ঘর সাজানোর নানা শৌখিন সামগ্রী ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
ফ্যাশন থেকে অন্দরসজ্জা, গয়নার কারুকাজ, ব্রোচের শিল্পিত সৌন্দর্য বা গাছের পরিচর্যা, খাওয়াদাওয়া, গানের আসর... সবে মিলে এ বারের ইন্ডিয়া স্টোরি প্রতিবারের মতোই জমজমাট। কলকাতায় বসে দিল্লি, মুম্বই, লখনউ, জয়পুর, বেঙ্গালুরুর মতো শহরের ডিজ়াইনারদের তৈরি পোশাক, অ্যাকসেসরিজ় খরিদ্দারির সুযোগ মেলে তিন দিনব্যাপী এই ইভেন্টে। এ বারও তার ব্যতিক্রম ছিল না, তবে অষ্টম এডিশনের নতুন সংযোজন ক্যালকাটা স্টোরি, যেখানে কলকাতার নানা শিল্পীর পোশাক, গয়না, অর্গ্যানিক প্রিন্টের বাহার, মাদুর, ইনস্টলেশন এই প্রচেষ্টার দিগন্তকে আরও প্রসারিত করেছে।
এই বিরাট কর্মযজ্ঞ শুরুর ভাবনা মধু নেওটিয়ার। গোড়ার দিকের কথা বলতে গিয়ে পুরনো স্মৃতিতে ডুব দিলেন তিনি, “আমি বড় হয়েছি ইংল্যান্ডে, বিয়ের পরে কলকাতায় এসেছি। কিন্তু বিদেশবাসী হলেও বাবা আমাদের ভারতীয় ভাবনাতেই বড় করেছিলেন। বাড়িতে আমরা হিন্দিতে কথা বলতাম। বিয়ের পরে যে পরিবারে এলাম তাঁদেরও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা। দামি বিদেশি ব্র্যান্ড নয়, বরং ভারতীয় জিনিসে তাঁদের আস্থা এবং গর্ব। তাই ছোটবেলা থেকে শুরু করে বিয়ের পরেও একই রকম ধারণা আমাকে ঘিরে রেখেছে। সব সময়ে মাথায় ঘুরত যে, এ দেশের সব কিছুই খুব সুন্দর এবং বৈচিত্রময়, কিন্তু কলকাতায় বসে দেশের নানা প্রান্তের জিনিস পাওয়ার উপায় কী? কমবয়সি ছেলেমেয়েরা বিদেশি স্টাইল, ব্র্যান্ডের প্রতি বেশি আকর্ষণ অনুভব করে, ট্রেন্ডে গা ভাসায়। ওরা জানেই না এ দেশে ফ্যাশনেবল কত কিছু রয়েছে। তখন থেকেই মনের মধ্যে ছিল আমাদের দেশের এই ফ্যাশন ভান্ডারকে আমি মানুষের সামনে তুলে আনব। সেখান থেকেই ইন্ডিয়া স্টোরি-র ভাবনা। সংক্ষেপে ফ্যাশন, খাওয়াদাওয়া, শিল্প, সঙ্গীতকে উদ্যাপন করা। এখানে যা কিছু থাকবে, তাকে হতে হবে দেশজ।”
বিভিন্ন রাজ্যের ডিজ়াইনারদের স্টলের (যেমন, নোটবুক এম, দ্য ট্রাইব, শাফলিং সুটকেসেস, ম্যানর ইন্ডিয়া, অংশ, স্পাঙ্কি ইত্যাদি) মাধুরীতে সেজে উঠেছিল রাজকুটিরের রাসমঞ্চ ও রংমঞ্চ। মধু জানালেন, আধুনিক প্রজন্মের ফ্যাশন ভাবনা যেহেতু অনেকাংশেই ঘোরাফেরা করে ইনস্টাগ্রামকে কেন্দ্র করে, তাই এমন ডিজ়াইনারদের এখানে বেছে নেওয়া হয়েছে যাঁদের সে বিষয়ে ধারণা আছে। তাই খুবই বেছে পোশাকশিল্পীদের নির্বাচন করা হয়েছে। ফ্যাশনের এই বিরাট সম্ভারের কারণেই হয়তো এখানে ক্রেতার তালিকাও চমকপ্রদ। প্রথম দিনের অতিথি ছিলেন ডিজ়াইনার তরুণ তাহিলিয়ানি। তাঁর মতো ব্যস্ত পোশাকশিল্পীর এ শহরে আসা ইন্ডিয়া স্টোরি ঘুরে দেখতে। এসেছিলেন মুনমুন সেন, কোয়েল মল্লিক, জয়া আহসানের মতো তারকারাও।
অসংখ্য ফুড স্টলের বাহার দেখায় এ দেশের খাবারের চিত্রপট। এক দিকে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিবিধ আঞ্চলিক খাবারকে, অন্য দিকে ভিন দেশীয় প্রভাবকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। উদ্যোক্তা মধুর কথায়, “বহু মানুষ এখন বিদেশে বেড়াতে যান। ফলে সেখানকার খাবার সম্পর্কেও তাঁদের ধারণা রয়েছে। কোনও অন্ত্রপ্রনর যখন নতুন ব্যবসা শুরু করেন, সেখানে থাকে নতুন ভাবনার সমাহার, যা তাঁরা হয়তো অন্যত্র দেখেছেন। তার পর সে রকম রেস্তরাঁ এ দেশে খুলেছেন। আমার জন্য সবটাই ইন্ডিয়া স্টোরি। কারণ এক্ষেত্রে ভারতীয়রা একটা ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।” জমকালো ইভেন্টের প্রথম দিন অতিথিদের জন্য রাখা খাবারের সম্ভারও চমক জাগায়। শেফ অনুমিত্রা ঘোষ দস্তিদারের মুনশিয়ানায় পশ্চিমি গ্রেজ়িং টেবল থিমে সে দিনের নির্যাস ছিল বাঙালিয়ানায় ভরপুর। “গ্রেজ়িং টেবলের চারপাশে ঘুরে গল্প করতে করতে অতিথিরা খাবার খান। বাঙালি থিমে টেবল সাজিয়েছিলাম কিন্তু চিরাচরিত যে ভাবে আমরা খাবারগুলো খেতে অভ্যস্ত, সে ভাবে ছিল না। শিম ভর্তা, বরবটি বাটা, ওলের ভর্তা, বিটরুটের ভর্তা, লাউশাকের পদ... এগুলো সাধারণত আমরা রুটি বা ভাতের সঙ্গে খেয়ে থাকি। এই খাবারগুলো যে আলাদা পদ হিসেবে খাওয়া যেতে পারে সেটাই দেখাতে চেয়েছি। খাবার এমন ভাবে বানানো হয়েছে যে, কথা বলতে বলতে যে কোনও পদ মুখে পুরে দিতে অসুবিধে হবে না।” উৎসব প্রাঙ্গণেও কলকাতার নানা ফুড জয়েন্ট ও মিষ্টিবিপণির স্টলে একই ভাবে স্বাদ ও বৈচিত্রের বসত।
এ বছরের বিশেষ আকর্ষণ কলকাতা স্টোরির আয়োজন ছিল রাজকুটির কোর্টইয়ার্ডে। সাবেক কলকাতার সঙ্গে আধুনিকতাকে মিশিয়ে মঞ্চটিকে সাজিয়েছিলেন এ শহরেরই ডিজ়াইনার নীল। আমোলি, পরমা, দেব আর নীল, নারায়ণ সিংহ, গ্রিন আর্থ, ওয়ান ফর্টি ফাইভ ইস্ট ইত্যাদির মতো নানা ব্র্যান্ডের সমাহারে সেজে উঠেছিল কলকাতা স্টোরি। এত দিন পর্যন্ত এখানকার ক্রেতারা অন্যান্য রাজ্যের নানা এক্সক্লুসিভ জিনিসের সন্ধান পেলেও সুর্নিদিষ্ট ভাবে কলকাতার বা এ রাজ্যের বাহারি নানা জিনিসের প্রদর্শনীর অভাব অনুভব করেছেন। সেখান থেকেই কলকাতা স্টোরির জন্ম। নানা ব্র্যান্ড এখানে শৌখিন ভাবে বাঙালিয়ানাকে তুলে ধরেছে। “এমন ভাবে ডিজ়াইনটা করা হয়েছে যেখানে পুরনো কলকাতার আকর্ষণ রয়েছে আবার তার মধ্যে সমকালীন সুরও রয়েছে। কারণ কলকাতা মানেই তো শুধু শিকড়কে খোঁজা নয়, সে অত্যন্ত আধুনিকও। তাই পরমা, ওবিটি, বাইলুমের মতো ট্র্যাডিশনাল ব্র্যান্ড যেমন রয়েছে, তেমনই মাটির কাছাকাছি থাকা আমোলি, গ্রিন আর্থ, আবার নলিন চন্দ্র দাসের ছানা ও গুড়ের মিষ্টি রয়েছে। অনেক স্টল দিয়ে খুব ভিড় বাড়াতে চাইনি। ব্রিদিং স্পেস রাখা হয়েছে। ভিডিয়ো ইনস্টলেশন, এয়ারলুম ওয়াক... এসবের মাধ্যমে বৈচিত্র আনার চেষ্টা করেছি,” বললেন নীল।
শীতশহরে তিনদিনের ফ্যাশন, ফুড পার্বণে কলকাতাবাসীও সুযোগ পেয়েছে ‘ট্রেন্ড’কে নতুন ভাবে উপলব্ধি করার।