Women's Day

International Women’s Day 2022: নারী দিবস পালন করব কেন? এখনও কেন মেয়েদের জন্য আলাদা দিন রাখা জরুরি

মেয়েরা তো সব সুযোগই পাচ্ছে। আবার আলাদা করে নারী দিবস কেন পালন করতে হবে? এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজল আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২২ ০৭:১১
Share:

যত দিন সমাজ চোখ রাঙিয়ে বলবে ‘মেয়েরা তো সবই পাচ্ছে’, ততদিন কি কোনও ভাবে প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে নারী দিবস? ছবি: শৌভিক দেবনাথ

প্রশ্ন ওঠে। বার বার। বলা হয়, মেয়েরা তো সব সুযোগই পাচ্ছে। নিজের ইচ্ছামতো সাজছে। বাইরে যাচ্ছে। কাজ করছে। আয় করছে। খাচ্ছেদাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে আবার ‘নারী দিবস’ আলাদা করে কেন? এ বার তো পুরুষ দিবসে জোর দিতে হবে, না কি!

Advertisement

কখনও খেলার ছলে, কখনও গম্ভীর স্বরে এ সব প্রসঙ্গ উঠতেই থাকে। নারী দিবসের উচ্চারণ বিকৃত করে ব্যঙ্গ করা হয় ‘নারী দি বস্‌’ হতে চায় বলে। মেয়েদের চাহিদার বুঝি শেষ নেই, এমনও প্রসঙ্গ ওঠে।

এমন সব কথার মাঝে হয়তো বা কোনও কোনও নারীও নিজেকে হারিয়েও ফেলতে বাধ্য হন। নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে বেড়ান। সত্যি কি তবে এখন আর প্রয়োজন নেই নারী দিবস পালন করার, মনে মনে হয়তো বা প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু এ কথা কি ভুললে চলে যে, যত দিন এ সব ব্যঙ্গ, টিপ্পনী উড়ে আসতে থাকবে, তত দিন পর্যন্ত কোনও ভাবেই প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারবে না ‘নারী দিবস’। বরং রোজ নতুন নতুন ভাবে প্রয়োজন পড়ে এই দিনটির। কারণ, এমন ব্যঙ্গের ভাঁজেই যে লুকিয়ে থাকে বৈষম্যের বীজ।

Advertisement

‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস’ পালনের প্রাসঙ্গিকতা গুলিয়ে যাওয়ার কারণ আরও রয়েছে। চারদিকে যে এই দিনটি আরও পাঁচটি উৎসবের দিন হিসাবেই ধরে নিয়েছে বিপণন দুনিয়া। কোথাও নারী দিবসের ছাড়, কোথাও নারী দিবসের বিশেষ প্রসাধনীর বিজ্ঞাপন। এ সবের মাঝে ঢাকা পড়তে থাকে এই দিন পালন করার আসল উদ্দেশ্য।

নারী দিবসের উচ্চারণ বিকৃত করে ব্যঙ্গ করা হয় ‘নারী দি বস্‌’ হতে চায় বলে। মেয়েদের চাহিদার বুঝি শেষ নেই, এমনও প্রসঙ্গ ওঠে।

কিন্তু শতবর্ষ আগে যখন আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস পালন করা শুরু হয়, তখন উঠেছিল সমান অধিকারের প্রশ্ন। সেই প্রশ্ন কি এখন অপ্রাসঙ্গিক? যত দিন সমাজ চোখ রাঙিয়ে বলবে ‘মেয়েরা তো সবই পাচ্ছে’, ততদিন কি কোনও ভাবে প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে নারী দিবস? নারী আন্দোলন কর্মী অনুরাধা কপূর বরং মনে করেন, নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্নটিই আসলে অপ্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, ‘‘নারী আন্দোলন কত দূর এগিয়েছে, আরও কত দূর যেতে হবে, এই দিন তা ভেবে দেখার জন্য। নারী দিবস সমাজের একাংশের জন্য বাণিজ্যিক হয়ে গিয়েছে বটে, কিন্তু তাতে নারী আন্দোলনের প্রয়োজন তো কমেনি। এখনও কোনও একটি দেশেও মেয়েরা সমান অধিকার অর্জন করতে পারেননি। রাজনৈতিক ভাবে মেয়েদের অবস্থান দেখলে বুঝবেন, লড়াই এখনও অনেক বাকি। আর যত দিন না সমাজে মেয়েদের অবস্থান সব দিক থেকে সম্মানজনক হবে, তত দিন তো নারী দিবসও প্রাসঙ্গিক থাকবে।’’ কথায় কথায় বলা হয় মেয়েরা এখন অনেক এগিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু কত জন নারী সত্যিই ক্ষমতায় আছেন, প্রশ্ন তুলছেন অনুরাধা। আরও যাঁরা কর্মক্ষেত্রে ক্ষমতা অর্জন করেছেন, তাঁদের কি সামাজিক অবস্থানে যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে? অনুরাধা মনে করান, ‘‘বাইরে হয়তো একই ধরনের কাজ করছেন, কিন্তু বাড়ির ভিতরে এসে এক জন পুরুষ ও এক নারীর অবস্থান একেবারে আলাদা। মেয়েরা উচ্চ পদে কাজ করলে প্রশ্ন ওঠে তিনি পরিবারকে যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন কি না, তা নিয়ে। অথচ সমান পদে কাজ করা এক জন পুরুষের ক্ষেত্রে সে প্রশ্ন কখনওই ওঠে না।’’

সমাজকর্মী দোলন গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ‘‘নারী দিবসের ক্ষেত্রেই শুধু কেন প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে? স্বাধীনতা দিবসের ক্ষেত্রে তো ওঠে না! স্বাধীনতা দিবসের যেমন ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে, নারী দিবসেরও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে।’’ এই দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ভুলে গেলে কী করে চলবে? শ্রমবাহিনীতে ক’জন মহিলা আছেন, সে কথা মনে রাখেন না কি কেউ? প্রশ্ন তোলেন দোলন। তিনি জানাচ্ছেন, শ্রমবাহিনীতে মেয়েদের অংশগ্রহণ ক্রমশ কমছে। এখন শ্রমবাহিনীর মাত্র ১৮ শতাংশ হল নারী। গত দশ বছর আগেও যা ছিল ৩৫-৩৬ শতাংশ। দোলন বলেন, ‘‘এই উপমহাদেশে শ্রমবাহিনীতে মেয়েদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে কম ভারতে। পাকিস্তানের থেকেও এখানে কম। তা ছাড়া অধিকারের বৈষম্য তো রয়েছে শিক্ষা থেকে সংসার, সব ক্ষেত্রেই।’’

‘মেয়েরা সব পাচ্ছে’ বলে যাতে আড়াল না করা যায় অধিকারের প্রয়োজনীয়তা, অত্যাচারের অশ্লীলতা, সে কথা মনে করাতে পারে নারী দিবস।

আর শুধু কি অধিকার? অত্যাচারের কথাও যে ভাবতে হবে। সময়ের সঙ্গে কি কোনও অংশে কমেছে মেয়েদের উপর অত্যাচার। নির্ভয়া কাণ্ড, হাথরসের নির্যাতন, কামদুনির ধর্ষণের মতো কিছু ঘটনা শিরনামে আসে। বাকি বহু ঘটনা চাপা পড়ে যায়। কিন্তু কোথাও না কোথাও প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে নির্যাতন। এরই পাশাপাশি চলে আসছে কর্মক্ষেত্রে অত্যাচার, গার্হস্থ্য হিংসা। সব ক্ষেত্রেই যুঝতে হচ্ছে মেয়েদের। মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘সভ্যতা যতই এগোক, প্রযুক্তি যতই উন্নততর হোক, সমাজে মেয়েদের সার্বিক স্থান রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরেই! ভাইরাস যেমন নানা রূপে, নানা আকারে নিজেকে মিউটেট করে, তেমন ভাবেই নানা আকারে নিজেকে প্রকাশ করছে পুরুষতান্ত্রিকতা। সভ্যতা কখনও কোনও পরিস্থিতিতেই মেয়েদের উপর নির্যাতন কমাবে না।’’ আর এই কারণেই নারী আন্দোলন ও নারী দিবসের প্রয়োজনীয়তা, প্রাসঙ্গিকতা থেকে যাবে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আধুনিকতার মধ্যেই হিংসা লুকিয়ে আছে। সমাজ যত আধুনিক হবে, হিংসাও তত বাড়বে। দিল্লির গণধর্ষণের কথাই ধরা যাক। হিংসা প্রকাশের ভঙ্গি সংগঠিত হয় সভ্যতার সঙ্গে। সমাজ যত এগোবে, তত হিংস্র হবে সমাজ।’’ এ সবের রেশ মেয়েদের উপর এসেই পড়বে, মনে করান রত্নাবলী। আর এমন সব ঘটনার সঙ্গে যুঝতে নারী আন্দোলন চলতে থাকবে। মেয়েরা নিজেদের কথা যত বলুন, তাঁদেরও বলার পরিসর আরও বাড়াতে হবে। তাই আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের মতো একটি দিন জরুরিও থাকে বলে মত রত্নাবলীর।

‘মেয়েরা সব পাচ্ছে’ বলে যাতে আড়াল না করা যায় অধিকারের প্রয়োজনীয়তা, অত্যাচারের অশ্লীলতা, সে কথা মনে করাতে পারে নারী দিবস। আরও কত দূর চলা বাকি, সে আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে সক্ষম এমন দিন। লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাই এখনও প্রাসঙ্গিকতা হারানোর সুযোগ পায় না আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement