আপনার বাড়ি সেজে উঠুক বট, অশ্বত্থ, পাকুড়, কমলালেবু গাছের সমারোহে। না, বাগানবাড়ির কথা বলছি না। আপনার কয়েকশো স্কোয়ার ফুটের ছোট ফ্ল্যাটেই জায়গা হবে এই সব মহীরুহের। সবুজ ও আভিজাত্যের ছোঁয়ায় ঘর হবে তপোবন। কোথাও বটের ঝুড়ি নেমে আসবে। কোথাও ফলভারে নুয়ে পড়বে কমলালেবুর গাছ। কখনও বা পাতা নয়, শুধু লাল ফুলে ভরে থাকবে কৃষ্ণচূড়া। শুনতে অলীক লাগলেও এটা সম্ভব। সম্ভব, বনসাই পদ্ধতিতে করা গাছের মাধ্যমে। সহজ ভাবে আমরা বনসাই বলতে বুঝি বড় গাছের মিনিয়েচার বা ক্ষুদ্র সংস্করণ। আসলে বনসাই শব্দটি জাপানি। ‘বন’ মানে টব বা ছোট পাত্র, ‘সাই’-এর অর্থ মাটিতে পুঁতে দেওয়া গাছ। ২৬৫ থেকে ৪২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চিনের জিন সাম্রাজ্যের সময়ের লেখালেখিতে প্রথম বনসাই পদ্ধতির উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে কিন্তু বনসাই শব্দটা ছিল না, ছিল ‘পেনজাই’ শব্দটি। শোনা যায়, জাপানে চিনা ছাং রাজবংশের শাসনকালে জাপানিরা চিনাদের কাছ থেকে বনসাই সংস্কৃতি আত্মস্থ করেছিলেন। প্রথম এক জাপানি জ়েন সন্ন্যাসি তাঁর লেখায় ‘বনছেকি’ শব্দটা ব্যবহার করেন। ধরে নেওয়া হয়, সেখান থেকেই এসেছে বনসাই। প্রথম প্রথম জাপানিরা এই বামনাকৃতি গাছ দিয়ে ঘরবাড়ি সাজাতেন। পরে বনসাই দিয়ে বড় বড় বাগান তৈরি শুরু হয়। আজও জাপানে প্রাচীন বনসাইগুলো ওই দেশের জাতীয় সম্পদ। ক্রমে বনসাই চর্চা চিন, জাপান থেকে ছড়িয়ে পড়ে কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও তাইল্যান্ডে। আর এখন তো গোটা বিশ্বেই। আমাদের দুই বাংলায় বনসাই চর্চা বেশ জনপ্রিয়।
বনসাইয়ের প্রথম পাঠ
যে কোনও ভাল নার্সারি থেকে পছন্দসই বনসাই কিনতে পারেন। কিন্তু সময় ও ধৈর্য থাকলে নিজে হাতেও তৈরি করে ফেলতে পারে ন বনসাই। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় বট, অশ্বথ, বকুল, শিমুল, পাকুড়, তেঁতুল, শিরীষ, পলাশ, ছাতিম, জাম, নিম, পেয়ারা, ডালিম, কমলালেবু, অর্জুন, করমচা, কৃষ্ণচূড়া, দেবদারু, নিম, কনকচাঁপা, পাথরকুচি, বোগেনভিলিয়া, চিনা বাঁশ ইত্যাদি গাছগুলির বনসাই ভাল হয়।
বনসাইয়ের জন্য আদর্শ কলমের চারা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টব ও মাটি। এর জন্য প্রয়োজন ছোট, চওড়া, কম গভীর, বৃত্তাকার, আয়তাকার, বর্গাকার কিংবা ত্রিভুজাকার টব। খেয়াল রাখবেন, মাটি বা সেরামিকের টব যেন দেখতে সুন্দর হয়। কারণ বনসাই করার প্রধান উদ্দেশ্য তাকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলা। তাই প্লাস্টিকের টব নৈব নৈব চ।
বনসাইয়ের জন্য পলি বা দোআঁশ মাটিতে জৈব সার মিশিয়ে নিন। জৈব সারের মধ্যে সমপরিমাণ ইটগুঁড়ো, হাড়গুঁড়ো, কাঠের ছাই, খড়িমাটি মিশিয়ে সার তৈরি করতে হবে। অনেকে রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন। কিন্তু এই সার বনসাইয়ের দীর্ঘ জীবনের পক্ষে ভাল নয়। মাটি ও সারের অনুপাতে সারের পরিমাণ বেশি থাকবে। মাটি তৈরি হয়ে গেলে টবের ছিদ্রতে এক টুকরো তারের জালি রেখে তার উপরে কাঁকর বিছিয়ে তার পরে মাটি ও সারের মিশ্রণটি দিন।
বড় হওয়ার সময়
চারা গাছ তরতর করে বাড়তে থাকবে। ঠিক তখনই কাণ্ড, শিকড় ও শাখার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মনে রাখবেন, বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে মানে নষ্ট করা নয়। তাই প্রয়োজনে দক্ষ মালির সাহায্য নিন। বনসাইয়ের গাছ বেঁটে ও ঝোপের মতো ঝাঁকড়া হবে। তার জন্য বাড়ন্ত গাছের কুঁড়ি বা পত্রমুকুল ভেঙে দিতে হবে। বেশি ছোট করতে চাইলে ঘন ঘন পাতা ও কাণ্ড ছাঁটতে হবে। বাড়ন্ত ডগা কেটে ফেললে গাছের শাখার সংখ্যা দ্রুত বেড়ে ‘বুশ’ তৈরি হবে। কৃত্রিম উপায়ে তামার তার বেঁধে বনসাই গাছের শাখাকে সুন্দর, সুঠাম ভঙ্গিমায় সহজেই আনা যায়।
জল আলোর অনুপাত
রোজ নয়, মাটি শুকনো হলে জল দিন, দুপুরের পরে। খেয়াল রাখবেন টবে যাতে জল জমে না যায়। বনসাই গাছ অতিরিক্ত রোদে না রেখে ছায়ায় রাখুন। দক্ষিণের জানালা বনসাইয়ের পক্ষে আদর্শ। ধুলোবালি থেকে মুক্ত রাখার জন্য নিয়মিত ডাল ও পাতা মুছুন। দু’-এক বছর অন্তর টব ও মাটি বদলালে বনসাই গাছ দীর্ঘজীবী হয়।
বনসাই করলেই শুধু হবে না। নিয়মিত ধৈর্য ধরে তার যত্নআত্তিও করতে হবে।