mental health

দেশের ২০ কোটি মানুষ ভুগছেন নানা মানসিক সমস্যায়!

এ দেশে প্রতি ঘণ্টায় এক জন ছাত্র-সহ  দৈনিক ২৮ জন মানুষের মনের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে তাঁরা জীবনের অর্থ হারিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।

Advertisement

সুমা বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২০ ১২:৪৯
Share:

দ্রুত গতির যুগে মনের উপর চাপ বাড়ছে। ছবি: শাটারস্টক

সিবিআই-এর প্রাক্তন অধিকর্তা অশ্বিনী কুমার, বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিংহ রাজপুত বা বিহারে নিগৃহীত দলিত বালিকা কিংবা গুরুগ্রামের নার্সিং এর অধ্যাপক...তালিকাটা অনেক দীর্ঘ। এ দেশে প্রতি ঘণ্টায় এক জন ছাত্র-সহ দৈনিক ২৮ জন মানুষের মনের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে তাঁরা জীবনের অর্থ হারিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।

Advertisement

এ দিকে নভেল করোনা ভাইরাসের অতিমারিও চাপ বাড়াচ্ছে মনের উপর। ভাইরাসের কারসাজিতে বদলে যাচ্ছে নানা নিউরোট্র্যান্সমিটারের নিঃসরণ। বাড়ছে মন খারাপ আর অবসাদ। কোভিড পরবর্তী সময়ে মানসিক রোগের সমস্যা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘দ্য ল্যানসেট সাইকায়াট্রি জার্নাল’-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বলছে, ভারতের প্রায় ২০ কোটি মানুষ (১৯ কোটি ৭৩ লক্ষ) নানা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এঁদের মধ্যে আবার ৪.৫ কোটির উপরে মানুষ ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার ও ৪.৪ কোটি মানুষ অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারের শিকার। অথচ মনের অসুখ নিয়ে বেশিরভাগ মানুষের কোনও সচেতনতা নেই বললেই চলে।

মনের অসুখ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে আজ বিশ্বজুড়ে পালন করা হচ্ছে ‘মেন্টাল হেলথ ডে’ বা মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। সকলের মানসিক স্বাস্থ্য ও এই খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে পরিষেবা বাড়ানো। বিশ্বের প্রাচীনতম প্রামাণ্য ডাক্তারির বই অথর্ব বেদ এবং চরকের লেখা ডাক্তারি বই চরক সংহিতাতেও মনের অসুখের চিকিৎসার কথা লেখা আছে। ১২২২ সালে এক অজ্ঞাতনামা ইউনানি চিকিৎসকের লেখা বইয়ে মনের অসুখের চিকিৎসা হিসেবে সাইকোথেরাপির পদ্ধতি বর্ণনা করা আছে, ইউনানি পরিভাষায় তাকে বলে 'ইলাজ-ই-নাফসানি'।

Advertisement

আরও পড়ুন: নিউ নর্মালে গড়ে উঠেছে নতুন অভ্যাস, কোনটায় কী কী উপকার​

প্রাচীন আমলে সচেতনতা থাকলেও আজকের সাইবার যুগেও মনের অসুখকে গোপন করা বা চিকিৎসা করানোর সময়ও গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। এই চিন্তা ভাবনা বদলে ফেলার উদ্দেশ্য নিয়েই ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’ পালন করার পরিকল্পনা। মনের রোগ নিয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ’ ১৯৯২ সালে ১০ অক্টোবর দিনটিকে ‘ওয়ার্ল্ড মেন্টাল হেলথ ডে’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সেই থেকে প্রত্যেক বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এ দেশেও এই দিনটি পালন করা হচ্ছে।

এ বারের কোভিড অতিমারি পরিস্থিতিতে মনের চাপ বাড়ছে, এই ব্যাপারে নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট দেবাশিস রায় জানালেন যাঁদের মানসিক সহনশীলতা ও দৃঢ়তা তুলনামূলক ভাবে বেশি, তাঁদের মনের উপর চাপ পড়লেও নিজেরাই তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের সহনশীলতা তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। তাঁরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানসিক চাপ সহ্য করতে পারেন না। অহেতুক উদ্বেগ আর আতঙ্ক গ্রাস করায় দিশাহারা হয়ে পড়েন।

অনেক শারীরিক অসুখের মূলেও রয়েছে মনের সমস্যা। ফাইল ছবি।

দেবাশিস রায় জানালেন, যে সব মানুষের সহনশীলতা কম তাঁরা যে কোনও ঘটনা হলেই দিশাহারা হয়ে পড়েন। আর এই কারণেই করোনা অতিমারির নতুন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে গিয়ে অনেকেই স্ট্রেস ও অ্যাংজাইটির শিকার হচ্ছেন। মনের চাপ বাড়তে বাড়তে অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় চলে গিয়ে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। দেবাশিস বাবু জানান, বেশিরভাগ শারীরিক অসুখের মূলে মনের সমস্যা। চিকিৎসা বিজ্ঞান একে বলে সাইকোসোমাটিক ডিজঅর্ডার। মনের অসুখ হলে লুকিয়ে না রেখে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

আরও পড়ুন: কম্পিউটারে এক টানা কাজ, 'ভিশন সিনড্রোম' থেকে বাঁচতে এই সব মানতেই হবে

পথ দুর্ঘটনা বা অন্য শারীরিক সমস্যায় যেমন ফার্স্ট এড বা প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, মনের অসুখেও এর প্রয়োজন। পথ দুর্ঘটনায় চোট পেলে বা অজ্ঞান হয়ে গেলে চোখেমুখে জল দিয়ে দরকার হলে বুকে পাম্প করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়, ঠিক তেমনই মনের অসুখ হলেও অত্যন্ত সহানুভুতির সঙ্গে কথা বলের তাকে কিছুটা শান্ত করে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে আত্মীয়-স্বজন এবং কাছের বন্ধুদেরও।

দ্রুত গতির যুগে মানসিক চাপ খুব বেশি। এদিকে সার্স কোভ-২ ভাইরাসের প্রকোপে রোজকার জীবনযাত্রা আমূল বদলে গিয়েছে। অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। বেড়ে চলেছে মানসিক চাপ, অবসাদ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানে জানা গিয়েছে, স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যেও মনের অসুখ বাড়ছে। ২০% বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা যায়। ১৪ বছর বয়সের মধ্যে ৫০% এবং ২৪ বছর বয়সে ৭৫% মনের অসুখ ধরা পড়ে। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের ৭০% ক্ষেত্রে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে কোনও না কোনও সময় মানসিক সমস্যা দেখা যায়। বাবা-মা কিংবা স্কুল শিক্ষকরা তা বুঝতে না পেরে বকাবকি আর মারধর করলে সমস্যা বেড়ে গিয়ে আত্মহনন পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে।

আরও পড়ুন: ঘরবন্দি বাচ্চা বুঁদ টিভি-মোবাইলে, সামলাতে কী কী করতেই হবে

বিভিন্ন মনের অসুখের মধ্যে রয়েছে অ্যাংজাইটি, অবসাদ, ইটিং ডিজঅর্ডার, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, স্কিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মনের অসুখের উপসর্গ হিসেবে চুপচাপ বসে থাকা, চিৎকার চেঁচামেচি, জিনিসপত্র ভাঙচুর, মারধর ও আত্মহত্যার কথা বলা ও চেষ্টা করা ইত্যাদি দেখা যায়। এমন হলে অবশ্যই মনের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। সঙ্গে দরকার সচেতনতা ও সহনশীলতা। মনের অসুখ দূরে সরিয়ে রাখার কয়েকটি টিপস দিলেন মনোরোগ চিকিৎসক দেবাশিস রায় ও স্মরণিকা ত্রিপাঠী।

আরও পড়ুন:সব সময় শাসন নয়, ‘স্পেস’ দিন শিশুদেরও

মনের কষ্ট চেপে রাখা উচিত নয়। বন্ধু বা ভাই বোনকে খুলে বলা উচিত। কাছের মানুষদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিলে যেমন আনন্দ বহুগুণ বেড়ে যায়, তেমনই দুঃখ ভাগ করে নিলে দুঃখ অনেক কমে যায়।

বিশ্বে অর্ধেকেরও বেশি মানসিক অসুখের সূত্রপাত বয়ঃসন্ধিকালে। ছবি: শাটারস্টক।

রাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় থাকতে গিয়ে ঘুমের সময় কমে গিয়েছে। কম ঘুম হলে মনের উপর চাপ বাড়ে। সকলের ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম জরুরি। সঠিক ডায়েট মন ভাল রাখতে সাহায্য করে। তাই সুষম খাবার খেতে হবে। মা, বাবা, ঠাকুরমা, ঠাকুরদা, ভাই-বোন আর ভাল বন্ধুদের সঙ্গে দিনের কিছুটা সময় কাটালে মন ভাল থাকবে। মোবাইলে চ্যাট না করে কথা বললে মন ভাল থাকে। নিয়মিত শরীরচর্চা করে ওজন ঠিক রাখতে হবে। ওজন বাড়লে অবসাদ বাড়ে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট সময় নিজের জন্যে রাখতে হবে। ভাল বই পড়া, গান শোনা বা পোষ্যের সঙ্গে সময় কাটালে ভাল লাগবে। ভার্চুয়াল জগতের বদলে নিজের চারপাশের গাছপালা বা পাখি অথবা প্রাণীদের দিকে মন দিলেও ফল মিলবে। ভাল থাকতে হবে শরীরে ও মনে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement