পদকজয়ী কন্যারা। ফাইল চিত্র।
মীরাবাই চানুকে কে চিনত? যদি না চেনাত টোকিয়ো! অলিম্পিক্সে পদক জিতলেন মেয়ে। ফেরার পর ফোনে ফোনে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর মাটিতে বসে ভাত খাওয়ার ছবি। পদক ছাপিয়ে নেটমাধ্যমে আবেগভরা গল্প ছুঁয়ে ফেলল তাঁর কানের দুল, অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা। অথবা রানি রামপাল। একদা স্রেফ গাছের ডাল সম্বল করে হকির ময়দানে নেমে পড়া মেয়ের অলিম্পিক্স দৌ়ড় দেখছে গোটা দেশ। অথবা পুসারলা বেঙ্কট সিন্ধু। পরপর দু’টি অলিম্পিকে পদক। রিয়ো এবং টোকিয়ো। টোকিয়োয় সেমিফাইনালে উঠে পদক নিশ্চিত করেছেন বক্সার লভলিনা বরগোঁহাই।
টোকিয়ো বলছে, অলিম্পিক্স থেকে পদক আনছেন মেয়েরা। পুরুষদের পদক সেই তুলনায় কোথায়! টোকিয়োয় এখনও পর্যন্ত পুরুষ অ্যাথলিটদের কারও কপালে পদক জোটেনি। মঙ্গলবার পুরুষদের হকি দল হেরে গিয়েছে বেলজিয়ামের কাছে। এখন দেশ তাকিয়ে তাদের তৃতীয় স্থান নির্ণায়ক ম্যাচের দিকে। ব্রোঞ্জ পদকের লক্ষ্যে। সেই পদক জিতলেও পদকের দৌড়ে টোকিয়োয় ভারতের মেয়েরা যে পিছনে ফেলেছে ভারতের ছেলেদের, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
মেয়েদের এই দলের দিকেই তাকিয়ে এখন দেশ। ফাইল চিত্র।
ভারতীয় সমাজ অবশ্য এখনও বলে, মেয়েরা খেলাধুলো করবে কেন! তারা তো লক্ষ্মীমন্ত হবে। ধীরগতিতে চলবে। হকিস্টিক হাতে দৌড় তাদের সাজে না! তবু টোকিয়ো অলিম্পিক্স চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, দিন বদলাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে লিঙ্গভেদের দাবিদাওয়া।
ভারতীয় মহিলাদের ক্রিকেট টিমের প্রাক্তন অধিনায়ক ঝুলন গোস্বামী অবশ্য মনে করছেন, দু’-একটি পদকজয় আসলে কিছুই বদলায় না। মেয়েরা যতই সাফল্য এনে দিক, তাদের লড়াইয়ের প্রয়োজন কখনও মেটে না। ঝুলনের কথায়, ‘‘মেয়েরা নানা খেলায় এগিয়ে যাচ্ছে। সেই ২০১২ সালের অলিম্পিক্স থেকে পরপর পদক আনছেন মেয়েরা। তবু সামান্য কোনও পদক্ষেপের জন্যও মেয়েদের অনেক লড়াই করতে হয়। ভ্রূণহত্যাও থামে না!’’ ক্রীড়াজগতে লিঙ্গভেদ নিয়ে গবেষক পয়োষ্ণী মিত্রের মতে, টোকিয়োয় মেয়েদের হকি দলের সাফল্যই একমাত্র আশার বিষয়। এই ক্রীড়া মানবাধিকারর্মীর বক্তব্য, ‘‘দলগত ভাবে কোনও খেলায় ভাল করলে তবেই বলা যায় যে মেয়েদের ক্রীড়ায় মন দিচ্ছে দেশ। না হলে কোনও একটি বিশেষ খেলায় এক জন মহিলার সাফল্য আসলে বিশেষ আশার আলো দেখায় না। সে পদকজয় যতই আনন্দের হোক না কেন। তা দেশে খেলাধুলোর ক্ষেত্রে সামগ্রিক পরিকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলে না।’’ পয়োষ্ণী জানাচ্ছেন, দেশ যত দিন মেয়েদের খেলার ক্ষেত্রে পরিকাঠামোর উন্নয়নে আরও মন না দেবে, তত দিন এমন জয় শুধু হঠাৎ কিছু দিনের আনন্দের বিষয় হয়েই থেকে যাবে।
কোন রঙের পদক আসবে লাভলিনার সঙ্গে?
কন্যাভ্রূণ হত্যায় বিশ্বসেরা এই দেশ। এগিয়ে চলা তো দূরের কথা, জন্ম নেওয়া, বেঁচে থাকার যোগ্যতা অর্জন করাই হল আসল লড়াই। সংখ্যায় কি বদল ঘটছে না সময়ের সঙ্গে? ঘটছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ সালের পর থেকে কন্যাভ্রূণ হত্যা বেড়েছে এ দেশে। অলিম্পিক্সের রুপো বা ব্রোঞ্জ সে কথা ভোলাতে পারে? নাকি বেশি করে মনে করিয়ে দেয় কঠোর বাস্তব। পদক নিয়ে হইচইয়ের পরে ফিরে আসে রোজের সেই ভেদাভেদের গল্প। মহিলা বক্সার কতটা মহিলা আর কতটা বক্সার— সেই কৌতূহল ঘুরপাক খায় দেশ জুড়ে। রুপোজয়ী চানুর নারী হিসাবে অলিম্পিক্সের জন্য তৈরি হওয়ার গল্পের আড়াল থেকে উঁকি দেয় এ দেশের মেয়েদের লড়াইয়ের কথা।
ক্রীড়া মানবিধাকার কর্মী পয়োষ্ণী মনে করান, এখনও গোটা দেশ থেকে অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণকারী ছেলেদের সংখ্যা মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি। নারী অধিকারকর্মী অনুরাধা কপূর জানান, এই সংখ্যার দিকেই আসলে নজর দেওয়া জরুরি। কারণ, সেটিই সমাজের বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরে। তবে কি অলিম্পিক্সে দেশের মেয়েদের পদকজয় কোনও বদলের কথা বলে না? অনুরাধার অভিমত, ‘‘এই জয় দেখায় যে, মেয়েরা কিছুটা সুযোগ পেলেও তার সদ্ব্যবহার করতে জানে। কিন্তু পরিসংখ্যান দেখিয়ে দেয়, মেয়েদের ক্ষেত্রে সুযোগ পাওয়ার লড়াই কত কঠিন।’’
আবারও মান রেখেছেন সিন্ধু। ফাইল চিত্র।
সামগ্রিক পরিসংখ্যানেই মন দেওয়া জরুরি বলে অভিমত সমাজতাত্ত্বিক প্রশান্ত রায়েরও। তাঁর কথায়, ‘‘এই কয়েকটি পদক দেখাল যে, সুযোগ পেলে অনেক কিছু করতে পারে মহিলারা। সব ক্ষেত্রে যখন নিয়মিত এ ভাবে মেয়েরা এগিয়ে আসবে, তখনই বোঝা যাবে দেশ এগোচ্ছে।’’ ছেলে বনাম মেয়ের লড়াইয়ের প্রসঙ্গ পদকজয়ের ক্ষেত্রে না তোলাই শ্রেয় বলে মত তাঁর। কারণ, তাতে আলোচনার মোড় অপ্রাসঙ্গিক দিকে ঘুরে যেতে পারে। প্রশান্তর কথায়, ‘‘এতে আসল বিষয়টি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেটি হল, আরও আরও মেয়েদের এগিয়ে আসার সুযোগ পাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরতে হবে।’’