ক্যানসারের হানা রুখতে সচেতনতা অন্যতম অস্ত্র। ছবি: শাটারস্টক।
লাফিয়ে বাড়ছে সংখ্যাটা। ২০১৮-তে আমাদের দেশে যা ২৫ লক্ষে দাঁড়িয়েছিল, সেই সংখ্যাই বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৯ লক্ষে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের দাবি, প্রতি দিন প্রায় ১৩০০ জন মারা যান এই রোগে। ক্যানসার। একটা সময় পর্যন্ত এর কোনও অ্যানসার ছিল না। কিন্তু আজ অসুখের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ে যাচ্ছেন বহু ক্যানসার আক্রান্ত। আধুনিক চিকিৎসা, নিয়মে থেকে রোগকে মুখের মতো জবাব দিচ্ছেন তাঁরা। তবু সংখ্যা বেড়েই চলেছে উত্তরোত্তর।
ক্যানসারের সঙ্গে সহবাস করা মানুষদের গড় বয়সটাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমছে। একটা সময় ছিল যখন ক্যানসার আক্রান্তদের গড় বয়স ধরা হত ৪০ থেকে ৭০। তা ২০১৮-য় কমে দাঁড়ায় ৩০-৬৯। যার মানে, ক্যানসার আক্রমণের শিকার হচ্ছেন কমবয়সীরাও। সুতরাং যুবা বয়স থেকে শেখা যাওয়া উচিত সচেতনতার পাঠ।
মেয়েদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যানসার, ছেলেদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের প্রবণতা বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই হারে অসুখ বাড়তে থাকলে বিগত ৫ বছরের মধ্যে প্রতি ঘরে এক জন করে ক্যানসার আক্রান্ত থাকবেন।
আরও পড়ুন: এই এসেনশিয়াল অয়েলেই নিয়ন্ত্রণে থাকে কোলেস্টেরল, সুস্থ থাকতে ডায়েটে রাখুন এ ভাবে
ক্যানসার দিবসের শপথ
‘আই অ্যাম অ্যন্ড আই উইল’। আমি এবং আমিই পারবই এই যুদ্ধে সফল হতে। ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত এটাই ক্যানসার দিবসের থিম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আইএআরসি অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার মিলে ওয়ার্ল্ড ক্যানসার ডে পালন করে। ৪ ফেব্রুয়ারি গোটা বিশ্ব জুড়েই পালিত হয় এই দিন।
ক্যানসার ঠেকাতে কিছু বিশেষ বিষয়ে নজর রাখাটা খুব জরুরি।
বাড়তি ওজন ভয়ের
ক্যানসার কোনও একটি নির্দিষ্ট কারণে হয় না। বরং এটি ‘মাল্টি ফ্যাকটোরিয়াল ডিজিজ’। তবে নানা সমীক্ষায় উঠে এসেছে, শরীরের বাড়তি মেদ ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড, তেল-মশলার খাবার, রেড মিট, ডিপ ফ্রায়েড স্ন্যাক্স, পশুর চর্বি, অতিরিক্ত ময়দা ও চিনি খেলে ওজন যেমন তরতরিয়ে বাড়ে, তেমনই ক্যানসারের দিকে এগিয়ে যায় শরীর। ওজন বাড়লে এত রকম জটিলতা শুরু হয় যে শরীর থেকে অসুখ সরানো মুশকিল হয়ে পড়ে। কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির অন্য কারণ বাড়তি ওজন। আর যে কোনও কোষের অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধিই ক্যানসারের অন্যতম কারণ। ওজন ঠিক রাখতে অবশ্যই প্রয়োজনীয় শরীরচর্চা বা হাঁটাহাঁটিকে যোগ করতে হবে রুটিনে। ডায়েটকেও সাজাতে হবে স্বাস্থ্যকর উপায়ে।
আরও পড়ুন: সর্দি-কাশি করোনাভাইরাসের প্রধান লক্ষণ, ঋতু পরিবর্তনের সময় এ সব ঘরোয়া উপায়ে ঠেকান অসুখ
তামাকের সঙ্গে আড়ি
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ভারতীয়রা যে সব ক্যানসারে বেশি আক্রান্ত হয়, তার নেপথ্যে রয়েছে তামাকের জারিজুরি। সিগারেট, বিড়ি, গুটখা, খৈনি সহ যাবতীয় তামাক ক্যানসার ডেকে আনে। শুধু ফুসফুস নয়, মুখের ভিতরকেও সুরক্ষা দিতে আজই ছাড়তে হবে এ সব। অনেকেই তামাক ছেড়ে ফের ধরেন। এতে ক্ষতি কমে না এতটুকু। প্রতি বার ধোঁয়া টানার সঙ্গে শরীরে কার্বন ও নিকোটিন জমে জমে ঠেলে দেয় ক্যানসারের ঘরে।
চিনি কম, জল-দই বেশি
নিয়ম দিনে তিন-চার লিটার জল খাওয়া। কিন্তু সে আর ক’জন পারেন? এক এক জনের শরীর অনুযায়ী এই জলের চাহিদা কম-বেশি হয়। তাই শরীরে কতটুকু জল প্রতি দিন প্রয়োজন তা চিকিৎসকের থেকে জেনে সেই অনুযায়ী জলের মাত্রা বজায় রাখুন। যত বেশি জল শরীর পাবে, ততই টক্সিন বার করে দিতে পারবে শরীর থেকে। শরীরকে ডিটক্সিফাই করে টক দই। তাই ওটা যেন রোজ থাকে খাবার পাতে।
চিনির ব্যবহারে ক্যানসার বাড়ে কি না এ নিয়ে দেশ-বিদেসে বিভিন্ন গবেষণা চলছে। এখনও নিশ্চিত করে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো না গেলেও চিনি খাওয়ায় রাশ টানতেই বলছে আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি। চিনির কার্বন শরীকে ক্যানসারের বীজ বুনতে সাহায্য করে। চিনি না পেলে কোনও কোষই ভাঙতে পারে না। তাই চিনির বদলে বরং গুড়ের বাতাসা, মধু, নারকেলের চিনি এ সব দিন রান্নায়।
কোন কোন খাবারে ঝুঁকি? খাব কী কী?
তেল-মশলাদার খাবারের পাশাপাশি প্রিজারভেটিভ যোগ করা বা রং করা খাবার থেকে দূরে থাকুন। বিরিয়ানি বা রং মেশানো পোলাও নয়, বরং রং বাদ দিয়ে খান সে সব খাবার। একান্ত না পারলে বাড়িতেই বানিয়ে খান। ফাস্ট ফুড কমানোর পাশাপাশি খেয়াল রাখুন অতিরিক্ত মিষ্টিও যেন শরীরে না যায়। রেড মিট কমিয়ে হোয়াইট মিট খান। ডায়েটে রাখুন সবুজ শাকসব্জি, গাজর, লাউ, ব্রকোলি, বিট, কুমড়ো এ সব খাবার। এদের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট শরীরে রোগ প্রতিরোধ করা পাশাপাশি ক্যানসারের সঙ্গে লড়তে পারে।
টেনশনকে টা টা বলুন
লেখা সহজ। বলা সহজ নয়। ঠিকই। তবু শরীরের প্রয়োজনেই এটুকু রপ্ত করতে হবে। চারপাশের বিবিধ দুশ্চিন্তাকে কিছুতেই মাথায় চড়তে দেওয়া যাবে না। টেনশন আসবেই। তাকে প্রয়োজনীয় সময় ও বুদ্ধি দিয়ে কাটিয়ে উঠুন। মন শান্ত রাখতে দরকারে প্রাণায়ামের অভ্যাস রাখুন। পরিস্থিতি জটিল হলে মনোবিদের সাহায্য নিন। কিন্তু কিছুতেই টেনশন নয়! শরীর যাতে পর্যাপ্ত ঘুমটুকু পায়, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
মিথ ভাঙুন আজই
এখনও অনেকের ধারণা এমএম রুদনেভ ভুল ছিলেন। কে রুদনেভ? না, তিনিই প্রথম বায়োপসি করে জটিল অসুখ নির্ণয়ের পদ্ধতি হাতেকলমে দেখান। সাল ১৮৭৫। সেই বায়োপসি আজ বিভিন্ন অসুখ নির্ণয়ের অস্ত্র। ত্বকের বিভিন্ন অসুখ, টিবি, টিউমারের গ্রোথ সব বুঝতেই বায়োপসি করা হয়। অথচ এক শ্রেণির মানুষের ধারণা বায়োপসি করলেই ক্যানসার আক্রান্ত কোষে নাড়াচাড়া পড়ে আর শরীরে চড়িয়ে পড়ে ক্যানসার। এ ধারণা একেবারে ভুয়ো। বরং বায়োপসিতেই একমাত্র বৈজ্ঞানিক ভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। যত দ্রুত অসুখ ধার পড়বে, ততই রোগমুক্তির পথে এগনো যাবে সফল ভাবে।