ছবি: আনন্দবাজারের আর্কাইভ থেকে।
যত দূর চোখ যায় মসৃণ পিচ রাস্তা। দু’পাশে রুক্ষ এবড়োখেবড়ো জমি। খুব শক্তপোক্ত গাছ ছাড়া এই অঞ্চলে টিঁকে থাকা মুশকিল। সারা বছর গাঁটওলা শরীরে ধুলো মেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে গাছের সারি। তার পর ফাগুন চৈত্র মাসের রোদের ওম গায়ে মেখে নেওয়ার পর একেবারে রাতারাতি ভোল বদলে ফেলে। শাখা-প্রশাখা ভরে উপচে পড়ে এক আশ্চর্য কমলা রঙের ফুল। পলাশ। এই ফুলের বটানিকাল নাম না কি বুটেয়া মনোস্পারমা। ধুর কী বিশ্রি শুনতে এই ল্যাটিন শব্দ। তার থেকে ফ্লেম অফ্ দ্য ফরেস্ট ঢের ভাল। জঙ্গলের শিখা। আগুন রঙা। প্রায় রবিবাবুর বসন্তের গানেরই মতো।
তা পলাশের জাদু আছে বৈকি। পিচ রাস্তায় সাঁই করে বেরিয়ে যাওয়া তাগড়াই চারচাকা ও স্পিড কমায়। গাড়ির সওয়ারিরা উল্লসিত হয়ে বলে, “আরে কী ফ্যান্টাস্টিক। এ তো এক্কেবারে জঙ্গল রে!” মুঠোফোন হাতে গাড়ি থেকে ঝপাঝপ নেমে পড়েন তাঁরা। সেলফি তুলতে। “অ্যাই, এখন পলাশ তুলে মাথায় গুঁজেছিস কেনো? মালা তো আমরাও পরব। বিনুনীতে জড়াব। কিন্তু সে তো শান্তিনিকেতনের দোলে!”
পলাশ বিনা আবার বসন্তোৎসব কিসের? সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয় ঠিকই তো। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে বসন্তোৎসবের ছবি বা ভিডিয়োতে গাল-কপালে লাল, সবুজ, হলুদ আবিরের ছোঁয়া লাগা হাস্যমুখী সুন্দরীদের হাতে পলাশের কঙ্কন, বিনুনী জড়িয়ে পলাশের মালা। পলাশ পরার লাইসেন্স রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং দিয়ে গিয়েছেন না? বসন্তোৎসবের মূল অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে, প্রসেশনের প্রথম গানেই তো আছে, “রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে/ রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত আকাশে।” তা পলাশ না পরলে চলে? এটাই ট্র্যাডিশন।
শান্তিনিকেতনে বসন্ত আহ্বানে পলাশ ফুলের আভরণের চল সেই প্রথম থেকেই? আশ্রমিকদের স্মৃতিকথা কী বলে? ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের ছাত্র ও পরে সঙ্গীত ভবনের শিল্পী-অধ্যাপক শান্তিদেব ঘোষ ‘জীবনের ধ্রুবতারা’ বইয়ে ‘বসন্তোৎসবের সূচনা’ শীর্ষক লেখায় জানিয়েছেন যে, অধুনা বসন্তোৎসবের কাঠামো সেই তিরিশের দশকের। রবীন্দ্রনাথ নিজেই ‘হোলি’র রং খেলাকে এক নতুন রূপ দিয়েছিলেন, অনুষ্ঠানের জন্য গান ও কবিতা রচনা করে। আম্রকুঞ্জেই হত উৎসব। শান্তিদেব লিখেছেন, ছাত্রীদের হাতে তালপাতার ঠোঙায় আবির আর ঝুরো ফুল, কারও হাতে ধূপের ঝারি। সাজপোশাক সব বাসন্তী রঙের। শাড়ি পরিহিতারা ‘খোঁপায় গুঁজত নানা প্রকার ফুলের একটি ছোট গুচ্ছ একটি কচি পাতার সঙ্গে।’ পাঠক লক্ষ্য করুন, কোথাও কিন্তু পলাশের গয়নার উল্লেখমাত্র নেই। রবীন্দ্রনাথের আমলের ঐতিহ্যের লিস্ট থেকে বাদ পড়েছে সে।
তবে কবে থেকে পলাশের প্রবেশ? জিজ্ঞাসা করি শ্যামল চন্দকে। শ্যামলদা পাঠভবনে ছাত্র ছিলেন ১৯৫০ থেকে ’৫৫ সাল পর্যন্ত। তিনি নাচের দলে থাকতেন বটে, ছোট লাঠি নিয়ে গুজরাতি ডান্ডিয়া ধরনের নাচ। স্মৃতি হাতড়ে বলেন, “কই, নাচ-গানের সময় ছাত্রীদের পলাশের গয়না পরার চলন তো ছিল না! কেউ কেউ রাস্তায় পড়ে থাকা পলাশ চুলে পরত বটে, কিন্তু সে তো অনেক ফুলেই কেশ সজ্জা হত শান্তিনিকেতনে।” পলাশের বিশেষ গুরুত্ব কি তা হলে একেবারে হাল আমলের ব্যাপার?
শেষে একটা সূত্র পাওয়া গেল আশ্রমবাসিনী নীলাঞ্জনা সেনের কাছ থেকে। কলাভবনের ছাত্রী ছিলেন ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। এক সময়ের ডাকসাঁইটে সুন্দরী। কিন্তু বললেন, “আমি কখওনই নাচিনি, তাই পলাশের গয়না পরিনি।” তা হলে প্রথা অনু্যায়ী শুধু নাচের দলের মেয়েরা পরত? নীলাঞ্জনা মুচকি হাসেন, “যাঁদের বিশেষ ছেলে বন্ধু থাকত, তাঁরা গাছে ওঠে,” তাই বল! পলাশ পেড়ে আনা তবে অনুরাগের পর্ব। তা বসন্ত তো মনে রং লাগানোর উৎসব। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ৭৭-এর কলাভবনের নিজস্ব বসন্তোৎসবের ছবি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সেখানে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা, আবির মাখা ছাত্রীর গলায় পলাশের মালা। সঙ্গে নাচছে যে তরুণ, তার মাথায় ফেট্টি, কিন্তু কোনও পুষ্পাভরণ নেই। নিজে পলাশের গয়না না পরলেও কন্যা সুদর্শনা যখন ছোট, তখন তার টিকলি বানিয়ে দিতেন নীলাঞ্জনা, তাঁর আশ্রম এলাকার শ্বশুরবাড়ির পিছনের হলুদ পলাশ গাছটির নীচে পড়ে থাকা ফুল দিয়ে।
দেখতে দেখতে আশির দশকে পা দিয়েছি আমরা। সে সময়ে পলাশের গয়না বসন্তোৎসবে একেবারে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে। আর তার পর থেকে তো কথাই নেই। গাছে উঠে মুচড়ে ডাল ভেঙে রাশিরাশি পলাশ এনে গলার মালা, হাতের বালা আর সিঁথিপাটি বানানোর ধুম। তা সেকি সবই নাচে অংশগ্রহণকারী বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীদের কাণ্ড? তা কখনও হয়? দোলে শহর থেকে আসা পর্যটকদের মনে হয়েছে, তাঁরাই বা বসন্তোৎসবের সাজগোজ থেকে বাদ পড়েন কেন? রূপদস্তার সঙ্গে পলাশের গয়না না হলে ব্যাপারটা জমবে কী করে? অথবা তাঁদের মনের ইচ্ছে টের পেয়ে ব্যাবসাদাররা একটা সুযোগ পেয়েছেন। ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের কোনটা আগে, সে হিসাবটা অর্থনীতির অধ্যাপকরা বলতে পারবেন।
ছবি: রবীন্দ্র ভবনের আর্কাইভ থেকে।
অভিজ্ঞতা বলে বিশ বছর তো হবেই, বসন্তোৎসবের দু’-তিন দিন আগে থেকে পলাশের গয়না বিক্রি শুরু হয়ে যেত। শান্তিনিকেতনের হাটে বাজারে। রাতারাতি গজিয়ে ওঠা দোকানে আবিরের স্তূপ, রঙিন কাগজ জড়ানো বেঁটে লাঠির সঙ্গে ঝুলত পলাশের মালা। সাইকেলের সিটে পলাশের পসরা নিয়ে মানুষ জন চলে যেতেন হোটেল আর লজে। পর্যটকরাই তো লক্ষী। পলাশের কল্যাণে দু’পয়সা রোজগার হয় গরীব-গুর্বোর। কিন্তু শুধু সেই ব্যাবসাটার গল্প বললে পুরো পলাশ কাহিনিটা তো আর জানা যায় না।
পলাশ বাঁচাও আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন শ্যামলী খাস্তগীর। যে কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদে প্রথম সারিতে শিল্পী, সমাজকর্মী নির্ভীক শ্যামলীদি। সঙ্গে ছাত্রছাত্রী, শিল্পী, অধ্যাপক, শান্তিনিকেতনবাসী পরিবেশসচেতন মানুষজন। জোরদার ক্যাম্পেন হয়েছিল বেশ কয়েক বছর। তার ফলে পলাশের ডাল মুচড়ে গাছ তছনছ পুরোপুরি বন্ধ হয়েছিল সে কথা হলফ করে বলা মুশকিল। কিন্তু খানিক সচেতনতা বেড়েছিল নিশ্চই। শোনা যাচ্ছে, আজকাল শুধু গাছের তলায় ঝরে পড়া পলাশ দিয়ে বানানো অল্পস্বল্প গয়না নিয়ে নাকি সন্তুষ্ট সকলে। শেষমেশ সব ঠিক হয়ে যাওয়া গল্পের মতো লাগছে?
তা হলে একটা আজগুবি গল্প দিয়েই শেষ করা যাক পলাশ কাহিনি। পাঠকদের ছোটবেলার প্রিয় বই লীলা মজুমদারের ‘হলদে পাখির পালক’-এর সেই রুমু-বোগী, তাদের পালিয়ে যাওয়া ভুলো কুকুর আর তাদের বাড়িতে কাজ করতে আসা দুমকাবাসী ঝগড়ু দাদা যে ভাই-বোনকে শোনাত হলদে পাখীর গল্প, সেই চরিত্রদের নিয়ে।
তো সেই রুমু আর বোগী এখন বড় হয়েছে। হোলির আগে বাইক চেপে বেরিয়েছে দুমকা যাবে বলে। ঝগড়ু দাদার সঙ্গে দেখা করতে। সিউড়ি, তিলপাড়া ব্যারেজ পেরিয়ে মাসাঞ্জোরের আগে রানিশ্বর থেকেই পলাশের জঙ্গল। না থেমে কী আর পারা যায়? ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাদের ঘোর লেগে যায়। এক-একটা গাছকে মনে হয় যেন এক ম্যাজিশিয়ান। তার কাঁধ, কব্জি, কনুইতে, ডালপালার সব শিরা-উপশিরা থেকে সে বার করে আনছে ফুল। অনেক, অনেক। তার ক্লান্ত বয়স্ক শরীর সেই উজ্জ্বল কমলা ফুলে ঢেকে নতুন হয়ে উঠছে। রুমু-বোগী শুনতে পায় গাছের বুকের ধুকপুকি।
দমকা বাতাসে পলাশ ঝরে পড়ে। রুমুর মাথা, হাতে। সে বোগীকে বলে দেখ দেখ, একদম যেন ছোট ছোট কমলারং পাখি। মধ্যেখানের পাপড়িটা এক্কেবারে পাখির ঠোঁটের মতো। একটু বাঁকানো। বোগী ঘাড় হেলায়। তার পর ঝরাপাতার উপর থেকে আলতো উঠিয়ে নেয় এক মুঠো। রুমু পলাশ ফুলগুলি হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়। তারা দেখে, হালকা পাপড়ির ডানায় ভাসতে ভাসতে এক ঝাঁক পাখি হয়ে যাচ্ছে পলাশ। বসন্তের শেষ বিকেলে।