Women Rights

‘সন্তানধারণ করবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত মেয়েরা নিজেরাই নিতে পারবেন’

বিবাহিতই হোন অথবা অবিবাহিত, সব মহিলারই অধিকার আছে গর্ভপাতের। বৃহস্পতিবার এই রায় দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তাকে কী চোখে দেখছেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নাগরিকেরা?

Advertisement
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭:২৬
Share:

ফাইল ছবি

শুভশ্রী পাল

Advertisement

স্কুলশিক্ষিকা

দেরিতে হলেও এই রায় মেয়েদের ক্ষেত্রে আশার আলো দেখাচ্ছে। এটা নিয়ে আরও আগে আলোচনা হওয়া উচিত ছিল। পাশাপাশি, বৈবাহিক ধর্ষণকেও যে ধর্ষণ হিসাবে গণ্য করেছে সুপ্রিম কোর্ট, তাতে অনেক মেয়ে যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলার সাহস পাবেন। অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের দোহাই দিয়ে তাঁকে আর অসুস্থ সম্পর্ক বা অত্যাচারী স্বামীর সঙ্গে থাকতে বাধ্য করা যাবে না। আর একটা কথা। এই রায়ের ফলে সব মেয়েদের ক্ষমতায়ন হবে বলে মনে করি। কারণ বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ভাল না থাকলেও অনেক মেয়েই বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির চাপে সন্তানধারণে বাধ্য হন। কিন্তু গর্ভপাতের আইনি অধিকার পেলে তাঁরা সন্তানধারণ করবেন কি করবেন না, সেই সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারবেন।

Advertisement

সুদেষ্ণা রায়

চেয়ারপার্সন, শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন

২০১৭ সালে আমরা একটি কেস পেয়েছিলাম, যেখানে নাবালিকা মায়ের বয়স ছিল ১২ বছর। সে তার পরিবারের মধ্যেই একাধিক বার যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ায় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল। পরে মেয়েটি এক সন্তানের জন্ম দেয়। পুরো ব্যাপারটা ঘটে যায় কমিশনের নজরে আসার আগেই। তাই সে ক্ষেত্রে গর্ভপাত করা বা না করা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা ছিল না। তবে সাধারণ ভাবে নাবালিকা বিয়ে কিংবা ধর্ষণের ঘটনায় মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে এই আইন রক্ষাকবচ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু তখনও মনে রাখতে হবে, নাবালিকা মায়ের গর্ভপাত করানো হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত আমাদের, অর্থাৎ কমিশনের হাতে থাকে না। আমরা পুরো ব্যাপারটা খতিয়ে দেখি, মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়। সব চেয়ে বড় কথা, গর্ভবতী মা সন্তানের জন্ম দিতে চাইছেন কি না, সেটা দেখা ভীষণ জরুরি। এই রায় তো শুধু নাবালিকাদের জন্য নয়, সব মেয়েদের জন্যই। অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। একই সঙ্গে গর্ভপাতের সময়সীমা বাড়িয়ে ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত করায় অবিবাহিত মেয়েরা এমন সিদ্ধান্ত নিতে আরও বেশি সময় পাবে। কেন না, এই ধরনের নিগ্রহের ঘটনায় নাবালিকা যে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে সেটা জানতেই অনেক সময় চলে যায়। দ্বিতীয়ত, সুপ্রিম কোর্ট বৈবাহিক ধর্ষণকেও যে ধর্ষণ হিসাবে মান্যতা দিয়েছে, সেটাও মেয়েদের জন্য বড় জয়।

স্বাতী গুহ

অধিকর্ত্রী, ইনস্টিটিউট অব ল্যাঙ্গোয়েজ স্টাডিজ় অ্যান্ড রিসার্চ

অত্যন্ত সময়োপযোগী রায়। অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে এত দিন এমন ভাব ছিল যে, বিয়ে না করেই গর্ভে সন্তান এলে তারা সমাজে নিন্দা আর বিদ্রুপের মুখে পড়বে। কিন্তু একটি মেয়ের শারীরিক বা মানসিক উন্নতির জন্য গর্ভপাত প্রয়োজন কি না, সেটা কেউ ভেবে দেখতেন না। এ বার গর্ভপাত আইনি বৈধতা পাওয়ায় মেয়েরা নিজেদের অধিকারের কথা মুখ ফুটে বলতে পারবেন। এটা তো গেল অবিবাহিত মেয়েদের দিকটি। বিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রেও এত দিন পর্যন্ত গর্ভধারণের স্বাধীনতা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা হত না। অনেক সময়েই বৈবাহিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে। সে ক্ষেত্রে মেয়েটিকে অবাঞ্ছিত গর্ভসঞ্চার বয়ে বেড়াতে হয়। আবার অনেক সময়ে দেখা যায়, মেয়েটি হয়তো আরও পড়াশোনা করতে আগ্রহী বা কাজের চাপে তিনি তখন গর্ভবতী হতে চাইছেন না। অথচ, বাড়ি বা পরিজনেদের চাপে তাঁকে বাধ্য হয়ে সেই পথ বাছতে হয়। এমন সব ক্ষেত্রে শীর্ষ আদালতের এই রায় মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার পথে অনেকটাই সহায়ক হবে বলে মনে করি।

ফারহা খাতুন

চলচ্চিত্র পরিচালক

সব ধরনের, সব বয়সের মহিলাদের জন্য সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণ খুব জরুরি। এত দিন পর্যন্ত মেয়েদের যৌনতার অর্থই ছিল হয় বিয়ে কিংবা সন্তানধারণের দিকে নিয়ে যাওয়া। যৌনতায় মেয়েদের শারীরিক, মানসিক অধিকার বা আনন্দ থাকত গুরুত্বহীন। এ বার মেয়েরা নিজেদের শরীরের উপরে অধিকার সুনিশ্চিত করতে পারবেন বলে মনে করি। তবে এর উল্টো পিঠেও নজর দেওয়া জরুরি। তা হল, এই রায়কে পুরুষেরা যেন আবার তাঁদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার না করেন। কেউ যেন ভেবে না বসেন, মেয়েটির গর্ভপাত যখন করানোই যাবে, তখন কোনও রকম সুরক্ষা ছাড়া যৌন সংসর্গে লিপ্ত হলেই হল। মনে রাখতে হবে, গর্ভপাত খুব সহজ প্রক্রিয়া নয় এবং এতে মেয়েটির শরীর-মনের উপরে মারাত্মক ধকল পড়ে।

মঞ্জরী চট্টোপাধ্যায়

স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক

সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে সাধুবাদ। গর্ভপাতের আইনি অধিকার পাওয়া মেয়েদের সামাজিক অবস্থানের জন্য যেমন জরুরি, তেমনই তাঁদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যও ভীষণ ভাবে বলবৎ হওয়া প্রয়োজন। এত দিন পর্যন্ত গর্ভপাতের সময়সীমা ছিল ২০ সপ্তাহ। তা বাড়ানোয় চিকিৎসকদের অনেক সুবিধা হল। কারণ, ভ্রূণের শারীরিক গঠন, বিভিন্ন অঙ্গ ঠিক আছে কি না— সেগুলি পরীক্ষা করে জানতে জানতেই ২০ সপ্তাহ পেরিয়ে যেত। ফলে, ভ্রূণের গঠনগত ত্রুটি থাকলেও আর গর্ভপাত করানো যেত না। তা ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৈবাহিক ধর্ষণ কিংবা ‘আনওয়ান্টেড প্রেগন্যান্সি’ ধরা পড়তেই অনেক সময় লেগে যায়। তত দিনে গর্ভপাতের সময় পেরিয়ে যায়। সেই অসুবিধাও থাকল না। অন্য দিকে, অবিবাহিত অনেক মেয়েই এত দিন হাতুড়েদের কাছে গিয়ে গর্ভপাত করানোয় তাদের প্রাণসংশয় হত। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সেই সমস্যাও থাকবে না। তবে এই আইনের অপব্যবহার ঠেকানোও জরুরি। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ কিংবা অন্য কোনও কারণে এই আইনকে যেন মেয়েদের স্বাধিকারের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো না হয়।

সাক্ষাৎকার: চৈতালি বিশ্বাস

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement