সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হাতে নিজের প্রথম উপন্যাস তুলে দিলেন লেখক উজ্জ্বল সিন্হা। —নিজস্ব চিত্র।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গ্রামের চিঠি’-র কথা হয়তো রোজ রোজ মনে পড়ে না কারও। কিন্তু কোনও কোনও দিন তারাশঙ্করের হয়। শহরের বাইরে থেকে দুনিয়া দেখা তারাশঙ্করদের হয়। পৌষ-সন্ধ্যায় কলকাতার সবচেয়ে শহুরে সরণির বইয়ের দোকানের এক চিলতে চা-ঘর তার সাক্ষী হয়ে থাকল। তা নিয়ে মন্ত্রী-আমলায় নারদ নারদও হল।
যাত্রা শুরু করল ‘উজানযাত্রা’। —নিজস্ব চিত্র।
উপলক্ষ একটি বইয়ের প্রকাশ। বিপণন জগতের পরিচিত নাম উজ্জ্বল সিন্হা নানা কাজের জন্যই প্রশংসিত। তবে উপন্যাসের মলাটে নাম জুড়েছে এই প্রথম। সেই বই প্রকাশ করতে এক ছাদের তলায় জড়ো হয়েছিলেন বাংলার নানা জগতের প্রখ্যাত জনেরা। বই নিয়ে কথা বলতে গিয়েই সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, লেখক প্রচেত গুপ্ত থেকে ভাষাবিদ ও রাজ্য সরকারের উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যকার ও মন্ত্রী ব্রাত্য বসুদের মুখে বার বার ফিরে এল নগর জীবন আর নাগরিকতার বাইরে থেকে শহরকে দেখার উপলব্ধি। তবে দেখার ভঙ্গি বিবিধ। তাই নানা ভুবনের রকমারি উপলব্ধিই প্রাক্-সংক্রান্তির শহরের প্রাপ্তি হয়ে রইল।
উপন্যাসের নাম ‘উজানযাত্রা’। ফিরে দেখার কথা যে সে বই বলবে, তা তো জানাই। তবে জানা স্রোতেও কত কী ভেসে আসে, গল্পের একাংশ পড়ে শোনাতে শোনাতে সে কথাই যেন মনে করিয়ে দিলেন কবি শ্রীজাত। একে একে গল্পের ব্যাখ্যা শুরু হতেই আলাপনবাবু বললেন, ‘‘বাংলা সাহিত্য আগে মফস্সলকে চিনত না।’’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা উপন্যাসের সবচেয়ে চর্চিত নামেদের উল্লেখ করে তিনি মনে করান, বাংলায় উপন্যাস লেখা হওয়া শুরু হতেই শহুরে মন ও মননকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়েছে। মফস্সল এসেছে অনেক পরে। উজ্জ্বলবাবুর বইয়ে রয়েছে মফস্সলের মনের ছাপ। সে কথা বোঝাতে গিয়েই তিনি এমন বলেন। তবে সাহিত্য মানেই বিবিধ সমালোচনা। বই প্রকাশের মঞ্চও তার বাইরে নয়। তাই রাজনীতিতে সুর মিলুক বা না মিলুক, সাহিত্য-পাঠে সে সবের কোনও বাধা মানেন না তাঁরা। ব্রাত্যবাবুর কথায় ভিন্ন সুর উঠেই এল। নগর বনাম গ্রাম, মফস্সলের আকাঙ্ক্ষা— সবই যে নানা ভাবে নানা সময়ে উঠে এসেছে বাংলা গদ্যে, সে কথাও হল। উঠে এল আত্মউপলব্ধিমূলক সাহিত্যের কথা। এ সময়ে ‘উজানযাত্রা’র কথা বলতে গিয়ে যেমন বার বার তারাশঙ্করের উপন্যাসে ব্রহ্মাণ্ডের কথা উঠে এল, তেমনই কখনও এল অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়া পাতার নৌকা’-র কথা।
বইয়ের মলাট উন্মোচন। (ডান দিক থেকে) লেখক প্রচেত গুপ্ত, প্রকাশক সুধাংশুশেখর দে, শিল্পী শুভাপ্রসন্ন, ভাষাবিদ ও রাজ্য সরকারের উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বইয়ের লেখক উজ্জ্বল সিন্হা, মন্ত্রী ও নাট্যকার ব্রাত্য বসু, কবি শ্রীজাত। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র।
গ্রাম, শহর, মফস্সলের নানা অভিজ্ঞতা মিলেমিশে একাকার হয়েছে যাঁর বিবিধ উপন্যাসে, সেই তিনিই উপন্যাসের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করলেন। তার পর শীর্ষেন্দুবাবু যেন সস্নেহেই মেলালেন অনুজদের সমালোচনার টানাপড়েন। নিজের মতো করে মফস্সলের অভিজ্ঞতা এবং শহর দেখা আর লেখার কথা উঠে এল। ‘উজানযাত্রা’ পড়ে তাঁর কী মনে হয়েছে, সে কথাও বললেন সাহিত্যিক। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই লেখার মধ্যে কবিতার সঞ্চার আছে।’’ উপন্যাস উন্মোচনের সময়ে এক চরিত্রের ডুবে যাওয়ার উল্লেখ আছে। সেই ডুবই ভাবিয়েছে প্রবীণ সাহিত্যিককে। সেখানে সামাজিক বা ভৌগোলিক গণ্ডির দূরত্ব যেন মিলিয়ে যায়। থাকে শুধুই মন, মানসিকতা আর মনন। ডুবে যাওয়ার যে কত বিস্তারিত প্রকাশ ও ব্যাখ্যা হয়, তা-ই মিলিয়ে দেয় যেন তত ক্ষণে সমালোচনায় আসা নানা ভাবনার বিভেদ।
শীত-সন্ধ্যায় গুণিজনেদের সমাগমে এ সবের মাঝেই যাত্রা শুরু করল ‘উজানযাত্রা’।