আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, আর নীচে অসীম জলরাশি। রং কোথাও ঘন নীল, কোথাও আবার খানিক হালকা। তারই মধ্যে দৃশ্যমান, সাগরের বুকে ঘন হয়ে থাকা সবুজ। সেই সবুজের ফাঁকফোকর গলে চোখে পড়ে সৈকতে ঝাঁপিয়ে পড়া ঢেউয়ের সাদা ফেনিল জলরাশি। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। এ নামের সঙ্গে অনেকেরই প্রথম পরিচয় হয় ভূগোল বা সাধারণ জ্ঞানের বইতে। এই দ্বীপপুঞ্জ ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি।
ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে এই দ্বীপপুঞ্জে আসার উপায় হয় উড়ান, নয়তো জাহাজ। বিমান আন্দামান ও নিকোবরের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারের মাটি স্পর্শ করার খানিকটা আগে থেকেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে সাগরের অপূর্ব রূপ।
এক দিকে বঙ্গোপসাগর, অন্য দিকে, আন্দামান সাগর। তার মধ্যে ৮৩৬টি দ্বীপের সমাহারে তৈরি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দু’ভাগে বিভক্ত। উত্তরে আন্দামান ও দক্ষিণে নিকোবর। এখনও আন্দামান ও নিকোবরের বহু জায়গা আমজনতার অগম্য। মাত্র ৩১টি দ্বীপে মানুষের বসবাস রয়েছে।
পোর্ট ব্লেয়ার: আন্দামান ভ্রমণের সূচনা করতে হয় পোর্ট ব্লেয়ার থেকেই। ছোট্ট একটি শহর। শহরকে ঘিরে রয়েছে একাধিক সমুদ্র সৈকত। কোথাও আবার সমুদ্রের পাশ দিয়েই গিয়েছে কালো পিচের মসৃণ রাস্তা। শহর ঘিরে চড়াই-উতরাই পথ। পোর্ট ব্লেয়ার থেকেই ঘুরে নেওয়া যায় সেলুলার জেল, রস ও নর্থ বে দ্বীপ, সংগ্রহশালা, মাড ভলক্যানো।
সেলুলার জেল: স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখা বিপ্লবীদের এক সময় বন্দি রাখা হত এখানে। এই জেলে এক বার ঢুকলে বেঁচে বেরোনো অসম্ভব ছিল। কারাগারের প্রতিটি কক্ষ এখনও সাক্ষী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের। ব্রিটিশদের অত্যাচারের কাহিনি শুনলে কখনও মন দ্রব হয়ে যায়, কখনও আবার প্রচণ্ড রোষে জ্বলে ওঠে।
সমুদ্রপারের কারাগারে ইংরেজদের নির্মমতা ও স্বাধীনতার সংগ্রামীদের স্বপ্ন আজও জীবন্ত হয়ে ওঠে প্রতি সন্ধ্যায় ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’-এর মাধ্যমে। কিছু ক্ষণের জন্য মানসচক্ষে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে নির্মম অত্যাচার, ক্রন্দন, হাহাকার, বন্দে মাতরম ধ্বনি।
ভিজে যাওয়া চোখ মুছে, কষ্ট কিছুটা কমাতে এর পর ঘুরে নিতে পারেন পোর্ট ব্লেয়ারের দক্ষিণ প্রান্তে ‘ফ্ল্যাগ পয়েন্ট’। ১৯৪৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর এখানে প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। দুই দ্বীপকে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল জাপান। পরে ব্রিটিশদের দখলমুক্ত ওই দ্বীপকে স্বাধীন ঘোষণা করেন সুভাষচন্দ্র বসু।
সান্ধ্য আলোয় সমুদ্রের হাওয়ায় ঘুরে নিতে পারেন রামকৃষ্ণ মঠ, আশপাশের পার্ক ও দোকানপাট।
পোর্ট ব্লেয়ারে রয়েছে বেশ কয়েকটি সংগ্রহশালা। তার মধ্যে একটি নৃতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা। এখানে এলে দেখতে পাবেন আন্দামানের প্রাচীন জনজাতিগুলির জীবনযাত্রা। বিভিন্ন মডেলের মাধ্যমে ও জিনিসপত্রের দ্বারা তা তুলে ধরা হয়েছে।
চ্যাথামে রয়েছে করাত কল। ভৌগোলিক কারণে আন্দামানে প্রচুর বৃষ্টি হয়। এখানে প্রচুর বড় বড় গাছ রয়েছে। করাত কলে গাছ থেকে কী ভাবে কাঠ বার করা হয়, তা চাক্ষুষ করা যায়। তা ছাড়া এখানকার কাঠের জিনিসপত্রও চোখধাঁধানো।
এখানকার নেভাল মেরিন মিউজ়িয়াম ‘সামুদ্রিক’-এ দেখতে পাবেন রকমারি প্রবাল, শঙ্খ, ঝিনুক। প্রবালগুলি কোনওটি আঙুলের মতো, কোনওটি আবার ঝাঁকড়া। এখানেই রয়েছে প্রাচীন কচ্ছপের খোলস, বিরাট ঝিনুক।
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ঘুরে নিতে পারেন করবাইনস কোভ, ওয়ান্ডুর সমুদ্রসৈকত, চিড়িয়া টাপু। নারকেল গাছে ঘেরা, মিহি বালুর এক এক সৈকতের সৌন্দর্য এক এক রকম। তবে ওয়ান্ডুর সৈকতে কুমিরের ভয় রয়েছে, তাই একেবারে জলের কাছে যাওয়া যায় না।
রস, ভাইপার ও নর্থ বে আইল্যান্ড: রাজীব গান্ধী ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্সের জেটি থেকে নৌকো ধরে চলে যাওয়া যায় রস ও ভাইপার দ্বীপে। আবছা হয়ে আসা ব্রিটিশ উপনিবেশের বাড়ির কাঠামো, গির্জার ভগ্নাবশেষ আজও ঝড়জল সয়ে টিকে আছে। সবুজ ঘেরা রস আইল্যান্ডে হরিণ চরে বেড়ায়।
রস থেকে বেশ কিছুটা দূরে ভাইপার আইল্যান্ড। অবশিষ্ট আর বিশেষ কিছু নেই, ঢিপির মাথায় ইমারতের ভাঙা কাঠামো। ফেরার পথে নর্থ-বে আইল্যান্ড। এখানে বিভিন্ন জলক্রীড়ার সুযোগ রয়েছে।
জলিবয়: আন্দামানের সবচেয়ে সুন্দর জায়গার মধ্যে জলিবয় একটি। বছরে মাত্র ছ’মাস সেখানে পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি মেলে, তা-ও আবার সীমিত। প্রবাল দেখার সবচেয়ে ভাল জায়গা নিঃসন্দেহে জলিবয়। কাচের মতো স্বচ্ছ জল। দূষণ এড়াতে প্লাস্টিক নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
মহাত্মা গান্ধী মেরিন ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত দ্বীপটি। ওয়ান্ডুর সৈকতের কাছেই একটি জেটি থেকে জলি বয়ের জন্য নৌকো ছাড়ে সকালে। খাঁড়িপথ দিয়ে যাত্রা শুরু। কত রকম যে পাখি ডেকে ওঠে আকাশছোঁয়া গাছের আড়াল থেকে! ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছনো যায় সবুজে ঘেরা সেই দ্বীপে। এখান থেকে ‘গ্লাস বটম বোটে’ প্রবাল, রঙিন মাছ দেখার অভিজ্ঞতা অবর্ণনীয়। এখানেই দেখা মেলে ‘নিমো’ মাছ বা ক্লাউন ফিশের।
চুনাপাথরের গুহা ও মাড ভলক্যানো: আন্দামান ট্রাঙ্ক রোডে ধরে যাওয়ার পথে পড়ে গভীর জঙ্গল। সেখানেই বাস আন্দামানের জনজাতি জারোয়াদের। গহীন বনের সেই রূপ অবশ্য ক্যামেরাবন্দি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। এ পথে যেতে গেলে অনুমতি নিতে হয়। কনভয়ের সঙ্গে যায় পর্যটকদের গাড়ি।
সড়কপথ শেষ হয় জলপথে। ওপারে বারাটাং। ভেসেলে জলপথ পার করে চেপে বসতে হয় স্পিড বোটে। দু’পাশে ম্যানগ্রোভের মাঝে খাঁড়ি। আধ ঘণ্টা সেই পথে গিয়ে নয়া ডেরা জেটিতে নেমে দেড় কিলোমিটার পদব্রজে চুনাপাথরের গুহা। সেখানে ঘুরে, বারাটাং ফিরে আবার অন্য পথে ‘মাড ভলক্যানো’।
হ্যাভলক: কাকভোরেই ফেনিক্স বে জেটি থেকে জাহাজ ছাড়ে হ্যাভলকের উদ্দেশে। সেই নীল জলের রূপ বদলাতে থাকে মেঘ ও রোদের লুকোচুরির সঙ্গে সঙ্গে। জল কোথাও এতটাই নীল, যেন কেউ দোয়াত থেকে কালি ঢেলে দিয়েছে। আবার বালুতটে সেই রং হালকা হয়ে গিয়েছে।
ছবির মতো সুন্দর দ্বীপ হ্যাভলক। চারদিকে নারকেল গাছের সারি। সমুদ্রের পারে ম্যানগ্রোভের ছোঁয়া। এখান থেকে ঘুরে নেওয়া যায় রাধানগর ও কালাপাথর সৈকত থেকে। রাধানগর সৈকতে স্নান করা যায়। চারপাশে বড় বড় গাছ ঘেরা এই সৈকতের সূর্যাস্ত বড়ই মনোরম। এখান থেকে ঘুরে নেওয়া যায় এলিফ্যান্ট বিচ।
নিল আইল্যান্ড: আন্দামানের আর এক আকর্ষণ নিল আইল্যান্ড। ছোট্ট এই দ্বীপ যেন ছবির মতোই সাজানো। এখানে ঘুরে নেওয়া যায় ভরতপুর, লক্ষ্মণপুর ও সীতাপুর সৈকত। এখানকার রামনগর সৈকতে অস্তমিত সূর্যের রূপ দর্শনীয়। লক্ষ্মণপুরেই দেখা যায় প্রাকৃতিক সেতু। আবহবিকারের ফলে সেতুর আকার পেয়েছে সৈকতের একটি পাথর।
বারাটাং থেকে ঘুরে নেওয়া যায় রঙ্গত, মায়া বন্দর, রস অ্যান্ড স্মিথ আইল্যান্ড। এই স্থানগুলিতে পর্যকের সংখ্যা বেশ কম। রস ও স্মিথ, দুই দ্বীপের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ভাটায় সমুদ্রের জল সরে গেলে জেগে ওঠে বালির চর। সেই চর দিয়ে হেঁটেই এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে পৌঁছনো যায়।
কলকাতা থেকে সরাসরি উড়ান আছে পোর্ট ব্লেয়ারের। জলপথেও আসা যায়, তবে তা সময়সাপেক্ষ। পোর্ট ব্লেয়ার, হ্যাভলক ও নিল দ্বীপে ঘোরার সবচেয়ে ভাল উপায় স্কুটি ভাড়া করে নেওয়া। লাইসেন্স থাকলে ভাড়ার জন্য সহজেই স্কুটার ও বাইক মেলে।