিখিয়ে দিল সংযমের প্রয়োজনীয়তা।
ঘরবন্দি শৈশব এখন গুগল মিট, জুমের মতো প্রযুক্তি নির্ভর অনলাইন ক্লাস, অ্যাসেসমেন্টে অভ্যস্ত।
আশার কথা, করোনাকাল ফুরিয়ে আসছে। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে সংবাদ আসছে, তাতে এটা স্পষ্ট, কিছুদিনের মধ্যেই টিকা খোলাবাজারে পাওয়া যাবে। আগাম সতর্কতা হিসেবে টিকা নিয়ে হয়তো এড়ানো যাবে এই মারণ ভাইরাসকে। কিংবা অদূর ভবিষ্যতে ওষুধ বেরোবে। তখন আগাম সতর্কতার দরকার হবে না। উপসর্গ দেখা দিলে ওষুধ খেলেই হবে।
করোনা আমাদের যাপনে আমূল বিবর্তন ঘটিয়েছে— এমনটা জোর দিয়ে বলার সময় বোধহয় এখনও আসেনি। বরং করোনা সভ্যতার বুকে এক ধরনের ‘মিউটেশন’ ঘটিয়েছে। মিউটেশন যে ভাবে জিনে হঠাৎ করে একটা চিরস্থায়ী পরিবর্তন এঁকে দিয়ে যায়, এ যেন খানিকটা সেই রকম। কিছু কিছু পরিবর্তন আমাদের জীবনে হয়ত আগামিদিনেও থেকে যাবে।
ঝড় চলে গেলেও তার তাণ্ডবের চিহ্ন থেকে যায়। তার কিছু কিছু বেঁচে থাকে স্মৃতিচিহ্নের মতো।