গত কয়েক দিন ধরে বেশ কয়েকটি আত্মহত্যার খবর এসেছে শিরোনামে। একই পেশায় পরপর এমন আত্মহত্যার ঘটনা বিরল নয়। একে চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় বলে ‘সুইসাইড কন্টাজিয়ন’। সংক্রামক রোগের মতোই তা আশপাশের মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। যদি সেই চেনটা আমরা ভেঙে দিতে পারি, তা হলে অনেক মানুষকেই হয়তো বাঁচানো সম্ভব হবে। কিন্তু তার জন্য দরকার সচেতনতা। যে মানুষটি অবসাদে ভুগছেন, তাঁর সময়মতো ঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন। শারীরিক রোগব্যাধি সারানোর মতোই মানসিক রোগ সারানোর জন্যও পরামর্শ নিতে হবে বিশেষজ্ঞের।
সুইসাইড কি সংক্রামক?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়রঞ্জন রাম বলছেন, ‘‘হয়তো কেউ অবসাদে ভুগছেন, মৃত্যুর কথা ভাবছেন। এই অবসাদ নিয়েই হয়তো দু’-তিন মাস চলছেন। এ বার যদি তাঁর পরিচিত বৃত্তের কেউ বা নামকরা কেউ বা সিরিয়ালের কোনও চরিত্র, খবরের কোনও ঘটনায় কাউকে আত্মহত্যা করতে দেখেন, সেই খবর তাঁদের জন্য ট্রিগারের মতো কাজ করে। সেই ব্যক্তির সঙ্গে তখন অবসাদগ্রস্ত মানুষটি আইডেন্টিফাই করতে শুরু করেন। কিন্তু আত্মহত্যা কোনও সমাধান নয়, সেটা আগে বুঝতে হবে। অনেক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বহু মানুষ লড়াই করছেন। সেগুলো ভাবতে হবে। আর অবসাদের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই সচেতন হতে হবে।’’ সময় থাকতে মানুষটিকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
কী-কী লক্ষণে সচেতন হবেন?
আইআইটি খড়গপুরের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট দেবারতি আচার্যও কিছু সাইন নিয়ে আলোচনা করলেন। তাঁর কথায়, ‘‘আত্মহত্যা করার আগে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু সাইন দেখায়। হয়তো খুব মিশুকে মানুষ বাইরে মেলামেশা বন্ধ করে দিলেন। ইদানীং সোশ্যাল সাইটে নজর রাখলে তা আরও ভাল বোঝা যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব অ্যাক্টিভ একজন হয়তো হঠাৎ পুরোপুরি অফ হয়ে গেলেন। অনেকে আবার নিজের ধার মেটাতে শুরু করেন। অনেকে তাঁর প্রিয় জিনিসগুলো বন্ধুদের, ভাই-বোনদের দিয়ে দিতে শুরু করেন। যে জিনিসটা ছাড়া তিনি হয়তো থাকতেই পারতেন না, হঠাৎ দেখা গেল সেই জিনিসটাই তিনি কাউকে দিয়ে দিচ্ছেন। এমনও হতে দেখা যায়, যে কাজগুলো মানুষটা উপভোগ করতেন, সেগুলোয় আর কোনও আগ্রহ পাচ্ছেন না। হয়তো কেউ আঁকতে বা গাইতে ভালবাসতেন, এখন আঁকা-গান কোনও কিছু করতেই ভাল লাগছে না। এগুলিও সাইন। পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কেউ এমন কিছু দেখলে অবশ্যই রিপোর্ট করা দরকার।’’
ডা. জয়রঞ্জন রাম আর একটি দিকে নজর রাখতে বললেন। ‘‘কেউ যদি মরে যাওয়ার কথা বলেন, সেটা কিন্তু গুরুত্ব দিতে হবে। কেউ যদি বলেন যে, ‘বেঁচে থেকে আর লাভ নেই’ বা ‘মরে গেলেই ভাল’, তখন সচেতন হতে হবে। প্রফেশনালদের সাহায্য নিতে হবে। মনের মধ্যে এ রকম নেতিবাচক চিন্তা চলছে বলেই কিন্তু সে কথাটা বলছে। অনেক সময়ে তাঁরা এ রকম সাইনের মাধ্যমে সাহায্য চান। কেউ যদি হাত-পা কাটার মতো সেল্ফ-ইনজুরি করেন, সে ক্ষেত্রেও সতর্ক হন।”
খাওয়া ও ঘুম কমে যেতে পারে। শারীরিক রোগবালাই ছাড়া হঠাৎ যদি কারও অনেকটা ওজন কমে যায়, সেটাও একটা ইন্ডিকেশন। আরও ইঙ্গিত পাবেন মানুষটির ব্যবহারে। একজন শান্তশিষ্ট মানুষ যদি হঠাৎ ভীষণ রেগে যান বা সকলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করেন, সে দিকে নজর দিতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কেউ রেগে কথা বললে আমরা আহত হই বলে উল্টে তাঁর উপরে রেগে যাই। কিন্তু সে ভাবে না ভেবে, কেন তিনি অমন করে কথা বললেন, তিনি নিজে কোনও সমস্যায় আছেন কি না সে দিকে নজর দেওয়া জরুরি। ছোটখাটো পরিবর্তনও চোখে পড়লে তা রিপোর্ট হওয়া দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কী করণীয়?
‘‘এ ক্ষেত্রে কিউ-পি-আর জরুরি। অর্থাৎ কোয়েশ্চেন-পারসুয়েড-রেফার। সহজ করে বললে, আস্ক-লিসেন-রেফার। কাউকে ভালনারেবল মনে হলে তাঁকে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে প্রশ্ন করতে হবে। তিনি যদি সমস্যার কথা একবার বলতে শুরু করেন, তা হলে চুপ করে শুনতে হবে। আর তাঁর কথা যে শুনছেন, সেটা ডি-ব্রিফ (সে যা বলবে, সেটাই ছোট করে বলে বোঝার চেষ্টা করা) করে তাঁকে বোঝাতে হবে। কোনও ভাবেই জাজমেন্টাল হওয়া বা তাঁকে সমালোচনা করা চলবে না। এতে সে বুঝবে, তাঁর কষ্ট আর একজন কেউ বুঝতে পারছে। সে ভরসা পাবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা নিজেদের মতো করে সমাধান করার চেষ্টা করি, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা যথেষ্ট কার্যকর হয় না। বরং সে সব না করে তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রফেশনালের কাছে পাঠাতে হবে। বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে তাঁকে বোঝাতেহবে, এক বার চিকিৎসকেরপরামর্শ নেওয়ার জন্য,’’ বললেন দেবারতি। বেশির ভাগ মানুষ পরিচিত বৃত্তে নিজের গ্লানি, হতাশার চেহারা দেখাতে চান না। কারণ অনেকেই ভাবেন যে, তা হলে সমাজ তাঁকে বিশেষ নজরে দেখবে, সমালোচনার ভয়ে আরও গুটিয়ে যান। কিন্তু বিশেষজ্ঞ যদি অপরিচিত হন, তা হলে তাঁর সামনে নিজেকে প্রকাশ করা সহজ হয়ে যায়। এর সঙ্গেই দরকার শারীরচর্চা। রোজ এক ঘণ্টা ঘাম ঝরানোর মতো শারীরচর্চা খুব ভাল কাজে দেয়। এতে মস্তিষ্কে হ্যাপি হরমোন ক্ষরিত হয়। আর একটা দিক খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি কেউ একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এবং বেঁচে যান, তাঁদের দিকে নজর রাখা খুব দরকার। কারণ তাঁর মৃত্যুভয় কেটে যায়। সে সময়ে তাঁর চিকিৎসা শুরু হলেও সাবধানে রাখতে হবে। কারণ সিভিয়র ডিপ্রেশনে মানুষ কর্মোদ্যম হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু চিকিৎসা শুরু হলে রিকভারির সময়ে আবার অ্যাটেম্পট নেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই সম্পূর্ণ ভাবে হতাশা কাটিয়ে ওঠা পর্যন্ত সচেতনতা জরুরি বলে মনে করছেন দেবারতি। বাড়িতে বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে, নিকটজনকে হারালে, চাকরি চলে গেলে, বিবাহবিচ্ছেদের পরে অনেকেরই দীর্ঘ দিন মনখারাপ থাকে। কিন্তু সেই দুঃখেরও সময়সীমা আছে। দু’সপ্তাহ মতো মনখারাপ অনেকেরই থাকে। ধীরে-ধীরে স্বাভাবিক জীবনে আমরা ফিরতে শুরু করি। কিন্তু দু’-তিন সপ্তাহ, এক মাস কেটে গেলেও যদি সেই তীব্র মনঃকষ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে না পারেন, তখন বুঝতে হবে সেটা ডিপ্রেশন। সেই মুহূর্তে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন। নিজের মনের অবস্থা নিজেরা সকলের আগে বুঝতে পারি। তাই অন্য কেউ আমাকে বলার আগে নিজেকেই সচেতনহতে হবে।
আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনায় এখনও যেন ‘নিষেধাজ্ঞা’ রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনা জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কোনও কথা লেখা বা আলোচনা করবেন না, যা এই মানুষগুলোকে জীবনবিমুখ করে তোলে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব সুইসাইড প্রিভেনশনের গাইডলাইন অনুযায়ী আত্মহত্যার ছবি, ভিডিয়ো ফুটেজ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনও লিঙ্ক প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সমালোচনা বা নেতিবাচক আলোচনা নয়, বরং ইতিবাচক আলোচনা অবসাদগ্রস্ত মানুষদের সহমর্মিতার আশ্বাস জোগাবে। আত্মহত্যা কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না। জীবনে সাময়িক সমস্যা দেখা দিলেও পরবর্তী জীবন সফল ও সুন্দর হতে পারে। অপেক্ষা করতে হবে সেই সুন্দর দিনের জন্য।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।